Published : 24 Jun 2022, 07:49 PM
নদীকে যথাসম্ভব বহমান রেখে, তার উপর দিয়ে বয়ে যাবার পন্থায়, পদ্মা-সেতু চালু হতে যাচ্ছে। পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা, যা সমস্ত কীর্তি নাশ করে করে এসেছে। এই সর্বনাশা নদীটির অপ্রতিহত-বিনাশী-ক্ষমতার একদিক হচ্ছে নদী-ভাঙন, যা মর্মচ্ছেদি কষ্ট ও দুকূলব্যাপী শঙ্কা। ফি বছর বর্ষা-মৌসুমের শেষে, পানি কমতে শুরু হলেই এই 'নিদয়া' ঝুপ্ ঝাপ্ করে তীর ভাঙার মচ্ছব চালায়: ঘর-গেরস্থলি, হাড়ি -কুড়ি, গাছ, পাখি, কবর, বিবর… এক কথায়, সঞ্চিত-অতীত ও সংগৃহীত-বর্তমান গিলে খেয়ে, উদোম-ভবিষ্যতের সামনে দাড় করিয়ে, হালার-পো-হালা, ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপুর বাজিয়ে… গিলে চলছে, ঢেঁকুর তুলছে….। এই বদ্দার এক ক্যাডার আছে ভাটিতে, যার নাম আড়িয়াল খাঁ, এই খাঁয়ের-পো, উৎরাইল এলাকার এমন সুন্দর এক মসজিদ গিলে খেয়েছে, যা দেখে মনে হয়েছিল, সুমুন্ধির পো-র কলিজা আসলে হাঁটুতে, তা না হলে বায়তুল্লাহ্ গিলে ফেলার সাহস কোথায় পায়? ভাটির এ সমস্ত তাণ্ডবের সাথে উজানের হিমালয়ের যোগ আছে যা আন্তঃদেশীয় বিষয়: অনেক কূট-ক্যাচাল ও অনেক কৃৎ-কৌশলের ব্যাপার। কিন্তু এই যে ইনি, যিনি পদ্মা নাম নিয়ে চাঁপাই দিয়ে ঢুকে, দু'এক ফালি ফজলি আম খেয়ে, পড়িমরি সমুদ্রের দিকে ছুটতে যেয়ে, আ-সমুদ্র তাণ্ডব ঘটিয়ে চলেন, তার জন্য কিঞ্চিৎ শাসন আবশ্যক। নদী-শাসন শব্দটা যদিও অসংবেদী, কিন্তু অজাগরী-হা অথবা কুম্ভীরী-ল্যাজ এর ঝাপটা দিয়ে, নৌকা-লঞ্চ ডুবিয়ে 'অমৃতস্য পুত্রাহ্' কে গিলে ফেলার যে ধৃষ্টতা তিনি দেখিয়ে চলেছেন, তা নেহায়েত শাস্তিযোগ্য। যুগের পর যুগ, ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মর্দ গিলে গিলে তার পেট ফেঁপে উঠেছে, যা মূর্ত হয়ে আছে পদ্মা-ব্রিজের 'উত্তল' নকশায়। এই উদ্বেলতার গভীরে যেতেই হয়তো ব্রিজ-এলাকায় কিছু অচেনা, আউলা-বাউলা,অপ্রকৃতস্থ মানুষ দেখা যায়, যারা ব্রিজের দু'প্রান্তের রেলিং বেয়ে নীচের উজান-ভাটির প্রতি ইঞ্চি তলদেশ খুঁটিয়ে ও খুড়িয়ে দেখতে চান: কোথায়? কোথায়, রুপার বিছা, দুধের ফিডার, টিনের তোরঙ্গ, জ্বাল-দেয়া-আঁখ-রস এর কলস অথবা কুমড়ো ফুল? কোনও কিছুরই হদিস না পেয়ে, হাহাকার করে উঠেন:
