সুগন্ধায় পোড়া লাশ এবং বরগুনার নৌপথের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 3 Jan 2022, 01:16 PM
Updated : 3 Jan 2022, 01:16 PM

ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আমাদের নৌদুর্ঘটনায় নতুন এক ভয়ংকর মাত্রা সংযোজন করেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে আমরা এতো দিন লঞ্চ ডুবে মানুষের মৃত্যু দেখলেও এই প্রথম পানিতে ভেসে থাকা লঞ্চে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু দেখলাম এই লঞ্চটির বদৌলতে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের নৌ, সড়ক ও রেলপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে সবই মূলত অবহেলার জন্য। এই লঞ্চটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগার পর তা নেভানোর সামান্য চেষ্টা যেমন তারা করেনি, তেমনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও লঞ্চটিতে ছিল না। 

আগুন লাগার পর দীর্ঘ ১ ঘণ্টা ধরে লঞ্চটি যখন এই ঘাট থেকে সেই ঘাটে ভিড়তে চেয়েছে তখন কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন আর কেউ কেউ ফেলে আসা সন্তান বা প্রিয়জনকে খুঁজতে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন। নজিরবিহীন এই অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে আসা এক যাত্রীর জানিয়েছেন- তিনি তার মা, স্ত্রী ও দুই কন্যা নিয়ে বরগুনাগামী এই লঞ্চটিতে উঠেছিলেন। আগুন লাগার পর মাকে নিয়ে যখন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন স্ত্রী আর দুই কন্যা আগুনের মুখে। মাকে তীরে নিরাপদে রেখে এসে কাউকেই আর খুঁজে পাননি তিনি। ভাবা যায় কি মর্মান্তিক ছিল সেই রাতের ঘটনাগুলো! এ দৃশ্য কল্পনা করতেও তো আতঙ্ক গ্রাস করে।

লঞ্চডুবির ঘটনা এ দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করার 'সুযোগ' পাওয়াসহ লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন এ নিয়ে হৈ চৈ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। যদিও সে কমিটির তদন্ত রিপোর্ট কখনও আলোর মুখ দেখে না এবং দোষীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে এই। এর সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটিতে। 

সম্প্রতি এই লঞ্চটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের দুইটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। যে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো অনুমতি নেওয়া হয় নি। তাছাড়া, যাত্রার আগে খালি অবস্থায় ট্রায়ালের কথা থাকলেও সেটা দেওয়া হয়েছে ধারণক্ষমতার চাইতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে পুরো গতিতে ইঞ্জিন দুটো একসাথে চালিয়ে। আর এতেই ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তদুপরি আগুন লাগার পর ইঞ্জিন রুমে মজুদ থাকা কেরোসিন, দাহ্যপদার্থ লুব্রিকেট ও হাইড্রোলিক অয়েলের কারণে দ্রুত তা পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। কারণ, দাহ্য পদার্থ লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে মজুদ থাকলে যেমন নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হয়, ওই লঞ্চে তা ছিল না। অন্যদিকে লঞ্চের এক কেবিন বয় জানিয়েছেন যে, ইঞ্জিন রুমের পাশে খাবারের হোটেলের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কাগজে-কলমে লঞ্চটি যে মাস্টারের (চালক) চালানোর কথা ছিল, তিনি চালাচ্ছিলেন না বলেও জানা গেছে। মানে যতরকম অব্যবস্থাপনা আছে তার সবই ছিল লঞ্চটিতে। তবে কোনটা অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের মূল কারণ তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গগুলো উঠে আসুক বা ভিন্ন অন্য কিছুই থাকুক না কেন- একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠে গেছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই যদি এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তাহলে সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়? 

অন্যদিকে, এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে- বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌযানে যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে সেগুলোর প্রায় সবই মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অকার্যকর। অভিযান-১০ লঞ্চটিতে ২১টি অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র থাকার পরও একটিও কোনো কাজে আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, লঞ্চ প্রথমবার নদীতে ভাসানোর সময় সেই যে সেগুলো সেট করা হয় তারপর সেগুলোর কি অবস্থা, সচল আছে কিনা তা আর কখনো পরীক্ষা করা হয় না। তাছাড়া আরেকটি কথা হলো, যারা আগুন নেভাবেন কিংবা ইন্সট্রুমেন্টগুলি ব্যবহার করবেন তাদেরও তো সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ লাগবে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ কেবল লঞ্চচালক বা কর্মচারীদের নয় প্রশিক্ষণ যাত্রীদেরও দরকার। লঞ্চে থাকা টেলিভিশনে ভিডিওর মাধ্যমে যাত্রা শুরুর পূর্বে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। অথচ এসব কিছু আমাদের এখানে কখনই করা হয় না। 

