ধর্মেই পরিত্রাণ, ধর্মান্ধতায় বিনাশ

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 9 May 2022, 01:11 PM
Updated : 9 May 2022, 01:11 PM

ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার ইবনে বতুতার বরাত দিয়ে চৌদ্দ শ শতাব্দীর বাংলাদেশ (ও ভারতীয় উপমহাদেশের) হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বলেন, "হিন্দুরা মুসলমানদের অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছ, যবন বলে ঘৃণা করতো … গৃহের অভ্যন্তরে তাদের প্রবেশ করতে দিতো না, তাদের স্পৃষ্ট কোনও জিনিস ব্যবহার করতো না … শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে হিন্দুরা যেমন নিজেদের আচরণ সমর্থন করতো, মুসলমানরাও তেমনি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংসের কাজ সমর্থন করত। বস্তুত উভয় পক্ষের আচরণের মূল কারণ একই যুক্তি ও বিচার নিরপেক্ষ ধর্মান্ধতা …" (রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ)।

চলমান বছরের পঞ্চম মাস এটি। গত ৪ মাসে বাংলাদেশ ও ভারতে ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ভয়ংকর ঘটনা, যার কেন্দ্রে আছে ধর্মান্ধতা– শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার ওপর যার রয়েছে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক অভিঘাত। ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মাণ্ড্য প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, হিজাব পরিহিত কলেজ ছাত্রী মুসকানের দিকে তেড়ে যাচ্ছে গেরুয়া উত্তরীয় পরিহিত একদল যুবক, সঙ্গে 'জয় শ্রী রাম' ধ্বনি। মুসকান কলেজে একটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে যাচ্ছিলেন। তিনি বোরকা পরে ছিলেন বিধায় কয়েকজন যুবক তাকে কলেজে প্রবেশ করতে দিচ্ছিলেন না। ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে গেরুয়া শাল গায়ে জড়ানো যুবকেরা একদিকে আর অন্যদিকে কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে এক মহিলা 'আল্লা-হু-আকবর' ধ্বনিতে সরব। উল্লেখ্য যে, মুসকান তার কলেজের প্রিন্সিপাল ও অধ্যাপকদের সমর্থন পেয়েছিলেন।

হিজাব নিয়ে পরবর্তীতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক নেতা থেকে তারকা সকলেই। বলিউড তারকা কঙ্গনা রানাউত তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লেখেন, "… আফগানিস্তানে গিয়ে বোরকা না পরে ঘুরলে তবেই আপনি নিজের সাহস দেখাতে পারবেন। স্বাধীনভাবে থাকতে শিখুন, খাঁচায় নিজেকে বন্ধ করে রাখবেন না।" কঙ্গনার এ মন্তব্য পছন্দ হয়নি রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিনেত্রী শাবানা আজমীর। শাবানা তার অফিসিয়াল টুইটারে কঙ্গনার পোস্ট শেয়ার করে লিখলেন, "ভুল হলে আমাকে সংশোধন করুন, কিন্তু আফগানিস্তান একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং আমি শেষবার যা দেখেছি তাতে মনে হয় ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র? !!"

ফেব্রুয়ারি মাসের হিজাব বিতর্ক শেষ না হতেই বাংলাদেশের কয়েকটি জায়গায় বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ওই ঘটনাগুলোর কেন্দ্রেও ছিল ধর্মান্ধতা। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে নিয়ে। বিজ্ঞান পড়াবার জন্য এই শিক্ষককে কারাগারে যেতে হয়েছিল। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? মুন্সীগঞ্জের রামকুমার বিদ্যালয়ের ১০৩ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে যে ঘটনা ঘটেনি, বাংলাদেশ আমলে কেন এমন ঘটনা ঘটল? তাও আবার দেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিতে!

ঘটনার কয়েকদিন পরে গণমাধ্যম মারফৎ বিষয়টি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ জাতীয়, ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরু হয় নিন্দা। দেশের নানা জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কিছুটা বিলম্ব হলেও এ প্রতিক্রিয়াটিকে আমি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও প্রগতিশীল চেতনার ইতিবাচক শক্তি বলেই মনে করি। কিন্তু আমি শংকিত এই ভেবে যে, ধর্মকে কেন্দ্র করে কিছু হলেই সবাই গুটিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনার ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ কেউ বিচার করছেন না; ঘটনার যাথার্থ্য নির্ণয়ে কেউ ব্যবহার করছেন না যুক্তির নিক্তি, ও সাধারণ বিবেচনার মানদণ্ড।

সাংসদ, পুলিশ, আদালত কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না, নেননি। পুলিশ এজাহার লিখে দিয়েছে, আদালতে দু'দুবার হৃদয় মণ্ডলের জামিন নাকচ হয়েছে। পরে শক্তিশালী জনমত তৈরি হলে বিজ্ঞানের এই শিক্ষক কারগার থেকে মুক্তি পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা কেন দেওয়া হলো?– এর জবাব পেলাম না। দু' দশকের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞান পড়ানো একজন শিক্ষককে হেনস্থা ও শায়েস্তা (!) করার দুষ্টবুদ্ধি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে কীভাবে এলো, তার জবাব কী মিলেছে? তাহলে আমাদের মফস্বল ও গ্রামগঞ্জের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি বিজ্ঞানবৈরী ধর্মান্ধ চেতনা নিয়ে শিক্ষাজীবনের নানা স্তর অতিক্রম করছেন? দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীরা কি জানেন গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রিস্ট ও রাসুলুল্লাহ (সা.) কতটা উদার, আলোকিত, অন্তদৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন?

