রামু সহিংসতার নয় বছর এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা

Published : 29 Sept 2021, 10:47 AM
Updated : 29 Sept 2021, 10:47 AM

২০২১ সালের গত ২০ সেপ্টেম্বর মধুপূর্ণিমা উদযাপিত হয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরও ছিল মধুপূর্ণিমা। আগের রাতে সহিংসতা ঘটায় পরের দিনটা রামুর বৌদ্ধদের কাছে আর মধুময় হয়ে উঠতে পারেনি। ঘটনার পর দিন ৩০ সেপ্টেম্বর ধর্মীয় সেই উদ্মাদনার বিষবাষ্প পার্শ্ববর্তী উপজেলা উখিয়া, টেকনাফ ছাড়িয়ে চট্টগ্রামের পটিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। খোদ রামুতে ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে শুধাংশু বড়ুয়ার বাড়িতে ব্যাপক হামলা আর লুটপাটের ঘটনা ঘটে। দেখতে দেখতে ঘটনার নয় বছর পার হয়ে গেল। এই নয় বছরে দেশে আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রামু সহিংসতার মতো একই কায়দায় নাসিরনগর, সাঁথিয়া থেকে শুরু করে একাধিক জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার প্রায় একই পরিণতি হয়েছে। আর ঘটনার নিচে চাপা পড়ে থাকছে ঘটনা। এভাবেই চলছে। রামুর ঘটনা পরবর্তী দেশে-বিদেশে জোর প্রতিবাদ আর দাবি উঠেছিল এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে। কিন্তু এমন ঘটনা ঠিকই আরো ঘটেছে। আগামীতেও যে এমন ঘটনা আর ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তাহলে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের জাতিগত ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ভবিষ্যত কী? রামু সহিংসতার ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়। মামলায় কেউ কেউ আটকও হয়েছিলেন। যারা আটক হয়েছিলেন তারা পরবর্তীতে সবাই জামিনে মুক্ত আছেন। এরমধ্যে রামুর শুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু পক্ষের আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়। অপর ১৮টি মামলার বাদী ছিল পুলিশ। ওই ১৮ মামলায় মোট ৯৯৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ ১৮টি মামলা আদালতে বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের পিপির ভাষ্যমতে, সাক্ষীর সহযোগিতার অভাবে বিচারকার্য ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে না। সাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন, তাহলে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মামলার আসামী, সাক্ষী, সাক্ষ্য দেওয়া এসবকিছু নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। জানি না, এই ঘটনার বিচারিক কার্যক্রমের শেষ কোথায়। রামু সহিংসতার দুই বছর উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ সভায় মানবাধিকারনেত্রী ড. সুলতানা কামাল বলেছিলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আমরা চল্লিশ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। রামু সহিংসতার বিচারের জন্যও প্রয়োজনে আমরা চল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষা করব। তবুও বিচার হতে হবে'।

ভারতবাসী স্বপ্ন দেখেছিল ব্রিটিশ শাসন-শোষণমুক্ত একটি স্বাধীন ভারতের। প্রায় দুইশ বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম আর সর্বোচ্চ ত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে এসে ভারতবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ অধীনতা ছিন্ন করে এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান এবং অবশিষ্ট অঞ্চল ভারতীয় প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত হয়। কেবল ধর্মের ভিত্তিতেই ভারত আর পাকিস্তান আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারতভাগের পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারল পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সাথে বৈমাত্রেয় সুলভ সেই একই আচরণ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ, অধিকার বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের আলাদা সেই রাষ্ট্র হবে স্বাধীন বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভাজন, অন্যায়, অবিচার, শোষণ আর বঞ্চনা। এ অঙ্গীকার নিয়েই জাতির পিতার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ নয় মাসের সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার পেছনে একটাই স্বপ্ন ছিল তা হলো বহুজাতি, বহুভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির চারণ ও লালন ভূমি হবে স্বাধীন বাংলাদেশ। কবিগুরুর ভাষায় আমাদের দেশ হবে সোনার বাংলাদেশ।

চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ৭২-এর সংবিধান রচিত হয়। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূলনীতির ওপর ভর করে রাষ্ট্র পরিচালিত হবার অঙ্গীকার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা দু চোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা আশা নিয়ে তেমন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলার অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ৭৫-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। ক্ষমতার গদি কাড়াকাড়ি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র, সবকিছু মিলে চরম অস্থিরতা আর সংকটের মধ্য দিয়ে গোটা আশির দশক পর্যন্ত পথভ্রান্ত পথিকের মতো ইতিহাসের কানাগলি বেয়ে যেতে হয় নেতৃত্বহীন বাংলাদেশকে। অবশেষে, নব্বই দশকের শুরুর দিকে গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এল। ততদিনে দেশ ও দেশের জনগণ বিভিন্ন দল ও উপদলে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। রাজনৈতিক দলগুলো পারষ্পরিক বিরোধ, কলহ, দ্বন্দ্ব, শক্তি প্রয়োগ, ক্ষমতায় যাওয়া আর টিকে থাকার লড়াই, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগ দিতে গিয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এদিকে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ও গণতন্ত্র বিকশিত হতে না পারার সুযোগে দেশে ধর্মীয় উগ্রতা আর জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলার পরিণতি কখনো শুভ হয়নি। এক পর্যায়ে দেশে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি দৃশ্যমান হয়ে গেল। তাতে করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করার পথ আরো সুগম হয়েছে। অথচ এ দেশ এবং দেশের জনগণের বৈশিষ্ট্য সেটা নয়। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, দুর্বল গণতন্ত্র, প্রতিহিংসার রাজনীতি, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মকে একাকার করার কারণেই এই দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে ওইসব দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হবে বাংলাদেশকে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এটা অসম্ভব কিছু নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হলো প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম স্বাধীনভাবে প্রতিপালন করার অধিকার লাভ করবে। তাদের ধর্মীয় স্থাপনা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা ও লালন করার অধিকার থাকবে। কেউ কারোর ওপর আঘাত ও প্রতিবন্ধতকা সৃষ্টি করবে না। ধর্মের নামে একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী আরেকটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জানমালের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকবে। এ সহজ বিষয়টি আমরা মানতে পারছি না কেন?

দেশে যে হারে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে তার লাগাম টানতে হলে 'ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু কমিশন' গঠন করা এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসা রাজনৈতিক দলগুলো যদি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও স্বার্থের কথা সত্যি ভেবে থাকে তাহলে 'ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও কমিশন গঠন' করতে বাধা কোথায়? তাতে তো রাষ্ট্র কিংবা অন্য কারো কোনো অসুবিধা বা অন্তরায় হবার কথা নয়! বরং বিশ্বে একটি নজির সৃষ্টি হতে পারে। যেসকল সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটে সেসব ঘটনার দ্রুত বিচারের দৃষ্টান্ত তৈরি করা গেলে বিশ্বের কাছে রাষ্ট্র সম্পর্কে একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে এবং দেশে সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ক্রমশ রোধ করা যাবে। দেশে সময়ে সময়ে যেসব সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ঘটে তাতে দেশের শান্তিবিরোধী, দেশে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টিকারী বিশেষ একটি মহলের সুবিধা ছাড়া রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের জনগণের তো কোনো লাভ নেই। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে একটি মাইনরিটি ডিক্লারেশন গ্রহণ করে। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়, দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, নাগরিক অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্রকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগের প্রবনতা কমেছে, ধর্মীয় স্বাধীনতাও অনেকটা বেড়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধাও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। সুরক্ষা বলয় এখনো প্রশ্নবিদ্ধ এবং হতাশাব্যাঞ্জক। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সার্বিক সুরক্ষা ও কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা নাগরিকদের ওপর যদি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চলে তাহলে তার অবসান করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা নীতি গ্রহণ করার দায়দায়িত্বও রাষ্ট্র এবং সরকারের ওপর বর্তায়। পৃথিবীর দেশে দেশে জাতীয় রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশের কারণে কঠিন সংকট মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের। এ এক করুণ বিড়ম্বনা।