তালেবানদের অধিকারে গেল আফগানিস্তান!

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 20 August 2021, 05:46 PM
Updated : 20 August 2021, 05:46 PM

"আফগানিস্তান একান্তই 'আফগান'দের। আফগানিস্তান নিয়ে ভাবনা তাই তাদের উপরই ছেড়ে দিন!"

                                                                         – আফগানিস্তান নিয়ে বিদেশি পত্রিকার শিরোনাম

শুধু 'তালেবান'রাই আফগান নন, সেদেশে আরও অনেক গোত্র এবং উপ-গোত্রের মানুষ আছে। আফগানিস্তান নিয়ে আপাতত আফগানদের ভাবনা সুযোগ পেলেই 'আফগানিস্তান' ছেড়ে পালানো বলেই মনে হচ্ছে। আর তাই সারা পৃথিবীতে এখন আফগানদের পরিবর্তে তালেবানদের নিয়েই আলোচনা চলছে। একদল বলছে তারা আফগানিস্তান দখল করেছে। আরেকদল বলছে বিজয়ের পর তালেবানরা ফিরে এসেছে! সবচেয়ে বেশি মজা করছে মানুষ এটা বলে যে, তালেবানরা ২০ বছরের জন্য আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিজ দিয়েছিল। এই বিশ বছরে মার্কিনরা ভালো কিছু রাস্তা বানিয়েছে। সৈন্যদের থাকার জন্য বাসস্থান এবং ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করেছে, আধুনিক অস্ত্র এনেছে। চীন আর ভারতও কম যায় না। তারা হাজার কোটির টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এখন সবকিছু তালেবানরা ফ্রি পাবে!

এর আগে রাশিয়াও এসেছিল আফগানিস্তানকে 'বশ' করতে। রাশিয়াকে সাহায্য করেছিল আফগানিস্তানের বাম দলের কিছু নেতা। পরে এদের আম-ছালা সবই গেছে। যাবার সময় রাশিয়ানরাও আফগানিস্তানের সম্পদ লুট করে নিয়েছিল, মাইন পুতে গিয়েছিল বহু জায়গায়! রাশিয়ার দখলদারিত্বের সময়েই পাকিস্তান আর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশের আহবানে আফগানিস্তানে 'গোপন সাহায্যে'র নামে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রই বিশ বছর পর এবার রণে ভঙ্গ দিয়েছে আর এর বিপরীতে এখন কয়েক হাজার 'তালেবান' যোদ্ধার গুণগান গাওয়া হচ্ছে। অনেকেই হয়তো ধারণা করেন তবু এটা সত্য যে তালেবানদের মার্কিনরাই এনেছিল, তারাই আবার আফগানিস্তানকে তাদের হাতে দিয়ে চলে গেল। রাশিয়া যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রও তাই করেছে। আফগানিস্তানের ব্যাংকের সব রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গেছে বলেই শোনা যাচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে তালেবানরা এখন আর জঙ্গি নয় তারা এখন রাজনৈতিক শক্তি! মার্কিনদের অনুপস্থিতিতে আফগানিস্তানের প্রকাশ্য বন্ধু এখন রাশিয়া আর 'আন্ডারগ্রাউন্ড' বন্ধু এখন চীন। হায় প্রেম, হায় রাজনীতি আর হায় যুদ্ধ! শেষ কথা বলে কিছু আর থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের তিনলাখ মানুষকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এদের অধিকাংশ মানে প্রায় পঁচাশি হাজার (বিবিসির মতে পঞ্চাশ হাজার) তালেবান যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ভিয়েতনামে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক যান রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনি আফগানিস্তানে মার্কিনিদের ফেলে আসা হামফ্রে ভ্যান ও সিকোরস্কি হেলিকপ্টারগুলো এখন তালেবানরা চালাবে। তালেবানদের সাহায্যের নামে যুক্তরাষ্ট্রের টাকায় অস্ত্র কিনে নিজ সেনাবাহিনীকে উন্নত করতে পেরেছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে ভারতের লগ্নি করা টাকায় গড়ে উঠেছে আফগানিস্তানের রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি কিংবা এয়ারপোর্ট। পার্লামেন্ট বিল্ডিং হলেও হাইডেল ড্যাম এখনও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি ভারত। ড্যামসহ কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে যখন চিন্তায় ভারত, তখন চীন উঠে এসেছে অন্যরকম আলোচনায়।