'এইখানে মোর বাপজি ঘুমায়ে, ওইখানে তোর মা…
গনিয়া গনিয়া ভুল করে গুনি, সারা দিনমান ভরি…'
এ গনন অফুরান… যার কাছে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার কোটি কোনও সংখ্যাই নয়। আমাদের কীর্তিমানরা তছরুপ করে যে টাকা ঘাপাচ্ছে তাতে ত্রিশ-চল্লিশ কোনও টাকা? এমনতর ব্রিজ এই সমস্ত ক্ষমতাবানরা গণ্ডায় গণ্ডায় করতে পারেন এবং উনাদের মধ্যে একজন তো 'শমশের' ঘুড়িয়ে এগিয়েও গিয়েছিলেন, পরে 'মুসা'র মত নেমে এসেছেন। সীমিত সময়ের জন্য ও সীমিত মালিকানায় এই সমস্ত দেশীয় Zaibatsu দিয়ে যমুনা'র উপর দ্বিতীয়-সেতু করিয়ে নিতে আসুবিধা কোথায়? তা না হলে, এদের টাকাপয়সা তো কানাডা-মানাডা পেয়ে যাবে। PPP নিয়ে কত্ত পিঁউ কাহাঁ, পিঁউ কাহাঁ চলে, ছ্যাঁচড়ামি ঢলে কিন্তু হা-রে-রে-রে গলে না।কোনও বড় প্রকল্পে PPP নেই, কারণ Private যে অনেক বড় হয়েছে Public তা বুঝলেও স্বীকৃতি দিতে চায় না, যদিও Partnership তুতো-ভাই পর্যায়ে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের এই অস্বীকৃতি, অস্বীকার, অবজ্ঞা,আনাদর ও অপমান আমাদের বহমান কূসংস্কৃতি যা চেতনে সয়ে যেতে যেতে এবং চর্চা করতে করতে, অবচেতনেও স্বীকরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে, সমস্ত কিছু থেকে আস্থা-বিশ্বাস-আগ্রহ সরিয়ে নেবার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি কিন্তু অভ্যাসটি এতই বিধ্বংসী যে, ব্যক্তি একসময় নিজেই-নিজের-উপর-আস্থা-হারানোর যুক্তিও খুঁজে পেতে পারেন! নিজের-থেকে-নিজেকে-বিচ্ছিন্ন করানোতেই অবশ্য বিদ্যমান বাজার-সংস্কৃতির কেরামতি: মোবাইল ফোন গণ্ডিবদ্ধ করেছে, ধর্মান্ধতা ছিন্ন করছে, করোনা বিচ্ছিন্ন রেখেছে, মাস্ক আড়াল করছে, শ্রোতা থেকে বক্তা বিচ্ছিন্ন, বক্তা থেকে শ্রোতা, পাঠক থেকে লেখক, লেখক থেকে পাঠক, তুমি থেকে আমি এবং আমি থেকে তুমি! এই ক্রমবিস্তারি-বিচ্ছিন্নতায় এতটুকু দেশের মধ্যে এত্তগুলি লোক, থাকার জায়গাটা পাবে কোথায়? প্রত্যেকের জন্য একটা একটা রাজত্ব গড়ে দেয়া যেহেতু সম্ভব না, তাই এই 'প্রজাতন্ত্রে' সব্বাইকে নিয়েই সব্বাইকে থাকতে হবে, তাই না?
