রঙিন সম্ভাবনার উন্নয়নে সাধারণ জনগণ

এম আর খায়রুল উমামএম আর খায়রুল উমাম
Published : 9 July 2022, 10:38 AM
Updated : 9 July 2022, 10:38 AM

"একটা শ্রেণি আছে তারা কখনো আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে জানে না। তারা আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়েই আত্মতুষ্টি পায়। আর সেই শ্রেণিটা এখনো রয়ে গেছে আমাদের সমাজে। সেই জন্য যতই আমরা উন্নতি করি,  যতই এগিয়ে যাচ্ছি, সারা বিশ্ব যখন সেই উন্নয়ন দেখে আমাদের দেশের কিছু লোক কিন্তু সব সময় অন্ধই থাকে। তারা দেখেও দেখে না। এই অর্জনের কথা বলতে গেলেও যেন তাদের দ্বিধা। কিন্তু কেন তাদের ভেতরে এই ধরনের মানসিকতা সেটাই আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে এবং আমার নিজের কাছে প্রশ্ন যে এরা কেন?"

প্রধানমন্ত্রী ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনা সভায় এ কথা বলেন। মাতৃভাষার সাথে মাতৃভূমির প্রতি হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতি থেকেই প্রধানমন্ত্রীর এ আক্ষেপ। অথচ আমাদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্র মানুষের শত ভালো কাজের মধ্যে একটা ভুলকে প্রাধান্য দেওয়ার সংস্কৃতি সৃষ্টির চলমান ধারার চরম বিকাশ ঘটেছে। যতদিন যাচ্ছে ততই এই ধারার শক্ত অবস্থান লক্ষ্যণীয়। এ ধারা মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলেছে। পরমতসহিষ্ণুতা শুন্যের কোটায়।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে যে বিভক্তির সমাজ গঠন করা হয়েছে তার ফল তো আমাদের ভোগ করতেই হবে। রাজনৈতিক মতভেদ থাকবে, স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত থাকবে, ব্যক্তি স্বার্থপূরণের প্রতিযোগিতা থাকবে তাই বলে দেশ ও মানব প্রেম থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের ঐক্য থাকবে না। মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শে চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ায় ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলার সব ক্ষমতা যেন হারিয়ে বসেছে। ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের দার্শনিরাও এই আবর্তের বাইরে নিজেদের রাখতে পারেননি। দেশ স্পষ্টত বহুধা বিভক্ত। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষগুলো দেশে চলমান সকল কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের কল্যাণ, দেশের উন্নয়ন দেখতে পায় আর ক্ষমতার বাইরে থাকা একটা শ্রেণি সবকিছুর মধ্যে অকল্যাণ দেখে, দেশ বিক্রি দেখে, দুর্নীতি দেখে, সন্ত্রাস দেখে। আর দুপক্ষের টানাটানিতে পড়ে সাধারণ মানুষ নির্জীব হয়ে শুধু একবার একে দেখে তো অন্যবার ওকে দেখে। ভাবে দীর্ঘ পরাধীনতার পর স্বজাতির শাসনে তার অবস্থান কোথায়?

আজকের দিনে একজন মানুষ যখন এক কেজি তেলের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর শোনে আজ আর তেল পাওয়া যাবে না, আগামীকাল সকালে তাকে আবার আসতে হবে তখন সকল উন্নয়নই মূল্যহীন হয়ে যায়। মানুষটি যে আগামী কাল তেল পাবে তার কোনও ভরসা কেউ দিতে পারে না। ট্রাক থেকে যে পণ্য পাওয়া যায় তা ক্রয়ের অর্থ যেমন এদের কাছে থাকে না, তেমনি পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থানও নেই। তদুপরি কিছু স্বচ্ছল ব্যক্তিও এ সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। আর দুর্নীতির কথাতো নাই বা বিবেচনায় আনলাম। মোট কথা যাদের সহায়তা করার জন্য এ কার্যক্রম তাদের ভাগ্যে তা জোটে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ঠিক যেমন সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অবস্থা। দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকুরে, দোতলা পাকা বাড়ির মালিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নেতাদের পরিবার বর্গ, এলাকার বাইরের ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। এলাকার অক্ষম মানুষরা যখন নিজের নাম নিরাপত্তা বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যায় তখন বার্ষিক প্রাপ্তির অর্ধেকটাই স্পিড মানি হিসেবে দেবার রীতির কথাও পত্রিকায় দেখা যায়। দল বিবেচনায় নেতাদের কোটার কথা না নয় নাই বা বিবেচনায় আনলাম। তবে এই বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষেরা কোনো প্রতিবাদ করে না, আন্দোলন করে না, কোনো সংগ্রামেও অংশ গ্রহণ করে না। তবে সন্ত্রাসীদের ভয়ে, অর্থের বিনিময়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মাঠেই আবার তাদেরকে দেখা যায়। যদিও তার মধ্যে কোনো সক্রিয়তা নেই। এটা ক্ষমতার বাইরে ও ভিতরে থাকা প্রত্যেক মানুষই জানে।

