পদ্মা সেতু: পর্যটন খাত বদলে দিবে বাংলাদেশকে

মীর মাহফুজুর রহমান
Published : 9 July 2022, 01:23 PM
Updated : 9 July 2022, 01:23 PM

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যারা এবার ঈদযাত্রা করেছেন, তাদেরকে বলার অপেক্ষা রাখেনা পদ্মা সেতু রাতারাতি কেবল বদলে দিয়েছে বাড়ি যাওয়ার অনুভূতি। ভোগান্তির যাত্রা রূপ নিয়েছে স্বস্তিতে, ভালোলাগায়। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সময় বাঁচিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমের সবুজ সৌন্দর্য উপভোগ করা।

পত্রপত্রিকার খবরে ইতিমধ্যে এসেছে, দেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে এবার পর্যটক কম। একইসাথে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলেও এবার ঈদের ছুটিতে গত বারের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যটকও হোটেল-মোটেলে বুকিং দেননি বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। এর বিপরীতে কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে এবার পর্যটকদের ভিড়ের কথা শোনা গেছে। সেখানে হোটেল বুকিং পাওয়া যাচ্ছে না। এই চিত্র তৈরি করে দিয়েছে পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু যে সত্যিকার অর্থে দেশবাসীর গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখেনা। নিজস্ব অর্থায়নে এর অচিন্ত্যনীয় নির্মাণ এবং এক্সপ্রেস হাইওয়ের নয়নাভিরাম স্বস্তির যাত্রা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রীদের মধ্যে ইতিমধ্যে বিস্ময় তৈরি করেছে। সমালোচকদের মধ্যে যারা পদ্মা সেতুর বিরোধিতা করেছিলেন, যারা খুঁত ধরার জন্য এখনো তটস্থ- তারাও এই সেতু দিয়ে দক্ষিণে যাত্রার পর নিজেদের সন্তুষ্টি গোপন রাখতে পারছেন না।

দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মহলের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে, যার দূরদর্শী নেতৃত্বে এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন- তিনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও 'মাদার অব হিউম্যানিটি' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মাসেতুর মতো আরো ডজনখানেক মেগা-প্রজেক্ট এ বছরই বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। তার নেতৃত্বের ভীত কতোটা দৃঢ়, তা এসব মেগা-প্রজেক্ট সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া এবং বাস্তবায়নের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে সেই উত্তাল জনসভায় বলেছিলেন, 'আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। আসলেই তো, এ কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন সেই 'দাবায়ে রাখতে না পারার' একটি ইঙ্গিত মাত্র। বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানি, দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মার বুকে দণ্ডায়মান অবাক বিস্ময়, স্বপ্নজয়ের উপাখ্যান- আমাদের পদ্মাসেতু ।

স্বাধীন দেশে চোখে পড়ার মতো বড় কোন অর্জন যদি বাঙালি জাতি দেখে থাকে তা হলো পদ্মা সেতু। আমাদের স্বপ্নের সেতু৷ দুর্গম পথের সকল কঠিন বাধা পাড়ি দিয়ে ধূসর বর্ণের পদ্মা সেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কোটি বাঙালির গর্ব হয়ে। দেশের ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের গল্প বলবে পদ্মাসেতু। লেখার শুরুতেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছি- কিভাবে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটকদের ঢল নেমেছে।

কেবল ফসল ও মানুষ পারাপার নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর আলাপ হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু পাল্টে দেবে দেশের আরেকটি খাতকেও। জিডিপিতে ১৪ শতাংশ ভূমিকা রাখা সেই খাতটি হলো পর্যটন। এই খাতের অপার সম্ভাবনার সোপান আমাদের পদ্মা সেতু। এটি শক্ত অবস্থান রাখবে বলে আমি মনে করি।

পদ্মাপাড়ে ইতিমধ্যে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, তাঁতপল্লী, জাদুঘরসহ আরও কত কি গড়ে উঠছে, উঠবে। পর্যটকরাও যাচ্ছেন। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন শিল্পকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ওপর ভিত্তি করেই এ শিল্পের সফলতা আসবে৷

আমার মতে, ওখানে হতে পারে আন্তর্জাতিক মানের সব পাঁচতারকা হোটেলসহ বিনোদনকেন্দ্র। কেননা দেশের বাইরে বিদেশি পর্যটকদের জন্যও এখন থেকে পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। যেমন ধরা যাক, আন্তর্জাতিক মানের একটি বিনোদন কেন্দ্র কনকর্ড গ্রুপের ফ্যান্টাসি কিংডম ও চট্টগ্রামের ফয়েজ লেইক। এই দুই জায়গায় যেমন আন্তর্জাতিক ও দেশিয় পর্যটকদের জন্য থাকার জায়গা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিনোদনেরও সকল সুবিধা। এখন পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে যদি এমন ধরনের বিনোদন কেন্দ্র করা যায়, তাহলে একই সঙ্গে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে ইকো-টুরিজমও বাড়বে। বাড়বে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব জেলায় পর্যটকদের আনাগোনা।

