সাম্প্রদায়িক হামলা ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজনীয়তা 

অপর্ণা হাওলাদারঅপর্ণা হাওলাদার
Published : 21 Nov 2021, 01:23 PM
Updated : 21 Nov 2021, 01:23 PM

প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় পূজার সময় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের খবর আসে। গত কয়েক বছরে হামলা করে মূর্তি ভাঙা প্রায় 'ঐতিহ্য'-তে পরিণত হয়েছে। 'নাস্তিকতার অপরাধেও নিয়মিত সহিংসতা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এসব গুজব বাতাসের বেগে ছড়িয়ে যায়। শাস্তির ভয় কিংবা জবাবদিহিতার দায় না থাকাকেই আপাতদৃষ্টিতে সমস্যার মূল কারণ মনে করা হয়। প্রতিবছরের মতোই এবার কিছু ভাঙাভাঙি দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়ে পরে গুজবের ভিত্তিতে হিন্দুপাড়া ধরে বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। মূল অপরাধীর ধর্ম চিহ্নিত হওয়ার পর আপাতত সাম্প্রদায়িক হামলা থেমেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আগের বছরগুলোতেও বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মূল অপরাধী কোনও না কোনও চক্রান্ত করে ধরা পড়েছে, কিন্তু ততক্ষণে নিরাপরাধ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই শিকার হয়েছেন নির্যাতনের। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের তরফ থেকেও কথা হচ্ছে। আমাদের অনেকের জন্যই স্বীকার করে নেওয়াই কঠিন, কিন্তু বাংলাদেশে একটি উগ্র পরমতঅসহিষ্ণু তরুণ-যুবক সমাজ বিদ্যমান যারা এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। 

গত কয়েক বছর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা কিংবা ধর্মভিত্তিক অন্যান্য হামলার প্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্র/গবেষক হিসেবে কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপনের প্রয়োজনবোধ করছি। এ প্রশ্নগুলো সামনে আসছে না বা অন্তত আমি দেখছি না। কিন্তু অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে আমার কাছে প্রশ্নগুলো সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমি মূলত বাংলাদেশে সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার অভাব এবং এ অভাবের কারণে টার্গেটেড জননীতির (পাবলিক পলিসি) দুর্বলতার কথা বলতে চাচ্ছি। দুইটি বিষয় মনে রাখা দরকার- 

প্রথমত, তথ্য অবকাঠামোর অভাব (ডেটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার) আমাদের সর্বত্রই। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের দৈন্য সীমাহীন। এ সীমাহীন দৈন্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষকদের আন্দাজে ঢিল মারা ছাড়া কাজের কাজ করার অবকাশই কম। গত কয়েক দশকে প্রতিবছর কোথায় হামলা হয়েছে, কারা মূলত হামলার সাথে জড়িত ছিল, তাদের বয়স কেমন, আয় ও পড়াশোনা কেমন, সংখ্যালঘু পরিবারদের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন– এ তথ্যগুলো জোগাড় করা দরকার। আমাদের যদি অঞ্চলভিত্তিতে নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়, তাহলেও এসব তথ্য হাতের কাছে থাকা প্রয়োজন। 

হিন্দু অভিবাসনের তথ্যও যতটা সম্ভব জানা প্রয়োজন। এর বেশিরভাগটাই আইনিভাবে নয়, সেহেতু আমাদের মাইগ্রেশন সোর্স বুঝতে হবে। বাংলাদেশে মুসলিম তরুণ যুবকেরা কোথায় যাচ্ছে? সরকারের সাহায্য পাওয়া যায় কোন কোন দেশের শ্রমবাজারে? এসব জায়গায় হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব কতটা? শ্রম আইনে কিছু পরিবর্তন এনে এই ধারা বদলানো সম্ভব কিনা– শ্রম বাজারের সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক বুঝতে গেলে অভিবাসনের এ ধাপটি বোঝা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হিন্দুরা না যেতে চাওয়ার পেছনে অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে আইনিভাবে সংখ্যালঘু তরুণ সমাজের জন্য মাইগ্রেশনের কথা ভাবতে হবে। তার জন্য আগে প্রয়োজন অভিবাসনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো বোঝা। ডেটা ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অবদান এ ক্ষেত্রে হতে পারে অসীম। 