দেশে এখন প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে যার মধ্যে আবার একাধিক মেগা প্রকল্পের ছড়াছড়ি। এসব প্রকল্পের সাথে সাধারণ মানুষকে কতটা সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পদ্মা সেতু শেষের পথে এখনই দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর কথা শোনা যাচ্ছে। দৌলতদিয়ায় দ্বিতীয় সেতু। একটা সেতু নদীর জন্য কতটা ক্ষতিকর তা জানার বা দেখার ন্যূনতম কোনো প্রয়োজনও কারো নেই। কিছু মানুষের উপকার হবে তাই সেতু তৈরি করতে হবে? আজ পদ্মায় রেল সেতু হবে, যমুনায় রেল সেতু হবে। অথচ সাধারণ মানুষ সেতু তৈরির প্রারম্ভেই পদ্মা ও যমুনা সেতুতে রেল সংযোগ করে তাকে বহুমুখী করার দাবী জানিয়েছিল। সমসাময়িক দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে সে সময়ের মানুষের উত্থাপিত দাবী এবং দাবীর বিপরীতে কর্তৃপক্ষ কি জানিয়েছিল সে বক্তব্য।  কিন্তু না, অনক্ষর-অনাহারী মানুষের কথা শুনলে কি উন্নয়ন সম্ভব? এখন নতুন করে রেল লাইন নির্মাণে আবার মেগা প্রকল্প হবে। বিশ্ববাসীকে আবার দেখিয়ে দেওয়া হবে আমরাও পারি। এক একটা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প ব্যয় ৩৫ হাজার কোটি টাকার কথা শোনা গেলেও তা শেষ করতে মোটামুটি তিনগুণ অর্থ ব্যয় সারাবিশ্বকে হতবাক করে দেবে। তাই বলাই যায়, মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন যতটা না জনকল্যাণের তার কয়েকগুণ বেশি মানুষকে দেখানোর জন্য। সে কারণে শরীয়তপুরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করতে হবে, নোয়াখালীতে বিমানবন্দর হবে, দ্বিতীয় পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে ইত্যাদি আরো কত আয়োজন! আগামীতে এমন প্রকল্পের উন্নয়ন দেশবাসীকে দেখতে হবে। এসব প্রকল্প জাতীয় প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় কিনা তা বিচার সাপেক্ষ।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সরকারগুলো জনগণকে সুখ দিতে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ৫০ জন লোক রাস্তার পাশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে 'দিতে হবে', 'দিতে হবে' বলে আর সরকারের তো দুহাত তোলাই আছে, সে সময়ে তাদের শুধু বলতে হবে- যাও দিয়ে দিলাম। কেন দিলাম, কী করতে দিলাম, কোথায় দিলাম, কত দিলাম তার লাভ-লোকসানের হিসেব পর্যন্ত করার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। ভাবখানা এমন, জনগণের কাছে থেকে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি তাই জনগণ যা চায় তা দিতে কুণ্ঠা কিসের?

একসময়ে জনকল্যাণে রাজধানীতে ১০টা স্কুল করার প্রকল্প হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়েছে, দপ্তর হয়েছে, জনবল হয়েছে, বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছে এবং তার ব্যয় চলমান।  প্রকল্পের জন্য সবকিছু হয়েছে এবং হচ্ছে শুধু হয়নি স্কুলগুলো। প্রতিদিন একনেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয় তার মধ্যে কত শতাংশ স্কুলের মতো এমন প্রকল্প- তা গবেষণার বিষয়। আবার একটা মেডিকেল কলেজ করলে ৫০০ বেডের হাসপাতাল করার নীতি ও রীতি থাকলেও একযুগের আন্দোলন সংগ্রামেও যশোরে তা আলোর মুখ দেখে নি। এমনকি পুরানো সদর হাসপাতালের একটা অংশ পরিত্যক্ত হলেও ৫/৭ বছরে তার সমাধান পাওয়া যায় না।

গত প্রায় ৪০ বছর সময় ধরে দেশের মানুষ নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করছে। একদিকে সাধারণ জনগণ বহতা নদীর জন্য আন্দোলন করে আর অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নদী সংস্কার করে। বিপরীতমুখী লক্ষ্যের কারণে নদী সংস্কার জনকল্যাণে কোনো ভূমিকা রাখতে পুরাপুরি ব্যর্থ। ফলে একদিকে নদী সংস্কারের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কার থেকেও নেই, তেমন এর দখল-দূষণও থেমে নেই।

হাত তোলা প্রকল্পের সুখ্যাতি করার জন্য হাত তোলার লোকেরও অভাব নেই। সারাদেশে দুহাত তুলে তারা নৃত্য করে চলেছে। সাধারণ জনগণের চাওয়ার বিপরীতমুখী প্রকল্প হলেও হাত তোলদের নৃত্যে কোনো সমস্যা হয় না। কাজ হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে আর কি চাই! এতে সংশ্লিষ্ট সবাই বেজায় খুশি। এসব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আবার কিছু মানুষ আছে, যারা আশা করে আমরাও এদের মতো আনন্দ পেতে পারি। সুখ পেতে পারি, উন্নয়নের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি। বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপের অংশ এরাই, কোনোভাবেই দেশের সাধারণ জনগণ নয়। তাই শিল-নোড়ার যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে পিষে ফেলার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ একান্তভাবেই মসনদ প্রত্যাশীদের প্রতি। মসনদপ্রত্যাশীদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে বলে সাধারণ জনগণ দেখতে পায় না। পরমতসহিষ্ণুতার অভাবই আজকের বিপরীতমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ যেন – 'যা কিছু হারায় যেন কেষ্টা বেটাই চোর' -পরিস্থিতি

প্রায় ৪০/৪৫ বছর আগে এক সংগঠনের দপ্তরে পড়েছিলাম 'সদস্যরা কী চায় তা নয়, সদস্যদের কলাণের জন্য কী প্রয়োজন তাই বিবেচ্য হওয়া দরকার'। আজ হুবহু কথাটা মনে না করতে পারলেও বিষয়বস্তুটা নিশ্চিতভাবে এমনই ছিল। আজ মনে হয় দীর্ঘ পরাধীনতাই আমাদের নেতাদের এমন ভাবনা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। জনকল্যাণে জনগণের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা থেকে সংশ্লিষ্টরা এক চুলও সরে আসেনি। ফলে জনকল্যাণের কথা জনগণ বলতে পারছে না। সরকার এবং তাদের কিছু সহযোগী প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক দায়িত্ববান এমন কিছু কথা বলছেন যা পরিস্থিতিকে সহায়ক করায় পরিবর্তে অসহনীয় করে তুলেছে। বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে। দেশের বর্তমান রাজনীতি যে সংঘাতপূর্ণ-বিদ্বেষপূর্ণ তাতে সুযোগের সদ্ব্যবহার আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। আন্তরিকতার সাথে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সহানুভূতিশীল বাণীই একমাত্র পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের রক্তে এ ধারা বোধকরি অনুপস্থিত। তাই আক্ষেপ চলমান থাকলে সাধারণ মানুষ আশ্চর্য হবে না।

দেশের সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান হিসেবে একা জনগণের আস্থাভাজন। কিন্তু উনার পারিষদদের প্রতি জনগণের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ জনগণ দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি দেখছে, কিন্তু যথাযথভাবে উপভোগ করতে পারছে বলে মনে হয় না। তাই সাধারণ জনগণের বিনীত অনুরোধ, তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী যদি তাদের পক্ষ থেকে পরিষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসা করেন যে তারা কেউ বাংলাদেশকে প্যারিস, লস অ্যাঞ্জেলস দেখে, কেউ বাংলাদেশের অর্থনীতি কানাডার সমান দেখে, কেউ মার্কিনিদের ভোট গণনা শেখাতে চায়, তাহলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে অসহায় দরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য যে টিসিবির পণ্য বিক্রি চলছে সেখানে এত মানুষের ভিড় কেন হচ্ছে? সাধারণ জনগণ আজ শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যে নয়, রাজনীতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের মধ্যেও বসবাস করছে।