পোশাক শিল্প বাঁচাতে কন্টেইনার জট সমস্যার টেকসই সমাধান প্রয়োজন

আশিকুর রহমান তুহিন
Published : 14 July 2021, 07:13 AM
Updated : 14 July 2021, 07:13 AM

চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ও জাহাজ সংকটের কারণে যথাসময়ে পণ্য পাঠাতে না পারায়, রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন বহু তৈরি পোশাকশিল্প মালিক। পোশাক কারখানায় রপ্তানি পণ্য তৈরি করে চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোগুলোতে পাঠানোর পরে দিনের পর দিন সেখানেই পড়ে থাকছে। এ সংকটের কারণে বিজিএমইএর অনেক সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি পণ্যের চালান আইসিডিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত পড়ে থাকায় রপ্তানি আয় পাননি এমনও হয়েছে।

 সাধারণত আইসিডি থেকে জাহাজে তোলার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কোন কনটেইনার পাঠাতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে। সেখানে  বর্তমানে ১০ দিন বা তারও বেশি লাগছে। বিদেশি ক্রেতাদের হাতে পণ্য বুঝিয়ে দিতে অনেক ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্তও সময় লাগছে। এ কারণে নগদ অর্থ সংকটে ভুগছে অনেক পোশাক তৈরি কারখানা। এছাড়া সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে না পারায় কারখানার উৎপাদনেও বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

কনটেইনার সংকটের পাশাপাশি করোনা মহামারীর কারণে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে কনটেইনারের স্তূপ জমেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যেসব ফিডার জাহাজ এ দুই বন্দরে কনটেইনার নিয়ে যায় সেগুলো থেকে খালাসে দেরি হচ্ছে। ফলে কনটেইনার নিয়ে একেকটি জাহাজকে এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক মেইন লাইন অপারেটর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার বুকিং ও পরিবহন স্থগিত রেখেছে অথবা কমিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার বন্দরে নিয়ে সেখান থেকেই মাদার ভেসেলে তুলে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে লোকসান এড়াতে অনেক মেইনলাইন অপারেটর (এমএলও) ভাড়ায় নেওয়া তাদের খালি কনটেইনারগুলো ছেড়ে দিয়েছে। রপ্তানি কনটেইনারের সংকট দেখা দেয়ার পেছনে এটাও একটি কারণ। 

এদিকে সিঙ্গাপুর বন্দরে কনটেইনার জমে যাওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এক মাসের জন্য আমদানি কনটেইনারের নতুন বুকিং বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে জার্মান প্রতিষ্ঠান হ্যাপাগ লয়েড। এতে অন্যান্য লাইন অপারেটরগুলোর কনটেইনার চাপ ও খরচ দুটিই বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে চীনসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যবাহী অনেক কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আসার জন্য সিঙ্গাপুর বন্দরে অপেক্ষায় আছে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। 

আরও একটি বিষয় হলো ঈদের ছুটিতে পোশাক তৈরি কারখানাগুলো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে। এজন্য ঈদের আগে বাকি সময়ের থেকে প্রায় দ্বিগুণ পণ্য রপ্তানি করে রাখার চেষ্টা করা হয়। যাতে তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর ঈদের লম্বা ছুটির প্রভাব তেমন না পড়ে। একে তো করোনা মহামারী, তার ওপর ঈদের আগে কন্টেইনার জট- সবকিছু মিলিয়ে যেন মরার উপর খাড়ার ঘা পরিস্থিতি।

পণ্য রপ্তানি সমস্যা নিরসনে সম্প্রতি জাহাজ ও কনটেইনার সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের জেটিতে অতিরিক্ত আরও একটি বা দুটি কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্দর থেকে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রায় দুই হাজার খালি কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট ফেরত পাঠানো এবং একই সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় মেইন লাইন অপারেটরগুলোকে (এমএলও) বন্দর থেকে বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে রপ্তানি পণ্য পরিবহণ বাড়াতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এসব উদ্যোগে সংকটের কিছুটা সমাধান আপাতত হয়তো হবে।

কিন্তু আমার মতে, এ সংকট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই সমাধান দরকার। পৃথিবীর দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে শীর্ষস্থানীয় মেইন লাইন অপারেটর কিংবা ভেসেল কোম্পানিগুলোকে চলমান সমস্যাকে বিবেচনায় আনতে হবে। সুদূর চীন থেকে মাদার ভেসেলগুলো বাংলাদেশমুখী হওয়ার সময় যদি পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ না নিয়ে আসে তাহলে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে না। পিক বা অপ পিক যেকোনো সময়ের জন্য মাদার ভেসেলে বাংলাদেশের জন্য চাহিদা অনুযায়ী পরিসর দরকার। চট্টগ্রাম বন্দর এবং রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদ্যোগী হলে আমরা একটা কার্যকর সমাধানের রূপরেখা পাবো। পোশাক শিল্প বাঁচাতে শুধু চলমান জটিলতা নয়, কন্টেইনার জট সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিটি ধাপে প্রতিটি দিন, প্রতি ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত দেশের অগণিত মানুষ। বাংলাদেশের অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন হয় এ খাত থেকেই। ফলে এই সংশ্লিষ্ট সমস্যার দ্রুত ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

করোনা মহামারী শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং সার্বিক সহযোগিতায় অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তৈরি পোশাক শিল্প। কনটেইনার ও জাহাজ সংকটের মতো বিষয়গুলো দীর্ঘায়িত হলে আবারো বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে তৈরি পোশাক শিল্প। করোনা মহামারীর মতো বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, যেসব জায়গায় হাত দেওয়ার এবং উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে সেগুলো নজরে এনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরই দেশের একমাত্র নৌ-বন্দর যেখান দিয়ে দেশের সব পোশাক রপ্তানি করা হয়। কিন্তু প্রয়োজন মোতাবেক সেখানের সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা, কনটেইনার, ফিডার জাহাজ বাড়ানো, অত্যাধুনিক মেশিনারি যোগ করা সর্বোপরি বন্দরের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সাথে শীর্ষ মেইন লাইন অপারেটরদের আন্তরিক সদিচ্ছাও সংকট সমাধানের অন্যতম পথ।