শিশুর হাতে রঙপেন্সিল বা বই তুলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 6 Sept 2021, 03:47 PM
Updated : 6 Sept 2021, 03:47 PM

আমি একটা প্যারেন্টিং গ্রুপ ফলো করি। সেখানে আসা পোস্টগুলোর একটা বড় অংশই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল বা গেজেট দেওয়াটা কত ভয়ংকর ভুল, কেমন করে তাদেরকে গেজেট ও টেলিভিশন থেকে দূরে রাখতে হবে সেই সংক্রান্ত। এই পোস্টগুলো আর সেগুলোকে বাহবা জানিয়ে দেয়া অভিভাবকদের মন্তব্য পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমার কষ্টই হয়। আমাদের শিক্ষিত বা শহরাঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ বাবা-মা শিশুদের গ্যাজেট এবং টেলিভিশন থেকে দূরে রাখা, বাচ্চা কিচ্ছু খায় না বলে ঠুসে ঠুসে খাওয়ানো আর পড়ালেখা গেলানো নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ মনে করেন, গ্যাজেটে অ্যাকসেস না থাকলেই বাচ্চারা শারিরীকভাবে সুস্থ, সুন্দর মানসিকতা সম্পন্ন, মানুষের মতো মানুষ হয়ে বড় হবে।

এই বাবা-মায়েরা অবশ্য ছোট্ট শিশুদের হাতে রঙপেন্সিল বা গল্পের বইও দেন। নিঃস্বন্দেহে বিষয়টি প্রশংসনীয়। তবে শিশুর মন-মানসিকতার সৃজনশীল বিকাশের চেয়ে তাদের মনোযোগকে গেজেট বা টিভি থেকে সরিয়ে রাখাই এর মূল কারণ বলে ধারণা করি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রঙপেন্সিল বা বই ছোট্ট শিশুর হাতে ধরিয়ে দিয়েই অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব সারেন। এগুলো যেন তাদের মনের বিকাশের খোরাক হয় তা নিশ্চিত করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া বা সময় দেয়া প্রয়োজন তা কতজন দেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

সহজ উদাহরণ দেই। যারা শিশুর হাতে রঙপেন্সিল দেন, তারা কি সবাই শিশুকে হাতে ধরে ছবি আঁকা বা রঙ করা শেখান? না, শেখান না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা বা অভিভাবকরা নিজেরা আঁকিয়ে নন। তাদের এ বিষয়ে দক্ষতা নেই। তাই শিশুর হাতে রঙপেন্সিল দিয়ে তারা মনে করেন আমার কন্যা বা পুত্র এগুলো নিয়ে যা ইচ্ছা তা আঁকুক, নিজের মতো ব্যস্ত থাকুক। শুধু টেলিভিশন বা মোবাইল না দেখলেই চলবে। এই অভিভাবকরা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে খেয়াল করেন না বা পাত্তা দেন না। নিজে নিজে এটা-সেটা আঁকাআঁকি বা দাগাদাগি করা শিশুর মন বা বুদ্ধির বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। তাকে সোজা করে লাইন টানা শেখাতে হবে, একটা ছবি ধৈর্য ধরে গুছিয়ে আঁকা, রঙ করা, ফিনিশিং দেয়া– এগুলো প্র্যাকটিস করাতে হবে। তবেই তার মধ্যে হাতের আঙ্গুল, পেন্সিল বা কলম ব্যবহারের দক্ষতা সৃষ্টি হবে। সে একটা কাজ মন দিয়ে করতে শিখবে। শিশুটি আগের চেয়ে সুন্দর করে ছবি আঁকার বা রঙ করার যত চেষ্টা করবে তত তার সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে।

মজার ব্যাপার হলো, এই যে অসংখ্য অভিভাবক গেজেট এবং টেলিভিশনকে শিশুর জন্য ক্ষতিকর বস্তু মনে করে সেগুলো থেকে তাদের সরিয়ে রাখছেন, তারা কিন্তু উল্টো এগুলোকেই শিশুকে ছবি আঁকা বা পেপার ক্রাফ্ট বানানোর বেসিক টেকনিক শেখাতে ব্যবহার করতে পারেন। প্রযুক্তির যুগে শিশুদের প্রাথমিক ধারণা দিতে নিজের এসব সৃজনশীল কাজ না জানলেও চলবে। সন্তানের বয়স অনুযায়ী ইউটিউব ভিডিও শুধু খুঁজে বের করতে হবে। অভিভাবক প্রথম প্রথম নিজে পাশে বসে ভিডিও অনুযায়ী শিশুকে নির্দিষ্ট ছবি আঁকতে বা পেপার ক্রাফট বানাতে শেখাবেন। কিছুদিন পর তাকে শুধু ভিডিও বের করে দিলেই হবে। একবার মজা পেয়ে গেলে সে নিজে নিজেই সেখানকার ইন্সট্রাকশন ফলো করে আঁকাআঁকি করতে বা কাগজ দিয়ে ওরিগামি বানাতে থাকবে। এ পর্যায় থেকে অভিভাবক শুধু শিশুটির গেজেট দেখার সময় ও কনটেন্টকে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। এই কাজগুলো সঠিকভাবে করা গেলে দেখা যাবে একসময় শিশুটি ইউটিউব দেখা ছাড়াই নিজের সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করে নিত্যনতুন ছবি আঁকছে, ক্রাফট বানাচ্ছে।

একই কথা বই পড়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শুধু বই হাতে ধরিয়ে দিলেই হবে না, অভিভাবকদের আগে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদে সবাইকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শুধু তাহলেই তারা শিশুর হাতে বই তুলে দেয়ার সময় এই বই বা গল্পের বিষয়বস্তু শিশুর সুস্থ ও সুন্দর মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হবে নাকি উল্টো নারীকে অবলা মনে করতে শেখাবে বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে শেখাবে তা অনুধাবন করতে পারবেন। রুপকথার গল্পে বন্দী রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে গিয়ে রাজকুমার রাক্ষস-খোক্কশের মাথা কাটছে– এই বর্ণনার মধ্যে নারীকে অসহায়-অবলা হিসেবে দেখা এবং ছোট্ট শিশুর কাছে খুনোখুনিকে নরমালাইজ করার প্রবণতা যদি বাবা-মায়েরা অনুভব করতে না পারেন বা তারা যদি মহোৎসাহে 'বর আসবে যখনই নিয়ে যাবে তখনই' টাইপ ছড়াওয়ালা বই তার হাতে দেন, তাহলে বলতেই হবে শিশুর হাতে বই তুলে দিয়ে এই অভিভাবকরা তার কল্পনাশক্তির বিকাশ করা বা তাকে সুন্দর মানসিকতাসম্পন্ন করে বড় করে তোলার যে স্বপ্ন বুনছেন তা বাস্তবে রূপ নাও পেতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুকে ছবি আঁকতে বা বই পড়তে উৎসাহিত করার জন্য নিজেকেও সেগুলো ভালোবাসতে হবে। অভিভাবককেও সেগুলোর চর্চা করতে হবে। এই ভালো অভ্যাসগুলো কেবল শিশুকে গেজেট বা টিভি থেকে সরিয়ে রাখার উপায় ভাবলে হবে না। শিশু বইয়ের পাতা ছিড়লে বা অযথা রঙ নষ্ট করলে তাকে বোঝাতে হবে যে এই কাজটা ঠিক না। যাক, কিছু একটা নিয়েতো ব্যস্ত আছে– এটা ভেবে এগুলো চালিয়ে যেতে দিলে একসময় এই খারাপ অভ্যাসগুলোই তার ভেতর প্রথিত হয়ে যাবে। এর ফলে ভালোর বদলে উল্টো খারাপ হবে। অন্যদিকে আঁকাআঁকি করা বা বই পড়া এমন একটা অভ্যাস তা যদি পরিবারের সবাই মিলে চর্চা করা হয় তাহলে সেগুলো পুরো পরিবারের জন্যই আনন্দের উৎস হয়ে যেতে পারে।

কিছুদিন আগে আমাদের ছোট কন্যার বয়স এক বছর হয়েছে। লকডাউনের মধ্যে কোনো বড় আয়োজন সম্ভব নয়। তারপরও ঠিকই আমরা পরিবার-পরিজন-বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মী সবাইকে একত্রিত করে তার জন্মোৎসব পালন করেছি। কীভাবে? দেয়ালে টাঙানোর জন্য জন্মদিনের ব্যানার, দাওয়াত কার্ড, নকশির মাথায় পরার মুকুট– এগুলো সবই আমরা আমাদের নয় বছর বয়সী বড় কন্যাসহ রঙ-বেরঙয়ের কাগজ দিয়ে বানিয়েছি। আইডিয়া নিয়েছি ইন্টারনেট থেকে। সেখানে থাকা অসংখ্য কনটেন্ট থেকে পছন্দসই এবং সহজে বানাতে পারব এমন ডিজাইন বেছে নিয়ে মনের মতো করে কাস্টমাইজ করেছি। হাতে বানানো ডেকোরেশন পিস দিয়ে ঘর সাজিয়েছি। অন্যদিকে জুম কনফারেন্স কলে জন্মদিনের কেক কাটার সময় দেশ-বিদেশ থেকে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের অনেক প্রিয়জন। ব্যস, এভাবেই সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে হয়ে গেল এক জমজমাট জন্মদিনের আয়োজন। এটা কিন্তু প্রযুক্তির বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। লকডাউনের ভেতর পালন করা আমাদের কন্যার প্রথম জন্মদিন তাই সবার মনে থাকবে। হাতে বানানো কার্ড বা ব্যানার তা যতই আনাড়ি কাজ হোক, এসব বানাতে গিয়ে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি। আর এগুলো দেখে সবাই মুগ্ধই হয়েছে। অন্যদিকে, আমাদের প্রিয়জনেরা সাজগোজ করে স্ক্রিনের সামনে বসে কেক কাটা দেখল, তালি দিলো– এরতো মজাই আলাদা। একটা রেস্টুরেন্টে ডিজিটাল ব্যানার টাঙিয়ে সবাইকে নিয়ে সামনাসামনি জন্মদিন আয়োজন করলে তা কিন্তু এতটা মনে দাগ কাটতে পারত না।

তাই আবারও বলি, গেজেট বা টিভি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং এগুলোর ভুল বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। এটিকে সচেতনভাবে পরিহার করে টেকনোলজি আর সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। টেকনোলজির যুগে এর ভালো দিকগুলো থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখা ঠিক নয়। এর ফলে তারা পিছিয়ে পড়বে। বরং শিশুকে এগুলোকে ব্যবহার করে নিত্য নতুন স্কিল অর্জনের সুযোগ দেয়া উচিত। নিজেদেরও এগুলো শেখা দরকার। সন্তানের সঙ্গে সৃজনশীল কাজে অভিভাবকরা অংশ নিলে সেখান থেকেই তারা একত্রে খুঁজে নিতে পারবেন আনন্দ, মানসিক শান্তি। এর মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনও মজবুত হবে।