এতোদিন দক্ষিণ ও পশ্চিমের জেলাগুলোয় নিছক ভগ্নস্তুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সেগুলো পর্যটকদের আনাগোনার আবার ফিরে পাবে প্রাণ। এসব জেলার মানুষের জন্য তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান।

স্বাধীনতা পরবর্তী নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর নাক সিটকানো ভাব ছিল। ভুখা-নাঙ্গা এই দেশের মানুষের অর্থনীতির সূচক ছিল শূন্যের কোঠায়। বন্যা, খরা আর জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশ।

বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আমরা আজ অর্থনীতিতে 'এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার'। বাঘের মতো গর্জে উঠছে আমাদের অর্থনীতি, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশকেও টেক্কা দিয়ে।

তবে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এখনো পর্যটন খাতটিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো তেমন সুবিধা করতে পারছি না আমরা। অথচ একজন পর্যটক বা পরিব্রাজকের জন্য টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত মনকাড়া দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই।

পদ্মা সেতু সেই পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ৷ পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা বা অন্তরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা। পদ্মা সেতুর কারণে, যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে, তাই এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পর্যটন শিল্পকে তাদের ব্যবসায়িক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। এশিয়ার অন্যতম 'টুরিস্ট প্যারাডাইজ' হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার বড় হাতছানি নিয়ে দাঁড়িয়ে এখন পদ্মা সেতু।

আমাদের দেশের পর্যটন শিল্প এখনো প্রকৃতি নির্ভর। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলে ভরপুর পর্যটনকেন্দ্রগুলো থেকে পরিকল্পনার অভাবে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার৷ বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেট আর রাঙামাটিকে পর্যটকেরা যেভাবে 'ডেসটিনেশন গোল' হিসেবে মনে করেন, সেভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানকে আমরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অভাবে এতোদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকৃষ্ট করতে পারিনি৷

ভারতের যেমন আছে পর্যটন সিটি 'গোয়া', আমরাও পারি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা পটুয়াখালিকে দক্ষিণের পর্যটন শহর বানাতে। এক পর্যটন খাত থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণের মানুষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য বদল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে পদ্মা সেতুর বদৌলতে৷ এজন্য দরকার, এ শিল্পের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি ও দুরদর্শী মহা-পরিকল্পনা। তাহলে দেশের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন ৩০ শতাংশে উন্নীত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান, এই তিন 'প' এর সমস্বয়ে স্থাপনা নির্ভর পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার কিংবা লন্ডনের থেমস নদীর স্থাপনা দেখতে যাওয়া একজন পর্যটকের মূল 'ডেস্টিনেশন' থাকে। আমাদের পদ্মা সেতুকেও সেই জায়গায় নিতে হবে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র আঁকছে পদ্মা সেতু। একে আরও ব্র্যান্ডিং করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। আসবে রপ্তানি বাণিজ্যের সুযোগও।

যে দেশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মতো বিশ্ব ঐতিহ্য আছে, নকশিকাঁথা আছে, যেদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে, যেদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আছে সেদেশে পর্যটন বিকাশ অবধারিত। দরকার ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি। যা ইতিমধ্যে হচ্ছে। আরও হবে।

শোনা যাচ্ছে, পদ্মাসেতু 'ট্রান্স এশিয়ান এক্সপ্রেস হাইওয়ে রুটে'র সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এটি তখন ভারত, চীন, ইরান হয়ে ইউরোপের গন্তব্য হবে। ট্রেনে করে ইউরোপের যাত্রীরা নামবে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মাসেতু দেখতে। এটি হলে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের এক বিশাল গেইটওয়ে হতে যাচ্ছে পদ্মাসেতু ।

ভারি শিল্প, প্রবাসীদের রেমিটেন্স বা তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে এক কাতারে পর্যটন শিল্পকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির দুর্বার গতি দেখতে চাইলে এখনই এর একটি মেগাপ্লান দরকার।

ভৌতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরিও একটি 'কি-ফ্যাক্টর' বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর মধ্যে দেশের এক হাজার ১০০ স্পট নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার স্থাপত্য ও অবকাঠামোগত পরিবর্তনে বিনিয়োগ পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনার পর্যটন স্পটগুলো অগ্রাধিকার পাবে।

যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটে তাহলে পর্যটন শিল্পের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ সুপ্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বা দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফাকে পর্যটকরা দেখতে যেভাবে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে পদ্মা সেতুকেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং করে পর্যটক টানা সম্ভব।

দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুধু পর্যটন সুবিধা বাড়িয়ে যেমন তার পর্যটনশিল্পকে অন্যতম প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির খাত হিসেবে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে গেছে, ঠিক তেমনি আমাদেরও সেই অবস্থানে আসার সময় এসেছে ৷ দরকার সঠিক সুপরিকল্পনা, বৃহদাকারে পর্যটন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়।

বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি যাতে বৈশ্বিক ও আভ্যস্তরীণ পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় কোন বৈশ্বিক মন্দা দেখা না দিলে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তেজিহারে বাড়তে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ভবিষ্যত বাংলাদেশকে পদ্মাসেতুর মতোই বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।