চারপাশের স্রোতকে ঘূর্ণায়মান রেখে, স্রোতের সাথে কত মাটি ধুয়ে যায় ও যেতে পারে, পানির নীচের ঠাই কতটা শক্ত, সর্বোচ্চ কি পরিমাণ পানি এখান দিয়ে প্রবাহিত হয় ও হতে পারে, পানির চাপ ও পানির তোড়, ইত্যাদি ভেবে, নীচের মাটিকে মুষলধারে দাবিয়ে, গোল-গোল লোহার-চোঙার ভেতর মসলা ঢেলে, কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরা ভিত্তির উপর যে পিলারগুলি এবং তার উপর যে ব্রিজটা অবশেষে শুয়ে পড়েছে, কারিগরি দিক থেকে সেটা একই সাথে নির্মাণ ও সৃষ্টি, কারণ, এই প্রমত্তা এক খতরনাক্ নদী, যার পাথুরে-ভিত্তি প্রায় ৮ কি.মি. নিচে: তদ্দুর অবশ্য নামা লাগছে না, নদীটির মতি ও গতি বোঝা সহজ নয়, ভূ-ভারতের তাবৎ পলি ও পানি বয়ে চলেছে এবং যার উপরের পানি থেকে নীচের মাটির গভীরতা ১৩ তলা! গভীর হলে অবশ্য গাম্ভীর্য থাকার কথা, কিন্তু এই ছল্টু শুধু পন্টুন ধাওয়ায়! ইয়াকে বাগে আনা ও বাগে রাখা পেরেশানি-কি-বাত্, যা টের পেয়েছেন সেইসব ডিজাইনার-ইঞ্জিনিয়ার যারা প্রায় নীরবেই সমস্ত কিছু করে গেছেন। তাদেরকে এবং সেইসাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদেরকে ধন্যবাদ। উল্লেখ্য, হার্ডিঞ্জ-ব্রিজ তৈরি করার সময় 'নদী-শাসন' অর্থাৎ নদীর-স্রোতকে ব্রিজের নিচ দিয়ে বইয়ে-যেতে সহায়তা ও বাধ্য করায় অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হয়েছিল।তারও অনেক পর, শাসিত-হয়ে যমুনা নদী ব্রিজের নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। শাসন তথা সুশাসন সব ক্ষেত্রেই দরকার এবং শাসিত হবার আগ্রহ না থাকলে, কিছুটা মানাতে হয় বৈ কি, 'যেমন সাপিনীকে পোষ মানায় ওঝা'!
দক্ষিণপশ্চিম ও দক্ষিণের উনিশটি জেলার মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে শুয়ে-থাকা-পদ্মা-ব্রিজ বেয়ে প্রবাহিত ও ব্রিজ দিয়ে প্রভাবিত হবেন। এক অর্থে এই জেলাগুলির মানুষ দেশের মূলস্রোত থেকে দূরে ছিলেন, এনারা পূব ও উত্তরে তাকালে অথবা হাঁকালেই, শোঁ শোঁ করে পদ্মা তেড়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াতো, তখন বাধ্য হয়েই দক্ষিণের দরিয়া আর পশ্চিমের মুখরা-দের মুখাপেক্ষী হতে হত, এখন সেতু দিয়ে বন্ধিত হবার পর, পদ্মাপারীরা তাদের মুখ ও দুর্মুখ ৩৬০° ঘোরাতে পারবেন। অন্যদিকে, পূব ও উত্তরের তানারাও মাওয়ায় ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ চা খেয়ে, হুস্ করে ও হুঁশ নিয়ে ছুটে যেয়ে, শুধু রাস্তা এবং রাস্তার-ভেতরের চক্কর দেখেই বেহুঁশপ্রায় হয়ে নিজেকে শুধাতে বাধিত হবেন:
'সত্যই এটা আমাদের দেশ'?
'আচ্ছা '৭১ না-হলে-কি এগুলি হতো'?
'উনি থাকলে কি আরও আগে হতো?'