তারা কি জানেন, কোন ধরনের বৈরী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহুদি, খ্রিস্টান ও প্যাগানদের এক ও অদ্বিতীয় ইলাহ্-এর (এক ঈশ্বর) পথে দাওয়াত দিয়েছিলেন? আবার ওই রাসুলই (সাঃ) পরিস্থিতির প্রয়োজনে মদিনা নগর রাষ্ট্রে ইহুদি, পৌত্তলিক ও খ্রিস্টানদের ধর্মের স্বাধীনতার সুরক্ষা দিয়েছিলেন। ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে ইহুদিদের পয়গম্বর মুসা (আ.) ও খ্রিস্টানদের পয়গম্বর ঈসাকে (আ.) স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার বিদায় হজের ভাষণে নবীজী (সা.) সাবধান করে গিয়েছেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে।

মুশকিলটা হচ্ছে ধর্মের যে উদার, আলোকিত, মানবিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলো আছে, সেই শিক্ষাটা আমরা পরিবার, বিদ্যালয় ও ধর্মশালার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি না। ইউরোপে কয়েক শ বছর ধরে আলোকিত বুদ্ধিজীবী, গণতন্ত্র ‍ও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু সৈনিকেরা চার্চ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে একদিকে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন এবং সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মূলনীতি করেছেন সেক্যুলারিজমকে, যে ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের রাষ্ট্রেরও মূলনীতি।

চার্চের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষের মনোভাব হয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবান্ধব, মানবিক ও উদার। ফলে ধর্ম নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কিন্তু এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ধর্ম নিয়ে যে মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতা দেখা যায়, তার প্রধান কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব, যুক্তি ও উদার মানবিক বোধের অভাব এবং অতি অবশ্যই ধর্মগ্রন্থের সঠিক পঠন, তার মর্মবাণী উপলদ্ধি এবং বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির পরিবর্তিত জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পবিত্র গ্রন্থসমূহের 'প্রগ্রেসিভ ইন্টারপ্রিটেশন' বা যুগোপযোগী ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের অভাব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি, স্বামী বিবেকানন্দ, লালনসহ আমাদের শিক্ষাগুরুদের অনেকের মধ্যে ধর্মে বিশ্বাস যেমন ছিল, তেমনি ছিল গভীর আধ্যাত্মিক বোধ। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক বোধ তাদের সংকীর্ণ করেনি, কূপমণ্ডূকও করেনি। এরা সকলেই ছিলেন উদার, মানবিক, সৃজনশীল, আলোকিত ও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। আধ্যাত্মিক বোধ ও ঈশ্বর চিন্তা ছিল তাদের অনুপ্রেরণার উৎস। পৃথিবীর যুক্তিশীল ও আধ্যাত্মিক বোধসম্পন্ন মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন। ইবনে সিনা, আল কিন্দি, আল ফারাবি ও ওমর খৈয়ামরা গভীর আগ্রহ নিয়ে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন ও বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন, আবার কাব্য, সাহিত্য এবং সংগীতচর্চাও করেছেন।

একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় জেনেটিকস, ইনফরমেশন টেকনোলজি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ। বিভিন্ন দেশ এখন গ্রহ ও গ্রহান্তরে স্পেসশিপ পাঠাচ্ছে, মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজছে, মহাকাশে আবাসনের পরিকল্পনা করছে; আর আমাদের দেশের শিক্ষার্থী ও ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে! যুক্তিবোধসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবান যে কোনও মানুষই বুঝবেন ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক নয়, বরং পরিপূরক। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বলেছিলেন, "science without religion is lame, religion without science is blind", অর্থাৎ ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া এবং বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।

আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইবনে সিনা ও মাওলানা জালালুদ্দিন রুমিদের মতো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক বোধসম্পন্ন মানুষেরা যেভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন, যেভাবে ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞান চর্চা করেছেন, তার প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে যে, বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে ধর্ম অনিবার্য। কেননা, হোমো স্যাপিয়েন্সদের পৃথীবিতে আবির্ভাব; জীবন-মৃত্যুর রহস্য; ইহকাল-পরকালের সম্পর্ক ও পারলৌকিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা; 'সুপ্রিম ডিভাইন অথরিটি'র স্বরূপ অন্বেষণ ও উপলদ্ধি, মেটাফিজিক্যাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওহী প্রেরণ; এবং সর্বোপরি বিশুদ্ধ মানবিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ধর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের প্রজ্ঞা ও সজ্ঞাপ্রসূত শুভ ও সুন্দরের শিক্ষা ধর্মবিশ্বাসীদের করে তোলে মানবিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত। কিন্তু বিশ্বাসীরা যখন ধর্মান্ধ হন, ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ান, তখনই শুরু হয় বিভক্তি ও হানাহানি। ফলে জোরের সঙ্গেই উপসংহার টানা যেতে পারে যে, ধর্মেই পরিত্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধতায় বিনাশ।