সিএনএন-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী আফগানিস্তানে মার্কিনিদের ফেলে যাওয়া রেস্ট হাউজ, রাস্তা, অস্ত্র আর ভারতের অরক্ষিত বিনিয়োগের সাথে 'সম্ভাবনা' হয়ে দেখা দিচ্ছে চীনের স্বার্থ। চীনের সাথে তালেবানদের ঠিক কী ধরনের সমঝোতা হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে নারী শিশুদের কপাল যেমন ছিল তেমন থাকবে না! স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তালেবানধর্মে নারীদের যে স্থান তাদের সেখানেই রাখা হবে! এই 'সেখান'টা কী ঘরবন্দী? সব কাজ থেকে নারীদের ফিরিয়ে আনা হবে? ক্ষমতায় পুরোপুরি আসার আগেই দেখা গিয়েছে মার্কেট বা দেয়ালে বিজ্ঞাপনজনিত কারণে যে নারীদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল সেসব মুছে ফেলা হয়েছে। তালেবানরা ফেরার আগে আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন একজন নারী। জানা গেছে ইতোমধ্যে তের বছরের বেশি বয়সী কিশোরীদের তালিকা করা হয়েছে। এর বেশি বয়সী মেয়েদের ধর্ম শিক্ষা ছাড়া আর কিছু করার দরকার নেই বলে আজও মনে করে তালেবানরা। নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় বলীয়ান হলে তালেবানদের কী সমস্যা হতে পারে এটা নিয়ে আগের 'তালেবান' আমলের কোনো গবেষণা হয়তো নেই।

আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের প্রতিরোধে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই গিয়েছিলেন আফগানিদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে যাদের বলা হতো 'মুজাহিদ'। একটি পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত তেত্রিশ জন এমন মুজাহিদের কবর আছে আফগানিস্তানে যার ভেতরে এদেশের এক নামকরা ধর্মীয় নেতার ছেলেও আছেন। প্রশ্ন হচ্ছে যারা আগে থেকেই 'তালেবান'মনষ্ক ছিলেন অথবা তালেবানদের ফিরে আসাতে উজ্জীবিত হয়ে আবারও তাদের দিকে ঝুঁকবেন, বাংলাদেশটাকে তারা কীভাবে দেখতে চাইবেন? নতুন করে আবারও জমিয়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আরসার আল ইসলামী অথবা হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠনগুলো উজ্জীবিত হবে?

প্রেম এবং বিজয়ের উল্লাস সবসময় চোখে পড়ে। এবার তালেবানদের ফিরে আসায় উল্লাসের পরিবর্তে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যই সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের কেউ বিমানে করে পালাতে চেয়েছে, কেউ বিমান থেকে পড়ে মারা গিয়েছে, কেউ বিমানে উঠতে গিয়ে মারা গিয়েছে। কেউ কেউ আফগান শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পালাচ্ছে। তালেবান যতই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করুক, রাজধানীতে ফেরার পথে অনেকেই তাদের হাতে নিহত হয়েছে। এই দেশত্যাগ নিয়েও রাজনৈতিক কৌতুক আছে যা পরে বলা যাবে।

তালেবানরা ফেরার পর কী ঘটতে পারে আফগানিস্তানে? তারা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তারা যে শরিয়া আইন চালু করেছিল তা অনেক ইসলামী দেশের সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। নারী, শিশু, শিল্পকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ছায়াছবি বা নাটকের প্রতি তালেবানরা ছিল নির্মম। তালেবানদের সাথে জড়িয়ে থাকা কয়েকলাখ মানুষ ছাড়া কেউ আর তাদের সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষী নয় কিংবা ছিল না। আগ্রাসনকারীদের কেউ সমর্থন করে না। প্রথমে রাশিয়া ও পরে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশিরভাগ আফগান যেমন পছন্দ করতে পারেনি তেমনি তালেবানদের প্রতি তাদের উষ্মাও ছিল স্পষ্ট। মার্কিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তালেবানরাই শুধু জাতীয়তাবাদী নন। আরও অনেকে লড়েছেন তাদের বিরুদ্ধে। আরও অনেক জাতি-গোত্র আছে আফগানিস্তানে যারা তালেবান সমর্থক নয়। মিয়ানমারের মতো আফগানিস্তান আরেক দেশ যার ওপর সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গত বিশ বছরে এমন কিছু গোত্র ছিল যারা তাদের মতো স্বাধীন থেকেছে। শুধু শরিয়া আইন দিয়ে আফগানিস্তানের সব নাগরিক, গোত্র-উপ গোত্রদের এক রাখা কখনোই সম্ভব না। কিন্তু আফগান নাগরিকদের পলায়নের যে দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে তাতে মনে হয়েছে নির্মম ও বর্বর একটা শক্তি ক্ষমতায় ফিরেছে। গতবারের সাথে তাদের এবারের শাসনামলের মিল থাকবে কতটা? তারা কী এবারে বেশি সহনশীলতা দেখাবে?

যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈন্য প্রত্যাহারের আগেই তালেবানরা আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে। রাশিয়ার আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরও নজীবুল্লাহ সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল, রাজধানী কাবুলসহ দেশের কিছু এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবারে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈন্যটা যাওয়ার আগেই তালেবানরা রাজধানীতে প্রবেশ করে রাষ্ট্রপতির ভবনসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তাহলে মার্কিনদের সাথে কী তালেবানদের আগেই আলোচনা হয়েছিল? এবারের তালেবানরা কী কূটনীতির কোনো এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে?

তালেবানরা এতদিন অর্থ সংগ্রহের জন্য পপিচাষ করত। তারা আগেও এটা করেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। টাকার কোনো ধর্ম নেই। সবার কাছে সে প্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি নাকি চার গাড়ি ও হেলিকপ্টার ভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। দুর্ভাগ্য তিনি নাকি এক গাড়ি টাকা ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার মতো আফগান সেনানায়ক ফিল্ডমার্শাল (?) দোস্তাম পালিয়েছেন তার সব মেডেলসহ। পলায়নের জন্যও তাকে একটা মেডেল দেয়া যেতে পারে!

তালেবানরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সারাবিশ্বের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অভায়ারণ্য গড়ে উঠেছিল আফগানিস্তানে। ওসামা বিন লাদেন ও পরবর্তীকালে আইএস ছাড়াও কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন ঘাঁটি গেড়েছিল আফগানিস্তানে। এবারও কী তেমন হবে নাকি তালেবানরা যা বলছে সেটা তারা করে দেখাবে? তালেবানদের মুখপাত্র জানিয়েছে তারা তাদের মাটিতে কাউকে ঘাঁটি গাড়তে দেবে না। কিন্তু পাকিস্তান বা আইএসআই-এর মদদপুষ্ঠ পাকিস্তান আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে তাদের ব্যাপারে তালেবান কী সদয় থাকবে? সারা পৃথিবীতে ইসলামী জঙ্গিখ্যাত যারা আছে তালেবানদের বিজয়ে তারা কী প্রাণ পাবে আরো? যারা এদেশে জমিয়াতুল মুজাহিদীন, আনসার আল ইসলাম কিংবা হরকাতুল জিহাদের নামে বোমা হামলা ও মানুষ খুন করেছিল নতুন করে তারা কী আবার মাঠে নামবে?

আফগানিস্তানের কপালে কী আছে তা আফগানরাই ভাবুক। কতলোক দেশ ছেড়ে পালালো তার পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা কী করব? নারী ও শিশু, শিল্প ও সিনেমা, নাটক ও গান সেখানে কীভাবে টিকে থাকবে আপাতত সেটা না ভেবে আমরা একটা গল্প শুনে বিদায় নেই।

আবদুল গনি সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন বিমানের টিকেট কিনতে। দেখলেন লম্বা লাইনে হাজারো লোকের ভীড়। তিনি উসখুস করতে লাগলেন। তাকে চিনতে পেরে এক লোক এসে জিজ্ঞাসা করলো-

– স্যার আপনি কী বিদেশ যাবেন?

– হ্যাঁ।

মুহুর্তেই যেন চারিদিকে হ্যাঁ হ্যাঁ রব প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। হাজারো মানুষের লম্বা লাইন খালি হয়ে গেল নিমিষেই। টিকেট কাউন্টারে বসা লোকটাকে আব্দুল গনি জিজজ্ঞাসা করলেন-

– সবাই দৌড় দিয়ে উল্লাস করতে করতে চলে গেল কেন?

টিকেটের লোকটা বলল-

– আপনিই যদি চলে যান তাহলে আর কারো তো দেশ ছাড়ার দরকার হয় না!!