এদ্দিন হয়নি, হয়নি। এখন হয়েছে> হওয়াতে হয়েছে> হওয়ালেই হয়। এই হওয়াগুলি থেকেই আরও অনেক কিছু হবে। দক্ষিণের ভাটিয়ালীর দুকুলপ্লাবি-উদাত্ততার সাথে উত্তরের ভাওয়াইয়ার চাপাপরা- হুতাশন যখন দ্বৈত স্বরে 'জাগো, জাগো, বাহে জাগো' গেয়ে উঠবে, তখন ফয়েজ-আহম্মদ-ফয়েজের ভাষায়: "সব তাজ উছালে জায়েগি…বিজলী ক্বর ক্বর গিরেগি… উঠেগা আনাল-হ্বক কি নাড়া, যো তুম্ ভি হো আওর ম্যায় ভি হু" অর্থাৎ 'আমিই সত্য'>প্রত্যেক 'আমি'ই সত্য, এই উপলব্ধি ক্রমে ক্রমে রটে যাবে কানে, মনে এবং রটে যেতে যেতেই 'বটে! হচ্ছেটা কি'? হচ্ছে কি তা প্রায় সবার কাছেই কমবেশি স্পষ্ট।এই স্পষ্টতা যখন আরও বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে, আরও বেশী ফক্ফকা হবে তখন দক্ষিণের কৈবর্ত যদি বিদ্রোহী হয় তবে টেঁটা ফুঁসে উঠবে, তেমনি উত্তরের নূরলদিন যমুনা ব্রিজের উপর উঠে 'হাঁকাও গাড়ী চিলমারি'।এই মইষাল এদ্দিন কানাহোলাগ্রস্থ হয়ে চর-এ ঘুরেছে এবং ঐ নাইয়া জলে খাবি খেয়েছে, এবার জলে ও মাটিতে চরণের বেগ….।
শুধু নদী, খাল, বিল পার হতে যেয়েই পদ্মাপারের মানুষের যে শ্রম ও সময় এদ্দিন ব্যয় করতে হয়েছে, আশঙ্কায় কুঞ্চিত থাকতে হয়েছে, আতঙ্কে সিঁটিয়ে যেতে হয়েছে, উদ্বেগে আবেগী হয়ে জপতে হয়েছে 'বদর' 'বদর'…'সামাল' 'সামাল'….. এ'সমস্ত বালাই অপনোদন-অবলোপন হয়ে তরতাজা ভাব নিয়ে পদ্মীরা ঢাকা শহরে নেমে লুঙ্গী কোঁচাতে কোঁচাতে পুছবে: 'হেইয়া মনু, কফির দোহানডা কোন্মুড়া'? এবং কাঁপা কাঁপা ঠোটে কফি'র গন্ধ নিয়ে 'হা হা হা পায় রে হাসি' দিয়ে অদৃষ্টের-লিখনকে ফাঁসি পরানোর নতুন ইচ্ছা জাগবে, কেন্দ্র ভেদ করে অন্য প্রান্তে পৌঁছার যে ইচ্ছা, তা প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গিতে কুশলী হবে এবং ভয়-ত্রাস-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে 'আজন্ম সলজ্জ সাধ'গুলো মেটানোর জন্য, প্রয়োজনে, সমস্ত কিছু ফুঁৎকারে উড়িয়ে 'If blood is the price of independence, then Bangladesh has paid the highest price in history'।
তিনদিকে কাঁটাতারের বাঁধা, ভেতরে হাঁটাপথে বাঁধা, চলার পথ নিয়ে ধাঁধা, মাঝে কাঁদা এবং সারাদেশে গাদা গাদা হাঁদাদের গাধামি- এত্ত বাঁধা আর কাহাতক সওয়া যায়, বলুন? দু দুবার স্বাধীন হবার পরও বাঁধা যদি না-ই যায়, তবে ধরে নিতে হবে-
১. যেগুলোকে বাঁধা ভেবেছি অথবা ভাবছি, সেগুলি আসলে কোনও বাঁধাই নয়, অথবা ২. বন্ধন কখনো ছিন্ন করা যায় না।এতসবের পরও, পদ্মা-অর্পিত প্রাকৃতিক-বাঁধা যে পার হওয়া হচ্ছে, তাতে পুনর্বার মনে হওয়াই সঙ্গত 'the world is man's doing, not something done to him'!
'তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা' যদি হয়, তবে, মেঘনা ও যমুনা ইতিমধ্যাই পার হওয়া হয়েছে, পদ্মা বাকি ছিল, তা-ও হয়ে যাচ্ছে। এবার একটু 'ধীরে ধীরে চল ঘোড়া, সাথী বড় আন্কোরা, রূপনগরের পরী…'। আমাদের সাথী, সারথী, রথী, রথ, সব কিছুই এখনও বেশ আন্কোরা, যদিও চোখে 'রূপনগর' তথা 'রূপণারানের' স্বপ্ন! যে স্বপ্নের শুরু '৭১- এ, সেগুলো ৫০ বছরের মাথায় অন্তত ২৫গুণ বেড়েছে অথচ 'সুরা নাই পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী'। পাত্রে পাত্রে ক্রমশ সমউচ্চ- সুরা না ঢাললে, পাত্রই ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছা হবে, যে ধরনের ভাঙনে আমরা প্রকৃতিগত ভাবেই অভ্যস্ত।নদীগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের দুমড়িয়েছে-মুচড়িয়েছে, আমরা যুগের পর যুগ, ভারত ভেঙেছি,পাকিস্তান ভেঙেছি এবং বদ্বীপিয়-অস্তিত্ববাদের নির্যাসে গেয়েছি 'এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা'। পদ্মা-নদীর তুলনায় উপরের ব্রিজ এখনও তেমন পোক্ত হয় নি, তেমনি ব্রিজের উপর দিয়ে যা এবং যারা যাবেন, সাবলীলভাবে এগিয়ে যেতে তাদেরও সময় লাগবে অথচ চোখে খোয়াব ২৫গুণ। সেই স্বপ্নের খেয়া-বেয়ে অথবা খোয়াবের ব্যাখ্যা দিয়ে, যে অথবা যারা এগিয়ে আসবেন তারাই বাধিত করবেন। অনেককিছুর মধ্যে, এ বদ্বীপ যে 'বুলঘখানা' তা অন্তত 'আক্লমন্দ' দের অনেক দিন স্মরণে রাখাই উচিৎ হবে।
জাতি হিসেবে বিষমানুপাতিক যে স্বপ্ন আমরা দেখে চলেছি, এগুলো পূরণের জন্য সময় দেয়ার সময় আমাদের নেই, কিন্তু কিছু সময় তো দিতেই হবে, দিতে হয়ই, তাই একটু ধীরে চলার কথা ভাবা সঙ্গত হবে এবং মধ্যবর্তী সময়ে, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-অনাচারগুলোকে খামোশ করার লক্ষ্যে, কতটা আইনের-শাসন চালু করা যায় এবং ততটা কিভাবেই বা প্রয়োগ করে, অভ্যস্ততায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। বাংলায় কথা আছে, 'সুখের চেয়ে স্বস্তি বড়' এবং এক লাইন আছে: 'এ-এলো-তো-ও-গেল, ও-এলো-তো-এ-গেল'। সুখের রেশ আমরা দেখতে পাচ্ছি বটে কিন্তু অস্বস্তিরও শেষ নেই। রাস্তা-ঘাট, ইশকুল-হাসপাতাল, মসজিদ-ময়দান, কারখানা-দাওয়াখানা, প্লেন-ট্রেন, তড়িৎ-বিদ্যুৎ, উড়াল-ভূতল ইত্যাদি বানিয়ে ও বাড়িয়ে মানুষের-প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমে এ দেশ আরও বেশি আত্তীকৃত হচ্ছে, ভালোলাগার কারণ সৃষ্টি হচ্ছে, তাই, মানুষকে যৌক্তিকভাবে আশাবাদী রেখে, সেই যুক্তির ভিত্তি স্থাপনের জন্য পাপাচার ও দুরাচারগুলিকে বিসর্জন দিতেই হবে। স্বস্তি তখনই বাড়বে যখন ছটফটানি কমে আসবে, অবশ্য পথে-বিপথে এই ছটফট মোটেও অস্বাভাবিক নয়। জীবনের রুটিন প্রয়োজনের বাইরে, নিত্য নতুন