আমার ভাই আদনান, আমাদের গর্ব মেজর সিনহা

শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস
Published : 30 Jan 2022, 06:56 PM
Updated : 30 Jan 2022, 06:56 PM

২৬ জুলাই, ১৯৮৪। সুন্দর একটি দিন– শুধু সুন্দরই নয়, খুবই বিশেষ একটি দিনও ছিল আমাদের জীবনে। কেন? এই দিনে যে আমাদের জীবনে একজন বিশেষ অতিথি পাঠিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা। চন্দ্রঘােনায় মনােরম পরিবেশে মন ভালাে করে কি ফুটফুটে একটি শিশু এলাে আমাদের বিশেষ মেহমান হয়ে– বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন আদনান, সিনহা মাে. রাশেদ খান। এই সুন্দর ছােট্ট শিশুটিই যে সময়ের সাথে তার কর্ম, আচরণ, ভালােবাসা দিয়ে কখন আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে গেল আমরা টেরই পেলাম না!

ছােটবেলা থেকেই বই পড়তে পছন্দ করত আর ভীষণ ভালােবাসত খেলাধুলা করতে৷ নির্মল আকাশের নিচে, শিশির ভেজা মাটিতে পা রেখে দৌড়াতে দৌড়াতে হারিয়ে যেত। ছােট্টবেলা থেকেই ছিল অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় একটা মানুষ। যখন মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে সে সময় বয়স কতই আর ৭ বছর হবে বলত যে, "বড় হয়ে আমি হিমালয়ে যাব"। আমরা বলতাম টাকা কোথায় পাবে? বলত যে আমি টাকা উপার্জন করব, যেই কথা সেই কাজ। সেই ছােট্ট মাথায় বুদ্ধি এলাে যে, আম্মুর কাছে পান বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা জমাবে, তারপর সে ওই টাকা দিয়ে হিমালয়ে যাবে। তাে আম্মু তখন পান খেতেন, দোকান থেকে কিনে। আদনান আম্মুকে বলল, "আম্মু তুমি তাে প্রতিদিন দোকান থেকে একটা পান কিনে খাও, আমি পানের সব কিছু কিনে তোমাকে প্রতিদিন একটা পান বানিয়ে খাওয়াব, তুমি আমাকে একটি পানের জন্য দুটি টাকা দিও"– সেই অত ছােট্ট একটা মানুষের এত বুদ্ধি ও চিন্তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। ছােট্টবেলা থেকেই ছােট্ট ছােট্ট ছড়া লিখত– দেশকে নিয়ে, প্রকৃতিকে নিয়ে। খুবই অন্যরকম এবং চিন্তাশীল একজন মানুষ ছিল, সবসময় হাসিমুখে থাকত, সবার সাথে হেসেই কথা বলত। আমি ছিলাম তার খেলার সাথী– আমাকে ডাকত শ্যাম্পু বলে (শারমিন + আপু= শ্যাম্পু), সারাদিন আমরা দুজন একসাথে খেলতাম, আর প্রতিদিন রাতে তাকে একটা রূপকথার গল্প শোনাতে হতাে আমাকে। আমার গল্পের ভাণ্ডার যখন শেষ হয়ে গেল– তখন আমি রূপকথার গল্প লেখা শুরু করেছিলাম তার পীড়াপীড়িতে। পড়াশুনায় ছিল খুবই তুখােড়, কিন্তু দিনরাত পড়া নিয়ে থাকত না। আর মুখস্তবিদ্যার মধ্যে ছিল না সে, কোনাে কিছু পড়লে সেই কনসেপ্টটা খুব ভালোভাবে মন দিয়ে বুঝত আর তার ভিত্তিতেই লিখত। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিতে সবসময় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে রাখত। বিএনসিসি করত– রাজউক কলেজে থাকতে বিএনসিসি থেকে ভারতে গমন করে ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায়। একজন ভাই হিসেবে, একজন সন্তান হিসেবে, একজন বন্ধু হিসেবে আদনান ছিল অনন্যসাধারণ। কখনাে কারাে উপকার করতে পিছপা হতাে না, মানুষের বিপদে-আপদে সবার প্রথম দৌড়ে যেত সে।

