নিন্দা, অপবাদ এবং নেগেটিভিটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 Jan 2022, 07:40 AM
Updated : 9 Jan 2022, 07:40 AM

আজ থেকে নিউ জিল্যান্ডের সাথে আমাদের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে। শুরুর দিনেই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে স্বাগতিকরা। আমার আলাপটি আসলে এই টেস্ট নিয়ে নয় বরং আগের টেস্টে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়টিকে নিয়ে। চলমান টেস্টের ফলাফল যাই হোক না কেন আগের জয়টির গুরুত্ব তাতে একরত্তিও কম মনে হবে না কখনো।

এই টেস্ট জয়টা আমাদের ক্রিকেটের জন্য জরুরী ছিল। নিউ জিল্যান্ডকে টেষ্টে হারানো সহজ কথা না। শুরুর দিন থকে শেষদিন খেলা দেখেছি টিভিতে। শুরুতে পুরো না দেখলেও শেষদিনে জয়ের মুহূর্তটা দেখেছি। একটা বিষয় নিশ্চিত, বাংলাদেশের শক্তি আছে। জয়ের নেশা আর ধারাবাহিকতা দরকার। সমালোচনা আমাদের জাতিগত স্বভাব। বিরোধীতাও মজ্জাগত। ক'দিন আগে কি তুলোধুনাই না করেছি আমরা। একেকজনের মন্তব্য আর আলোচনা শুনে মনে হতো আমাদের ক্রিকেটাররা কিছুই জানেন না। মাঝেমধ্যে ভাবতাম কেন এদের কথা শুনছে না তারা? শুনলে আমাদের বিশ্বকাপ ঠেকায় কে?

প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ শুধু নিউ জিল্যান্ডকেই না সমালোচকদেরও কড়া জবাব দিয়েছে। মনে করুন তো কাদের কাদের জবাব দিয়েছে আমাদের ছেলেরা? যারা মনে করেছিল ক্রিকেটে যুবাদের শক্তি শেষ, এরা টাকা পয়সা আর বিত্তের চাপে চাপা পড়ে গিয়েছে তাদের দিয়েছে জবাব।

জবাব দিয়েছে সেসব সমালোচকদের যারা মনে করেছিল নিউ জিল্যান্ড সফর একটা ভ্রমণ মাত্র। অনেকেই জানেন ৮৩ নামে একটি চলচ্চিত্র এখন বাজার গরম করে রেখেছে। এই চলচ্চিত্রটি তার নামের মতোই ইতিহাসভিত্তিক। ১৯৮৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের হাল আমাদের চাইতে মন্দ ছিল। তারা দীর্ঘকাল ক্রিকেট খেললেও জয়ের কোনও ধারাবাহিকতা ছিল না। পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের চাপে দিশেহারা ভারত গিয়েছিল ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে। তা নিয়ে অনেক ঠাট্টা-মশকরা হয়েছে। সকলেই ভারতকে দুধভাত মনে করে বাদ দিয়ে রেখেছিল হিসেবের খাতা থেকে। আমদের অবস্থা তো তখনকার ভারতের চেয়ে অনেক ভালো, আমাদের চরম দুশমনও জানে টাইগারেরা যেকোনও সময় খেলার চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ভারতের সেরকম কোনও ইমেজ ছিল না। এত বছর পর এসে সেই দলের অনেকেই স্বীকার করেছেন তাদের ধারণা ছিল এটা একটা বিলেত ভ্রমণ আর সাথে কয়েকটা ম্যাচ খেলা। কপিল দেবের অলৌকিক রান ব্যতীত জিম্বাবুয়েকে হারানো ছিল অসম্ভব। ফাইনালে দশাসই সব ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের মোকাবেলা করেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কপিল দেবের দল। আমি মনে করি একদিন এই ইতিহাস আমাদের ছেলেরাও লিখবে।

আসল কথা হলো, আমাদের সবকিছুতে পলিটিক্স। ক্রিকেট বোর্ড নিয়ে এত সমালোচনা খুব কম দেশে শুনি। এই বোর্ডও আর দশটা বিষয়ের মতো একপেশে। চরম রাজনীতি বিমুখ মানুষও জানেন এখানে রাজনীতি আছে। চলছে রাজনীতির লড়াই। দেখলাম বোর্ড প্রেসিডেন্ট টিভিতে বলছেন সাকিব ভালো খেলোয়াড় হয়ে কি লাভ যদি দেশের হয়ে না খেলে? বোঝাই যাচ্ছে সংঘাত চলছে। সাকিব আল হাসান আমাদের সবচাইতে নামী ক্রিকেটার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা, শাস্তি-জরিমানা এসব ভোগ করা তার জন্য রোজকার ঘটনা। একটা কথা বলতেই পারি, যেহেতু এখনো তার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়নি তাই সবাই মুখ বুঁজে সব সহ্য করে নিচ্ছে। একটা বিকল্প তৈরি হলেই এই কাচের স্বর্গ ভেঙ্গে যাবে। বিদায়ী অধিনায়ক মাশরাফিও থাকেন বিতর্কে। এখন শুরু হলো নান্নু বনাম আশরাফুল। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে নিয়ে মজা করে লোকে বলে, পাপন ভাই নাকি কখনো আপন ভাই হয় না।

এতসব বিতর্ক রাজনীতি শক্তিকে দুর্বল করতে যথেষ্ট। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরামও নাক গলিয়ে বললেন, লিটন দাসকে দলে রাখার মানে হয় না।

আমাদের দেশের খেলায় কোন খেলোয়াড় খেলবে বা খেলবে না সেটা কি ঠিক করে দেবে ভারত বা পাকিস্তানের কোনও তারকা? কই আমাদের সাবেকরা তো কখনো বলেন না যে, বাবর আজমকে এবার বাদ দাও। এই যে নাক গলানো এর জন্য দায়ী আমরাই। আমাদের অন্তর্গত সাম্প্রদায়িকতা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌম্য ও লিটনকে গালমন্দ করার ব্যাপারটি সবাই জানে। সবাই বুঝে গেছে এটা একটা ছিদ্র তাই তারা ছিদ্র বুঝেই আঙুল দেয়। এটা বন্ধ করতে হবে। অধিনায়ক মমিনুল হককে নিয়েও কম কথা হয়নি। কথা বললেই সে বিপদে পড়ত। আমার যেটা মনে হয় আচরণগত সমস্যার কোড মানা আর সেটা রপ্ত করার কাজটা শুরু করা দরকার। তাহলেই আবোল-তাবোল কথা বন্ধ হয়ে যাবে। আর একটা জরুরী বিষয় হচ্ছে অন্তর্গত কোন্দল বা ইগো সমস্যা মিডিয়াতে সে ভাবে হাইলাইট না করা। দুনিয়ার সবদেশে সব খেলায় এসব দ্বন্দ্ব আছে। বড় খেলোয়াড়, মাঝারি খেলোয়াড় সবাই যার যার মতো ইগো নিয়ে চলেন। এগুলো মুখরোচক করে পরিবেশন না করলেই কি চলে না? এমন একটা সময় আসবে যখন এগুলো হজম করার মতো মন-মানসিকতা গড়ে উঠবে। এখন আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার সময়। তাই একটু সমঝে চললেই মঙ্গল।

নেগেটিভ ভাবতে ভাবতে বাঘও আয়না দেখে হালুমের বদলে নাকি মিউ মিউ করে। ভুল আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে আমরা আমাদের শক্তি ভুলে গিয়েছিলাম। একটা টেস্টে জয়-পরাজয় বড় ব্যাপার না। তবে এই জয়টা বিশাল। কারণ নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিতে আসাটা বড় সাফল্য। ভারত-পাকিস্তান কেউই তা সহজে পারেনি, পারে না। কিউইরা দুনিয়ার সবচাইতে নিরিবিলি ভদ্র টিম। তাদের শারীরিক ভাষা-আচরণ সবকিছু সহনীয়। তারা খেলে কৌশল আর মেধা দিয়ে। তাই তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ আমার মতে সেরা হবার দৌড়ে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া।

আমদের দেশ যে এগিয়েছে, তারুণ্য যে আমাদের প্রজন্মের মতো ভীতু বা দুর্বল না সেটাই মনে পড়ে যায় বারবার। আমরা সাদা চামড়া এবং বড়সড় কালো লোক দেখলেই ভড়কে যেতাম। এখন দুনিয়া হাতের মুঠায়। তাই তরুণেরা কাউকে ভয় পায় না। তাছাড়া স্বাধীন একটা দেশে জন্ম নিয়ে বড় হয়ে ওঠা আর সেই দেশের পতাকা মাঠে বহন করার তেজই আলাদা। খ্রিস্টিয় নতুন বছরে এই জয় আমাদের জাতির বিজয়। আমাদের গৌরবের মাইলফলক।

জয়তু বাংলাদেশ।