ধর্মান্ধদের দৌরাত্ম্যে ক্ষত-বিক্ষত দেশের আত্মা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 April 2022, 12:35 PM
Updated : 7 April 2022, 12:35 PM

মানুষের মতো দেশেরও শরীর এবং আত্মা আছে। ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, শাসনব্যবস্থা হলো একটি দেশের শরীর। আর আত্মা হলো রাষ্ট্রীয় আদর্শ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা, সাংবিধানিক ঘোষণা ও অঙ্গীকার, দেশের মানুষের মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ, চেতনা, শিক্ষা, রুচি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানবিক অনুভূতি, সৃজনশীলতা, চিন্তাশীলতা ইত্যাদি। আমরা রাষ্ট্রের শরীর মোটামুটিভাবে ঠিক রাখতে পারলেও আত্মাকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমাদের দেশের আত্মা ক্ষতবিক্ষত। ধর্মান্ধতা ও ধর্মোন্মাদনা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, মানুষে মানুষে বিভেদ, বৈষম্য। দেশের এই ক্ষতবিক্ষত আত্মা সারানোর উদ্যোগ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। 

বর্তমানে আমাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেশে সবচেয়ে বেশি বাড়-বাড়ন্ত। এখানে একদল মানুষ ওৎ পেতে বসে থাকে কিসে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' লাগে, কে কোথায় ধর্মাচার লঙ্ঘন করছে, সেটা খুঁজে বের করার জন্য। যুক্তিবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে মানুষের মধ্যে সংকীর্ণ ধর্মীয় অনুশাসন মানা এবং মানানোর প্রবণতা সীমাহীন বাড়ছে। যারা কট্টর ধর্মীয় বিধান মেনে চলে না, তাদের উপর নেমে আসছে অপমান, নির্যাতন। নিজের মতো চলতে, স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে বা স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতেও মানুষ ভীত-শঙ্কিত, কারণ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। 

অন্যের মতো, আদর্শ, বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ যারা মানতে আগ্রহী নয়, তাদেরই অসহিষ্ণু বলি আমরা। এই অসহিষ্ণুতা ক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, শিক্ষিত ও নিরক্ষরের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। এখনও নারীর প্রতি পুরুষ অসহিষ্ণু। গরিবের প্রতি ধনী অসহিষ্ণু। এক ধর্মের লোক আর এক ধর্মের লোকদের প্রতি, এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ আর এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু। খুনখারাপি করলেই সে অসহিষ্ণু, তা না হলে নয়— তা তো নয়। যারা টিপ পরার 'অপরাধে' নারীকে অপমান করছে, বিজ্ঞান ও ধর্ম যে আলাদা, একটার ভিত্তি যুক্তি ও প্রমাণ, অন্যটির ভিত্তি বিশ্বাস, এই কথা বলাতে বিজ্ঞানের শিক্ষককে কাঠগড়ায় তুলছে, তারাও অসহিষ্ণু। শুধু অসহিষ্ণু নয়, তারা বর্বর, ধর্মান্ধ। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে কপালে টিপ পড়ে ছবি দিয়ে টিপবিরোধিতার প্রতিবাদ করছেন, কোনো কোনো পুরুষও সামিল হয়েছেন, এই প্রতিবাদে। প্রতিবাদের এ এক নতুন রূপ। যে যেভাবে প্রতিবাদ করতে পছন্দ করেন, সে ভাবে করছেন। একদল 'কিন্তুবাদী' যথারীতি প্রশ্ন তুলছেন, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করছেন না কেন, জমিতে সেচ দিতে না পারায় আদিবাসী দুই কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, কুয়েটের এক শিক্ষার্থী অভাবের কারণে গলায় দড়ি দিয়েছেন, এসব ঘটনার প্রতিবাদ না করে টিপের মতো 'ধর্মাচার বিরোধী' জিনিসের পক্ষে কেন?

হ্যাঁ, কেউ যদি অন্য সব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে টিপবিরোধিতার প্রতিবাদ করেন, তাহলেই বা আপত্তি কেন? সবাই সব বিষয়ে প্রতিবাদ করবে না। সব ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। কেউ যদি তা না করতে চায়, যদি কেউ মনে করে, নারীর অপমানের বিপক্ষেই কেবল তিনি দাঁড়াবে, তা হলে তার বিরুদ্ধে আমি যাব কেন, যদি আমি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি? নারীকে ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে মুড়ে ফেলার, খোলসের মধ্যে পুরে দেবার একটা প্রবণতা চলছে। পাশাপাশি নানা ছুতোনাতায় ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি এক ধরনের পীড়ন-অত্যাচার চালানো হচ্ছে। কেউ যদি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, ধর্মান্ধ তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়ে, তাহলে তার বিরুদ্ধে গালাগাল-ঠাট্টা-মশকরা, বিদ্বেষ-অপমান করা হবে কেন?

যারা এসব কথা বলে, তারা নিজেরা কখনও কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদী ভূমিকায় দাঁড়ায় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে, আত্মহত্যা নিয়ে, এমনকি সরকারের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা নিয়ে তারা টুঁ শব্দটি করে না। কিন্তু কোনো অনাচার বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখনই কোনো সামাজিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে, তখন এই 'কিন্তুবাদীরা' সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই শ্রেণিটি মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে, নারীর বিরুদ্ধে, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে এবং বিভ্রান্তি ছড়ায়। এরা হচ্ছে ধর্মান্ধগোষ্ঠীর 'তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী'। এদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার। 

দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। এ দেশে নারী-পুরুষের সমতা থাকুক, অন্যায়-অত্যাচার-দারিদ্র্য-বৈষম্য দূর হোক, ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার ঘুচে যাক, বাক্‌স্বাধীনতা মুক্তি পাক, মানুষ সভ্য হোক, বিজ্ঞানমনস্ক হোক-এই চাওয়া কি অন্যায়? যখন এ দেশে ঘটতে থাকা মন্দ-বীভৎস ঘটনার সমালোচনা করি, কিছু ধর্মান্ধ-মতান্ধ মানুষ গালি দিয়ে অনুযোগ করে, এ দেশের নিন্দা করছি আমি। আমার দেশপ্রেম নাই। 

কী করে বোঝাই, দেশটার ভালো চাই বলে সমালোচনা করি, যেন মন্দ-বীভৎস ঘটনা আর কখনও না-ঘটে। ওই ধর্মান্ধ-মতান্ধরা মনে করে, দেশ চলবে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী। এখানে সবাই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও ধর্মমত অনুযায়ী চলবে। এর বাইরে যাওয়া মানেই ধৃষ্টতা, বাড়াবাড়ি, অন্য দেশের দালালি। এর জন্য তাদেরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-পিটিয়ে-অপমান করে উচিত শিক্ষা দেওয়াটাই প্রকৃত দাওয়াই! 

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা মনে করে, মন্দ-বীভৎস ঘটনাগুলো কার্পেটের তলায় রেখে চোখ বুজে জোরে জোরে জাতীয় সংগীত গেয়ে ফেললেই দেশকে ভালোবাসা হয়ে গেল। কিন্তু কেউ তো দেশকে অন্যভাবেও ভালোবাসতে পারে। ক্ষতকে আড়াল করে নয়, ক্ষতের চিকিৎসা করে শরীরে সুস্থতা আনার পক্ষে যদি কেউ কথা বলে, সে কি অপরাধী হয়ে যায়?

ধর্মান্ধরা আমাদের দেশে অনেক বেশি সংগঠিত ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন মুক্তমনা লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনের কারণে হুমকির শিকার অনেককে দেশ ছাড়তে হয়েছে। এতে করে ধর্মান্ধরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্বপালনকারীরা এই অপশক্তির বিরুদ্ধে মোটেও শক্ত নয়, বরং নমনীয়।

শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই লড়াই চলছে। এই লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে— ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মান্ধবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষে। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে, ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন প্রাতঃভ্রমণে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারব, বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটবে, তাকে চাপাতি চালিয়ে খুন করব। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাব না, তার গালে আমি চড়ও দেব না। আমি লিখব। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করব। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাক্‌স্বাধীনতার এই শর্তটি ধর্মান্ধরা মোটেও মানতে চান না।

তারা বরং ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠছে। তাদের কাছে ধর্ম যেন কচু পাতার পানি। একটু টোকা লাগলেই গড়িয়ে পড়বে। তাই তারা ধর্ম টিকিয়ে রাখতে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাচ্ছে। তারা যুক্তিবাদীদের, ভিন্নধর্মীদের হত্যা করতে শুরু করেছে।

রাজনীতিবিদদের আস্কারা পেয়ে এই ধর্মান্ধরা ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে নানাভাবে ধর্মান্ধশক্তির প্রতি নমনীয় আচরণ প্রদর্শন করছে। অনেক সময় তাদের সঙ্গে আপস বা তাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করছে। এতে করে সমাজ রসাতলে যাচ্ছে। যুক্তির পরিবর্তে বিশ্বাস বাড়ছে। কুসংস্কার বাড়ছে। শিক্ষা ও সচেতনতার বদলে জড়তা ও মূর্খতা বাড়ছে। 

মনে রাখা দরকার যে, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের সমর্থক, দুইজনই সমান অপরাধী। ধর্মান্ধতার মোকাবিলা কঠোরভাবে করতে না পারলে শুধু সমাজেরই ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় প্রকৃত ধর্মের। সাংবিধানিক নৈতিকতা মেনে যে-সরকার তৈরি হয়, দেশে ধর্মীয় সহনশীলতার পরিবেশকে রক্ষা করতে সে দায়বদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। 

ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নিজেরা চরম অসহিষ্ণু, অবিবেচক, অগণতান্ত্রিক। তারা মানুষকে শিক্ষা দিতে চায়, নিজের ধর্মমত জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। যে বহুত্ববাদ বাঙালি সংস্কৃতির আদর্শ, তাকে রক্ষা করতে হলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে মেনে চলতে হবে সর্বপ্রথম। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। 

তবে তাদের হাতে সবটুকু ছেড়ে দিলে হবে না। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পালটাবে। হাতে গোনা কিছু মানুষই সমাজ পাল্টায়। চিরকাল তা-ই হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমার-আপনার দায়িত্ব কিন্তু কম নয়।