সে ছিল দেশমাতৃকার এক অন্যনসাধারণ কৃতি সন্তান– দেশকে যে একেবারে মায়ের মতাে ভালােবাসত। সেনাবাহিনীতে জয়েন করার পর আম্মুকে বলেছিল, "আম্মু, আমি কিন্তু এখন শুধু তােমার সন্তান নই, আমি এখন দেশমাতৃকার সন্তান, কখনাে যদি আমার কিছু হয়, তুমি কিন্তু ভেঙে পড়বে না একদম"। এভাবে সে আম্মুকে মানসিকভাবে তৈরি করেছিল। তার মধ্যে ছিল মানুষকে ইতিবাচকভাবে মােটিভেট করার অসাধারণ ক্ষমতা ও প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলী। কর্মজীবনে সেখানে কাজ করেছে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দৃঢ়চিত্তে কাজ করেছে। পরিবারকে ভালােবাসত বড় বেশি। আব্বু ইন্তেকাল করার পর কতইবা তার বয়স তখন, সেই অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে। বােনদের ও মায়ের দেখাশোনা করেছে নিষ্ঠার সাথে, সে ছিল আমাদের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল। কখনাে এতটুকু কটু কথা শোনায়নি সে আমাদের কাউকে। মাকে অনেক অনেক বেশি শ্রদ্ধা করত ও ভালােবাসত– আম্মুর জন্য সে ছিল একটা কমফোর্ট জোন। আমরা যে বন্ডিং ও সম্পর্ক শেয়ার করতাম তা ছিল অকৃত্রিম ভালােবাসায় পরিপূর্ণ। সেই বন্ডিং ও ভালােবাসা কোনাে শব্দ বা লেখা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব না, সেটি শুধুই অনুভবের বিষয়। সেনাবাহিনীতে যােগদান করে নিজের ইচ্ছায়, আবার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তও নিজেই নেয়। সেনাবাহিনীর চাকরি তার ভালােবাসার জায়গা ছিল, কিন্তু একই সাথে এটাও ঠিক যে, জ্ঞানের জন্য তার যে পিপাসা ছিল সেটি মিটাবার জন্য সে সিদ্ধান্ত নেয় যে , চাকরি থেকে অবসর নেবে আর বিশ্ব ভ্রমণে বের হবে। ইচ্ছা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা যেমন ঘুরে দেখবে একই সাথে তার জ্ঞান ভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করবে। সে বলত, "আমি ফিলােসফির উপর ভবিষতে গবেষণা করব, আর এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেটি করব যেখানে থাকবে চেরি গাছ আর চেরি ব্লসম হবে তার নিচে বসে আমি আমার গবেষণার লেখা লিখব"। তার চিন্তা-জীবনদর্শন ছিল অন্য যেকোনাে মানুষের চেয়ে একদম ভিন্ন। লােভ-লালসা তাকে কোনােদিন স্পর্শ করতে পারেনি। খাবার খেত একদম পরিমিত, চোখের সামনে রাজভােগ থাকলেও সেটি তাকে প্রলােভিত করতে পারত না। নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটি তার কাছ থেকেই শেখা ছিল। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের জন্য আবেদন করার পর প্রায় আড়াই বছর লেগেছে তাকে রিলিজ দিতে– তার মতাে চৌকষ, দক্ষ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক, নির্ভিক সৈনিককে ছাড়তে চায়নি কেউই।

এই যুগে প্রায় সবাই যখন ব্যস্ত শুধু ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে নিজেদের সময় নষ্ট করতে, তখন আদনান ছিল এর একেবারেই ব্যতিক্রম। সে তার ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করত শুধু জ্ঞানর্জনের মাধ্যম হিসেবে। অনেক অনেক রকমের বই ডাউনলােড করে পড়ত এবং তার সত্যকার মর্মার্থ জানার চেষ্টা করত– সে শুধু একজন শিক্ষিত মানুষই ছিল না, ছিল একজন প্রকৃত আলােকিত মানুষ। শিক্ষিত মানুষ সমাজে অনেক পাবেন । কিন্তু আলােকিত মানুষ পাওয়া বড়ই কঠিন। কোনাে ধরনের সংকীর্ণতা, পরচর্চা, পরনিন্দা তার অভিধানে ছিল না। আমাদেরকে ভালােবাসত মনের গভীরতম জায়গা থেকে। আজ প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত সেই মানুষটাকে এত এত মিস করি আমরা, আমাদের হৃদয়ের মর্মান্তিক রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে পায় না, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া।

প্রকৃতিকে ভীষণ ভালােবাসত সে, প্রকৃতির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম বিষয়গুলােও তাকে অনেক বেশি আনন্দ দিত। ইউএন মিশনের মাঝে যে এক মাসের একটি ছুটি থাকে, সেই ছুটিতে দেশে না এসে বরং নিজে ড্রাইভিং করে ইউরােপের অনেকগুলাে দেশ ভ্রমণ করেছে সে। বই পড়া, ড্রাইভিং, বন্ধুদের সাথে নির্মল আড্ডা দেওয়া আর পরিবারকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানাে ছিল তার ভালােলাগার জায়গা। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়া সত্ত্বেও কখনাে অন্য দশটা ছেলের মতাে কোনাে আবদার করত না, বাবা-মাকে কখনােই কোনাে বিষয় নিয়ে এতটুকু চাপ প্রয়ােগ করত না, জ্বালাত না। বরং সবার অবস্থা ভালােভাবে বুঝার চেষ্টা করত আর কীভাবে পরিবারের কল্যাণের জন্য কন্ট্রিবিউট করা যায় সেটিই চিন্তা করত আর সেভাবেই নিজের কাজগুলাে করত। আমাদের একের প্রতি অন্যের ভালােবাসাটা ছিল ভীষণ নির্মল ও নিস্বার্থ– তাই তাে সম্পর্কটা ছিল ভীষণ আত্মিক। আজ হয়তাে সে সশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত তার উপস্থিতি আমরা অনুভব করি, কারণ তার আত্মা অনেক আলােকিত ও শক্তিশালী আর সম্পর্কটা হলাে হৃদয় থেকে হৃদয়ের।

নিরাশা-হতাশা-নেতিবাচকতা এগুলাে আমার ভাইয়ের অভিধানে ছিল না, আর আমরাও তার পথই অনুসরণ করে আশা-ইতিবাচকতা-মানসিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলছি জীবনে, আলহামদুলিল্লাহ। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আদনান আছে আমাদের সাথে– তাকে ছাড়া আমাদের জীবন না। সে ছিল, সে আছে ও থাকবে– আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে।