শিরীষতলা: ফুসফুস বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 29 August 2021, 07:17 AM
Updated : 29 August 2021, 07:17 AM

আমার জন্ম দেশের অন্যতম সুন্দর শহর চট্টগ্রামে। নামের সাথে গ্রাম শব্দটা কেন আছে তার উত্তর দেবে ইতিহাস। কিন্তু জন্ম থেকেই দেখেছি বিস্তৃত হবার জন্য অধীর আগ্রহে থাকা এই শহরের নান্দনিক সৌন্দর্য। একদিকে বঙ্গোপসাগর আরেক দিকে শৈলমালা। শহর থেকে পা বাড়ালেই সমুদ্রের জলে পা ভেজানো যেমন সম্ভব তেমনি আরেক প্রান্তে পা বাড়ালেই আকাশে হেলান দেয়া পাহাড়ের সারি।

একেবারে পুরনো আমলের কথা বাদ দিয়ে যদি ইংরেজ শাসনকাল থেকে শুরু করি তবে জানব; পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নবাব মীর জাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে, মীর জাফর কোনোভাবেই ইংরেজদের চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে রাজি হননি। ফলে, ইংরেজরা তাকে সরিয়ে মীর কাশিমকে বাংলার নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র করে। ১৭৬১ সালে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব হয়ে ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম হস্তান্তরিত করেন। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খান সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পণ করেন। শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।

এই শহরের নানা হেরিটেজ ভবনের একটি রেলওয়ে ভবন। ১৮৭২ সালে ইংরেজদের হাতে নির্মাণ সম্পন্ন হবার পর এটি হয় রেলওয়ের অন্যতম প্রধান ভবন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রেলওয়ের পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে আরো ইতিহাস। আমি জন্মেছিলাম এই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা মূলত বিহার থেকে আগত হিন্দু রেল কর্মচারীদের আবাসভূমি গোয়ালটুলির এক প্রান্তে। সে সময় এলাকাটি ছিল সবুজঘেরা মায়াময়। আমাদের টিনের চালার বাসার সামনে ছিল বিশাল কয়েকটি গাছসহ বিস্তৃত উঠান। কালক্রমে আমার শৈশব পেরুনোর পর আমরা সেই এলাকা থেকে চলে আসি। আমার প্রথম স্কুল যাওয়া এখান থেকেই। রেলওয়ে কলোনির বুক চিরে চলে যাওয়া সরু রাস্তা ধরে আসা-যাওয়া করতাম। একাত্তরে এই কলোনির দুই যুবক যাদের একজন আমার মেঝদি'র সহপাঠী আরেকজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ হন। তাদের একজন মনোয়ার ভাই মারা যান বাড়ির দরজায়। পাক বাহিনীর ছুটে আসা গুলিতে শহীদ হন মা-বাবার একমাত্র পুত্র। অন্যজন লড়াকু ছাত্রনেতা। সে সময় এখনকার মতো মুজিব কোটের চল ছিল না। যারা তা পরিধান করতেন তারা আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলেই তা করতেন। আবদুর রব নামের ছাত্রলীগের সেই তুখোড় নেতা মুজিব কোট পরতেন। আমাদের বন্ধু গদ্যলেখক জাকির হোসেন বুলবুলের বড় ভাই ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাবার কালে পাক বাহিনীর হাতে নিহত এই শহীদের নামে নামকরণ হয় এই এলাকার। নাম হয় শহীদ আবদুর রব কলোনি। গোয়ালটুলির ঘোষদের ছেলে গঙ্গারাম ও শহীদ হন পাক বাহিনীর গুলিতে। এই তিন শহীদের খুনে পবিত্র এলাকা এতদিন শান্তিতে তার নিজের মতো চলে আসছিল।

সমস্যা বাড়ানো বা তৈরি করা এখন আমাদের সমাজ ও সমাজপতিদের দায়িত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা যারা চট্টগ্রামের মানুষ সবাই জানি এত ধনী আর বড়লোক নামে পরিচিত ব্যবসায়ী আমলা কিংবা পুঁজিপতির এই শহরে পাঁচতারা চারতারা হরেকরকম হোটেল আছে। আছে বিনোদন আর জৌলুসের ছড়াছড়ি। এই শহরের নতুন সব শপিং মলে গেলে নিজেকে ফকির মনে হয়। দুনিয়ার হেন কোনো ব্র্যান্ড বা দামি জিনিস নাই যা এখানে মিলবে না। অথচ এই ধনীদের শহরে পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই। নেই চিকিৎসার মতো জরুরি বিষয়ে কোনো উদ্যোগ। বাড়তে থাকা চট্টগ্রাম শহরে আগ্রাবাদ, মনসুরাবাদ, হালিশহরে এখন তিল ধারণের ঠাঁই নাই। অথচ সেখানে কোনো হাসপাতাল নাই। হাসপাতাল নাই বহদ্দারহাট বা আশেপাশের এলাকায়। হাসপাতাল যা আছে তার ভেতর জেনারেল হাসপাতাল দেখলে মনে হয় এখনো মধ্যযুগে আছি আমরা। রেলওয়ের যে হাসপাতাল তা আসলে আছে কি নাই বোঝা মুশকিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একটি হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি বটে কিন্তু তা কোথায়? কেন আপনারা আগ্রাবাদের হাসপাতালের সংস্কার করে সেখানকার খালি জায়গায় নতুন কিছু করার কথা ভাবেন না?

প্রাইভেট হাসাপাতাল কারা নির্মাণ করেন আর কেন করেন এটা বোঝার জন্য কোনো গবেষণার দরকার পড়ে না। তাদের কুনজর এখন পড়েছে রেলভবনের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া কলোনি ও গোয়ালপাড়ার দিকে। এখানে দুটো কথা বলা দরকার। প্রথমত জনসংখ্যার চাপে ভেঙে পড়া চট্টগ্রাম শহরে ভালো করে নিঃশ্বাস নেবার জায়গা বাকি নাই। যতবার দেশে যাই প্রাণের শহর চট্টগ্রামের দশা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। ছেলেবেলায় আমি দেখেছি এনায়েত বাজারের মুখে বড় বড় বাদাম গাছের সারি। বাদামতলা নামে পরিচিত ওই এলাকা থেকে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা বা বেবি ট্যাক্সি ভাড়া করা যেত। আর একটু এগুলে ঝাউতলায় ছিল ঝাউগাছের সারি। রেল ভবনের আরেকপাশে ছিল কদমতলী। কদম গাছগুলো কবেই উধাও হয়ে গেছে। আছে শুধু তলী। এই সবুজ অক্সিজেন বঞ্চিত শহরটিতে হাসপাতাল নির্মাণের নামে শেষ সবুজটুকু কেড়ে নিতে কালো হাত বাড়ানো হয়েছে। যার পেছনে কল্যাণের চাইতেও লুকিয়ে আছে ভয়াবহ পরিণতি।

এই জায়গাটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক যারা শিল্প-সংস্কৃতি বোঝেন তারা স্পষ্ট দেখতে পান। সে কারণে দল-মত এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা একযোগে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। নানা প্রতিবাদে মুখর করে রেখেছেন সিআরবি নামের এই জায়গাটির শিরীষতলা। এই শিরীষতলা এখন বিখ্যাত এক সংস্কৃতিতীর্থ। আমি যখন দেশ ছাড়ি তখনো এখানে সে প্রক্রিয়া দানা বাঁধেনি। আমার শৈশব যৌবনে এমনকি চাকরি জীবনের একটা সময় সে এলাকায় কাটানোর কারণে আমি জানি কতটা নির্জন আর শান্তির এলাকা সেটি। রাত-বিরাতে ভয়েও কেউ সেদিকে পা বাড়াতেন না। পাকিস্তান আমলে নির্জন বলে এখানে ছায়াছবির শ্যুটিং করা হতো। আমি নিজে দেখেছি পাকিস্তানের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াহিদ মুরাদকে। কালক্রমে কিছুটা ব্যস্ত হলেও এ জায়গাটি সুন্দর ও মনোরম করে তুলেছেন চাটগাঁর শিল্পপ্রেমী মানুষেরা। বলাবাহুল্য এর আগে শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান নামে পরিচিত ডিসি হিলের জায়গাটি কৌশলে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন তাদের আগ্রাসনের মুখে শিরীষতলা।

একটা বিষয় বোঝা মুশকিল যে, সরকার এবং যে দলগোষ্ঠীকে মসনদে আসীন করার জন্য শিল্প-সংস্কৃতির মানুষরা জান দিয়ে কাজ করেন তাদের অর্জন বিনষ্ট করে তাদের বিপন্ন করতে এরা কেন অগ্রগামী। কথাটা বললাম এই কারণে যে, সরকারের একজন সচিবকে দেখলাম সবুজ এবং চট্টগ্রামের ফুসফুস বাঁচানোর কাজে এক হয়ে ওঠা সম্মানিত মানুষদের হেয় করে কথা বলতে। ড. অনুপম সেনের মতো দেশবরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী যেখানে পুরোধা সেখানে সচিব যে ভাষায় তাচ্ছিল্য করে সব উড়িয়ে দিলেন তাতে সত্যি মর্মাহত হতে হয়। সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা নিশ্চয়ই পরিবেশ ও বাস্তবতা জানেন ও বোঝেন। তারপরও কেন এই গড়িমসি? কেন এই নাছোড়বান্দা মনোভাব?

পৃথিবীর যত শহর দেখেছি তার সবকটিতেই মানুষের নিঃশ্বাস ফেলা ও অক্সিজেন নেয়ার মতো সবুজ আছে। জনভারে ক্লান্ত কলকাতায় আছে গড়ের মাঠ। ঢাকায় আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক। চট্টগ্রামে মরমর হয়ে বেঁচে আছে প্যারেড গ্রাউন্ড। চারদিকে শুধু দালানপাট আর বাড়িঘর। শিশু, কিশোর-কিশোরী সন্ধ্যায় শিরিষতলা জমিয়ে রাখা তারুণ্য পহেলা বৈশাখ বা বিশেষ বিশেষ দিনে সমবেত শুদ্ধ মানুষদের জমায়েত কি কিছুই না? সবকিছুর চাইতে বড় জেদ? এখনো সময় আছে। অন্য কোথাও হাসাপাতাল হোক। শেষ সবুজটুকু বাঁচিয়ে জনগণের মনের কথা বুঝে শিরীষতলাকে রাখা হোক বিপদমুক্ত। ধরিত্রীর স্বার্থে, চট্টগ্রামের স্বার্থে এবং জনকল্যাণের জন্য এটা এখন জরুরি। এবারও কি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছেই যেতে হবে? না বোধোদয় ঘটবে সবার?