আমরা যখন আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে পারব গুজব শুনলেই মিছিল করে বের হয়ে অন্যের জানমাল ধ্বংস করতে আগ্রহ কাদের থাকতে পারে, তখনই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে সুনির্দিষ্ট নীতি নিয়ে চিন্তা করা। কথা উঠতে পারে যে, এ ডেমোগ্রাফিক তথ্য কিভাবে বের করা সম্ভব। প্রয়োজনে পুলিশের কাছে থেকে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের তথ্য নেওয়া যেতে পারে। এর সাথে যোগ করা যেতে পারে জরিপ। জরিপ মারফত জানার চেষ্টা করা যেতে পারে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা এবং রূপ। দুই ধাপে সংগ্রহ করা এ দুই তথ্যের বিশ্লেষণ করলে আমাদের লক্ষ্যে যেতে পারা উচিত। 

দ্বিতীয়ত, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার অভাব। বাংলাদেশে এখনো সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধাপের গবেষণা খুবই অপ্রতুল। যা আছে, তা দিয়ে ঘটনা এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে 'অভিসন্দর্ভ' দাঁড় করানো কঠিন। আমাদের এমনকি মুক্তিযুদ্ধের কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও ঘটনাভিত্তিক ভালো কোনও গবেষণা নেই। সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত ও যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করে আক্রান্ত জনপদের অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। আমাদের এ ক্ষেত্রেও বলার মতো বিশেষ কিছু নেই।  এমনকি ভারত ভাগ নিয়ে আমাদের ভালো গবেষণা নেই। অর্থনৈতিক ইতিহাস এর যে কাজগুলো বাংলা নিয়ে হয়েছে তার ৯৫ শতাংশ বিদেশিরা করেছেন বা করিয়েছেন। সেগুলো আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কথা চিন্তা করে করা হয়নি। গবেষণার দীনতার ছাপ নীতিনির্ধারণে পড়ছে। 

গবেষণাভিত্তিক তত্ত্ব এবং জ্ঞানচর্চার অভাবের কারণে আমরা তাত্ত্বিকভাবে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, কেন বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে। এসব হামলার পেছনে কোনও আঞ্চলিক বৈষম্য কাজ করছে কিনা, সেটি কোনও গবেষণায় ঠিকঠাক মতো আসেনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের যুবসমাজকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে কিনা তা বোঝার কোনও উপায় নেই। 

বাংলাদেশের গ্রাম এবং উপশহরের বাস্তবতায় হিন্দু-মুসলিম মিথষ্ক্রিয়া বোঝার জন্য যে গভীর জ্ঞানচর্চা প্রয়োজন তার কণামাত্র আমাদের নেই। 'কান নিয়েছে চিলে' শুনে রাস্তায় নামছে যে বিপুল জনতা তার 'মোটিভ' কী? পলিসি ধরে পরিবর্তন আনতে চাইলে আমাদের বিপুল পরিমাণে এ ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজন। সংক্ষেপে, আমার প্রস্তাবনা: 

১. তথ্য অবকাঠামোতে জনবল নিয়োগ এবং বাজেট বাড়ানো। প্রয়োজনে দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন দেশে কর্মরত আমাদের সামাজিক বিজ্ঞানীদের দল তৈরি করে এ কাজে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা করা। এই সম্পূর্ণ কাজটিকে রাজনীতির ছত্রচ্ছায়া থেকে দূরে রাখাও প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সকে কাজে লাগানো যেতে পারে যদি তারা এইসব তথ্য পাবলিক ইনফরমেশন হিসেবে রাখতে আগ্রহী হয়। 

২. উগ্রবাদীদের কাজের পেছনে মূলত তিনটি উৎস থাকে– জমিজমা সংক্রান্ত, শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব। এর ওপরে রাজনীতির কালো ছায়া তো আছেই। আমাদের প্রয়োজন তথ্যের ভিত্তিতে বের করা কোথায়, কারা এবং কেন সহিংসতার সাথে জড়িত। তাদের অন্য পথে পরিচালিত করতে আমাদের সামগ্রিক কী কী পরিবর্তন আনতে হবে। প্রয়োজনে সিলেবাস নিয়ে চিন্তা করতে হবে, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ নিয়ে ভাবতে হবে। তরুণসমাজের সামনে অর্থবহ কাজ না থাকলে বিপথে পরিচালিত হওয়াই স্বাভাবিক, অর্থবহ কাজের সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরির ক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা রাখতে পারে যৌক্তিক অবদান। 

স্বল্পতম সময়ে আইনের মাধ্যমে সুবিচার হলেও মানুষের মধ্যে এ ধারণা তৈরি হবে যে, সহিংসতা করে, সাম্প্রদায়িক হামলা করে পার পাওয়া যায় না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রয়োজন কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো নিয়ে চিন্তা করা, গবেষণার প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মননের লড়াই শিক্ষা এবং উৎপাদনশীল কর্মের মাধ্যমেই করতে হবে।