তবে দায় শুধু লঞ্চ মালিক কিংবা কর্মচারীদের উপরে চাপালেই হবে না, দায় আছে সরকারেরও। অধিক মুনাফা লাভের আশায় লঞ্চ মালিকরা রোটেশন কৌশল করে প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যাক লঞ্চ চালালেও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কখনও নজরদারি করা হয় না। তাছাড়া, দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলোতে ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে শনিবার প্রচুর ভিড় থাকে। কারণ শুক্র-শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার অনেকেই গ্রামে যান। আবার রোববার অফিস খোলা থাকায় শনিবার সবারই ফেরার তাড়া থাকে। আর এই সুযোগে প্রতিটি লঞ্চ তাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী বোঝাই করে যাত্রা করে। এত পরিমাণ যাত্রী এ সময়ে নেওয়া হয় যে, কেবিনের পাশে হাঁটার জায়গা এবং ছাদেও তিল পরিমান জায়গা ফাঁকা থাকে না। অভিযান-১০ লঞ্চটিও এমনটি করেছিল। এ কারণে বেশিরভাগ যাত্রীই লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া পায় নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। যদি আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হতো, জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকতো তাহলে যাত্রীরা সেগুলো ব্যবহার করে জীবন বাঁচাতে পারতো।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলরত অনেক লঞ্চেরই ফিটনেস নেই। ঢাকা থেকে বরগুনা রুটের নিয়মিত যাত্রী হিসেবে দেখেছি, দু-একটি বাদে এই লঞ্চগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। ফলে বরগুনার অনেকেই নদীপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে তারপর সড়কপথে বরগুনা আসেন। তাছাড়া অন্যান্য নৌরুটের তুলনায় এখানে ভাড়াও অত্যাধিক। এই লঞ্চগুলোর ভেতরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অনেক কিছুই যেমন নেই তেমনই অব্যবস্থাপনাও চরমে। তারপরও কাগজপত্র চেক করলে দেখা যাবে এ লাইনে চলাচলরত সব লঞ্চেরই ফিটনেস সনদ রয়েছে! অথচ এ ধরনের ফিটনেসের তো কোনো মূল্য নেই। 

এসব তদারকির জন্য রয়েছে নৌপরিদর্শক। এছাড়া ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। যদি তারা নিয়মিতভাবে এগুলোর দেখভাল করতেন তাহলে অনেক দুর্ঘটনাই ঘটতো না। আমাদের এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর কিছুদিন তারা দায়িত্ব পালন করেন তারপর আর কোনো খবর থাকে না। যেমন দুর্ঘটনার তিন দিন পরে এবার আমি ঢাকা থেকে বরগুনা আসার সময় লঞ্চে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি দেখেছি, কেবিনের ভেতরে আলাদা করে লাইফ জ্যাকেটও পেয়েছি- এমন প্রস্তুতি আগে কখনও দেখি নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লোক দেখানো এই প্রস্তুতি কতদিন থাকবে? দুই মাস, তিন মাস নাকি ছয় মাস?  

বাংলাদেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনেই রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? অভিযান-১০ লঞ্চটিতে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো তা কোনোভাবেই সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়। নরওয়েজিয়ান সমাজবিজ্ঞানী জোহান গ্যালটাঙ এর কাঠামোগত সহিংসতার তত্ত্ব মানলে এটা স্পষ্টতই একটি কাঠামোগত হত্যা। 

নৌপথকে নিরাপদ করতে অচিরেই এগুলোর সুরাহা করতে হবে। অন্যদিকে, কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে এবং তাছাড়া লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জামাদি না থাকলে ওই লঞ্চের যাত্রা স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট নৌ-আদালতে মামলা দায়েরর মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য প্রচলিত আইনকে যুগোপযোগী করার সময় এসেছে। কারণ, প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু এ কারণেও ঘটছে যে, এসব দুর্ঘটনায় কারও তেমন কোনো শাস্তি হয় না। ১৯৭৬ সালের একটি সরকারি অধ্যাদেশকে পাঁচ দফায় সংশোধন করার পরেও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে পাঁচ বছরের জেল আর মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা! 

তদুপরি, আইনটি এতটাই সেকেলে যে, রাষ্ট্রপক্ষ তা দিয়ে দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে এ আইনে কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, আইনটির আরেকটি দুর্বলতা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। তাই অব্যবস্থাপনাজনিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে প্রথমেই কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। এর পাশাপাশি এই পুরো খাতটির ওপর কড়া নজরদারি বজায় রাখতে হবে। কারণ, সরকার ও প্রশাসন যথাযথ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলে নৌপথে দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।