উপাচারের প্রতি নতুন নতুন আগ্রহীর অত্যাগ্রহে, ছটফট তো হবেই! জীবনের-স্বাদ পাবার অধিকার '৭১ দিয়েছে, ধন (resource) লাগে, মান (standard) থাকতে হয়। এই ধন-মান সম্পন্ন কেমন জীবন আমরা চাই তা স্পষ্ট নয়, সেটার কতটুকুই বা 'বাংলা-মা' জোগাতে পারবেন সেটাও বিবেচনায় নিতে আগ্রহী না। অন্যদিকে, জীবনের প্রতি অত্যুঙ্গ আগ্রহ সৃষ্টি করে চলেছে 'বাজার'। চাহিদার সাথে যোগান- এর অসামঞ্জস্যে, বাজারে রটে 'নাই, নাই' আবার, যোগান- এর সাথে চাহিদার অসামঞ্জস্যে বাজারে ঘটে 'খাই, খাই'। 'নাই'গুলোর মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন তুলনামূলকভাবে সহজ, যদিও ভারসাম্য বজায় রাখার সাথে সুশাসন এর সম্পর্ক, কিন্তু 'খাই'গুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন করা ও বজায় রাখা মোট্টেও সহজ নয়, এমনকি এক মাস সংযম-সাধনা করেও নয়। এই নাই-খাই এর দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের ফোঁকরে সবধরনের- বাজার নিরবিচ্ছিন্নভাবে এবং মাঝে মাঝে যে আচরণ করে থাকে, তা অকল্পনীয়। চুরি এক ধরনের অভ্যাস কিন্তু সিনাজুরি সম্পূর্ণ ভিন্ন।প্রথমটায় আমরা অভ্যস্ত কিন্তু দ্বিতীয়টা অসহ্য।
সিনাজুরি করেই 'অন্ধকারের খা খা সীমান্তে' পাকিস্তান ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু অনেক কারণেই আগুনমুখার 'চোখের ঝিলিকে' বার বার আমাদের জেগে উঠতেই হবে! যে উত্থানে ভৈরবী গেয়েছেন মরহুম অমর পাল:
"পদ্মা গাঙের মাঝিরে ভাই,
নাও বাইয়া কোন বিদেশেতে যাও?
ভাঁটি নাইয়া বন্ধুরে, মোর পানেতে চাও
…ও নাইয়ারে ভাঁটি ছাইড়া উজান আইসা যাও
তোমায় দিমু রাজকন্যা, থামাও মিঞা নাও…।"
পঞ্চাশ বছর আগে শরণার্থী হয়েছিলাম, তখন ভিক্ষাপাত্রও হাতে করে নিয়ে যেতে পারিনি। অর্ধ শতাব্দী পর, ভাঁটি ছাইড়া উজান আইসা যাওয়ার আমন্ত্রণ হাতে খঞ্জনী বাজিয়ে: 'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও'?
আমরা জানি যে, উজানের হিমালয় ভাটির সমুদ্র-জাত, কারণ সেই মান্ধাতার-দাদার-আমলে, দরিয়া একটু মুচড়া-মুচড়ি করেছিলেন, তাতেই আমাদের ভূমি ফুলে উঠে ৩০ হাজার ফিট উচ্চতার 'হিমালয়'। মানচিত্র দেখুন, ভারত মহাসাগর হঠাৎ করে তার জলরাশি ঠেলে দিয়ে উপসাগর হয়ে গেল। কেন এই 'উপ'দ্রবণ তথা জল? কারণ স্থল ছিল না যে! স্থল তবে গেল কোথায়? ওই যে ফেঁপে উঠলো! ফেঁপে উঠা ওটাই তো মশায়, হিমালয়! ওটাকে দাবিয়ে ফ্লাট করে শুইয়ে দিলেই, ৫৬ হাজার বর্গ-মাইল হবে ৩৫৬! নিছক হাস্যকর কথা হোলেও necessity knows no bound! গপপে্ও ইংগিত আছে।গপ্পোটা শুনুন:
মি. হিলারি ও শ্রীমান নোরগে এভারেস্টে উঠার পর দেখেন, এক লোক কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে আছেন।
প্রশ্ন: What a surprise! What are you doing here?
উত্তর: 'বাই গেলে ছাইরোমুইর তুন সাছি হালাই ন্যাস্ করি দি আর কমি গেলে এমুই অমুইর তুন বরফ এগুণ কুদ্দুরি তোয়াই আনি ওস্ করি দি' অর্থাৎ বরফ-জমে উচ্চতা যদি ত্রিশ হাজার ফিট থেকে বেড়ে যায়, তখন বরফ-চেঁছে উচ্চতা ত্রিশ হাজার ফিটে নামিয়ে আনি, আবার বরফ-গলে উচ্চতা যদি কমে যায় তবে আশপাশ থেকে বরফ-নিয়ে ত্রিশ হাজার ফিট গড়ে দেই! কাঁথামোড়া এই ভূমিপুত্র, যিনি সাগর-মন্থনের সময় স্রোতের পলি'তে ভেসে হিমালয়ের-শৃঙ্গে থিতু হতে সক্ষম হয়েছিলেন, একান্ত নিষ্ঠার সাথে রাধানাথ শিকদারের মাপ আজও রক্ষা করে চলেছেন– একটু বেশীও না, একটু কমও না! অথচ দেখুন, আমাদের এইসকল ভূমিপুত্র, ফেঁপে উঠা আমাদের সেই ভূমি এবং ফুলে উঠা আমাদের সেই পানি, আজও "আমি অপার হয়ে বসে আছি…পারে লয়ে যাও আমায়" বলে কেঁদে ফিরছে! হইলো কিছু?
পৌরাণিক কাহিনীতেও শুনবেন প্রতি বছর মা-দুর্গা হাওয়ায় ভেসে উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণে তার পিতৃগৃহে আসেন এবং কান্নায় ডুবে, ঘুরপথে পতিগৃহে ফেরত যান। আর কেন এই কষ্ট? কেন জল বেয়ে, বায়ু চেপে, হিমালয়? পদ্মা-মেঘনা অথবা মেঘনা-যমুনা যে কোনও রুট ধরে বেলাবেলি পৌঁছে যাবো 'হিমালয় থেকে সুন্দরবন' to & from, ৩৬ কোটি কাঁধে, ১৮ কোটি সন্তান উনাকে কৈলাসধামে নামিয়ে দেবো।'ফাটাই তো কল্কি, লাগাই তো ভেল্কি'! কী বলেন?
গপ্পে, গল্পে, কল্পে, প্রকল্পে, বিকল্পে- অতীতের ঔরসে ও বর্তমানের গর্ভে, ভূমিষ্টব্য যে ভবিষ্যত, তা নিরন্তর 'কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে'। এই উচ্ছ্বসিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নিজ খেয়ালে বয়ে চলছিল, এখন সুশাসিত। 'অনাদিকালের স্রোতে' আমরা অর্থাৎ নিম্ন-গাঙ্গেয়রা সয়ে যাচ্ছিলাম, এখন স্বশাসিত। অতি সম্প্রতি স্বয়ংক্রিয় হয়ে, জিডিপি বাড়িয়ে, দু-একটা ছক্কা হেঁকে, 'জাগুয়ার' চেপে আগুয়ান হয়ে, ৪২ পিলারের ব্রিজ গেঁথে, আগামীর 'ছবি লেখছি'। 'কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি'?
জী তে রাহো!