কালো টাকার ‘সাদা’ মালিক এবং আমজনতার কষ্ট

হাসান ইমাম
Published : 30 June 2021, 10:49 AM
Updated : 30 June 2021, 10:49 AM

বাংলাদেশের গরিব মানুষেরও 'অপ্রদর্শিত' বিষয় আছেধনীর টাকাকড়ি অগোচরে থাকে, গরিবের দুঃখ-দুর্দশাশুধু আড়ালেই পড়ে থাকে না গরিবের ভাঙাচোরা জীবনের ক্ষত-খতিয়ান, 'স্বীকৃতি'র নসিবও নেই তাদেরকরোনাকালীন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে তাই আড়াই-তিন কোটি 'নব্য' গরিবদের কথা উচ্চারিতই হলো না, উপেক্ষিত থাকল তাদের জীবনের করুণকাহিনী। 

২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয়ের মানুষের দেশে গরিব 'দুষ্প্রাপ্য'ই হওয়ার কথাদেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি মাসে আয় ১৫ হাজার ৭৩৯ টাকা, হিসাব পাক্কাকরোনার এ ধস্ত-বিধ্বস্ত সময়েও সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ! যদিও বেসরকারি একাধিক জরিপ বলছে, কোভিডের কারণে দেশের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। 

পান্তায় নুনের জোগানের প্রাত্যহিকতায় বাঁধা বাংলাদেশের গরিব মানুষের জাবেদা খাতায় আনার হিসাব, ডলারের হিসাব তারা বোঝে নাযেমন তাদের বোধগম্য নয় বাংলাদেশটা ধনী নয়, অথচ  ধনবান উৎপাদনে তা ঊর্বর ভূমিতেমনিভাবে মন্ত্রীসান্ত্রীদের কথাবার্তারও কোনো থৈ খুঁজে পান না তারা

তাবৎ দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ধনবান বানানোর জাদুকরি বন্দোবস্ত আছে এ দেশেই২০১০ থেকে ২০১৯ সালএই ১০ বছরে দেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাশ হারেএই হারকে সর্বোচ্চ বলছে ওয়েলথ এক্সের 'আ ডিকেড অব ওয়েলথ' শীর্ষক গবেষণাধনকুবের মানে, ৫০ লাখ ডলার বা অন্তত ৪০ কোটির সম্পদ যার করায়ত্তধনকুবের বৃদ্ধির এই ভরা মৌসুমে 'কুবের'রা আগের মতোই পান্তায় নুন জোগানের যুদ্ধে রতকরোনাকাল কুবেরদের সংখ্যা একঝটকায় বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

অর্থশাস্ত্রের ভাষ্য, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও প্রসারমানে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থানকিন্তু দেশে কালো টাকার রমরমায় এটা অন্তত প্রমাণিত, অবৈধ পন্থায় ধনী হয়াটাই এখানে 'সহজ'! ব্যবস্থা কতটা সহায়তা করে, ব্যবস্থার পাহারাদের কতটা কীভাবে কেনা যায়, সে চিত্র পরিষ্কার না হলেও কালো টাকা সাদা করার দায়িত্ব সরকার তার নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছেআর ঘাড় থেকে ফেলে দিতে চাইছে গরিবের 'বোঝা'

করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ গরিবআর অতি গরিবের সংখ্যা ছিল আরো প্রায় ২ কোটিকরোনা অতিমারির ধাক্কায় পরিস্থিতি প্রায় বেসামালঅর্থাৎ একদিকে টাকার পাহাড়ে চড়ে কিছু ব্যক্তি, অন্যদিকে খাদে গড়াচ্ছে গরিবি, হাহাকারএই বিপরীতমুখী অবস্থার ডাক নাম 'আয়-বৈষম্য' হলেও সত্যিকারের পরিচয় ব্যবস্থাগত 'সুবিধা-বৈষম্য'হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও আপনার গায়ে আঁচড়ও লাগবে নালাখ কোটি টাকা পাচার করেও আপনি বহাল তবিয়তেজাল-জালিয়াতি করে গরিব ঠকিয়েও থাকবেন কর্তৃপক্ষের নেক নজরেদেশ-দশের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার পরও আপনার পাশে স্বয়ং সরকার!

বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, গত দেড় দশকে দারিদ্র্য কমানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষ ১৫ দেশের তালিকায় থাকতে পারেনি বাংলাদেশঅথচ এই সময়কালে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়দুটোই বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোবিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে দেশের ৩৮ শতাংশ সম্পদের মালিকানা মাত্র ১০ ভাগ মানুষেরআর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ১ শতাংশ সম্পদ

গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকাগ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির দেওয়া এ অংক পাস হওয়া চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় কাছাকাছিজাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডও বলেছে, বাংলাদেশে বছরে যত কর আদায় হয়, তার ৩৬ শতাংশের সমান টাকা পাচার হয়২০১৫ সালে কী পরিমাণ কর আদায় হয়েছিল, সেটি আমলে নিয়ে এ হিসাবআর বেশির ভাগ টাকা পাচার হয় আমদানি-রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণায়২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে কর-রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকাআঙ্কটাডের হিসাব মানলে ওই বছর দেশ থেকে গায়েব ৫০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা

আঙ্কটাডের কাছাকাছি হিসাব গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিরও (জিএফআই)২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে তারাঅন্যান্য সংস্থার বৈশ্বিক সূচকেও দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ টাকাই পাচার হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে। 

অথচ কারা পাচার করছে, অর্থমন্ত্রী তাদের চেনেন না! সম্প্রতি গণমাধ্যম 'আলো' করে থাকা পদচ্যুত সংসদ সদস্য ও কুয়েতে সাজাপ্রাপ্ত কাজী শহিদ উদ্দিন পাপুল, কানাডায় মাত্র সাড়ে ১২ কোটি টাকায় বাড়ি খরিদ করা নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতী, একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের পরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় পাড়ি দেওয়া প্রশান্ত কুমার হালদার প্রমুখ কৃতী মানুষদের কথাও কি তার অগোচরে? কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত নভেম্বরে যেমন বলেছিলেন, দেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছু সত্যতা তিনি পেয়েছেনআর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী টাকা পাচারের ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশিসহকর্মীর এই কথাও কি অর্থমন্ত্রীর কানে পৌঁছায়নি?

অনেকেরই মনে থাকবার কথা, ২০১৪ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠানো হবেপাচার অর্থ ফেরত আনার কথাও বলেছিলেন তিনিসম্ভবত এ কথাও বিস্মৃত হয়ে থাকবেন অর্থমন্ত্রী

ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জ্যঁ ব্যাপটিস্ট কোলবার্টকে উদ্ধৃত করে যে নীতিগত অবস্থানের কথা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় উচ্চারণ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী, তাও কি তার স্মৃতিতে নেই? অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী রাজহাঁসের গোটা খামারটাই তার কাছে নিরাপদ থাকার কথাযেমন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে নাএর পরের কয়েক মাসেই বাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকাচলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছে আরো ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকাযদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হিসাবের চেয়ে বাস্তবে তা আড়াই গুণ বেশি বলেই মনে করা হয়অর্থনীতির আকার অনুপাতে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চখেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়েছে সেই কবেই। আরও গতি সঞ্চয় করে তা এগিয়ে চলছে তড়তড়িয়ে! ব্যাংকিং খাত একটি 'রাজহাঁস' হলে প্রাণীটির অবস্থা এখন কেমন? পালক অবশিষ্ট আছে কিছু তার?

কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপি, দেশের অর্থ-সম্পদ লোপাটকারী, ব্যাংক-শেয়ারবাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত অর্থ, যাকে বলা হচ্ছে 'অপ্রদর্শিত', সেই অর্থ মাত্র ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে সাদা করার সুযোগ কীভাবে দেওয়া হয়, প্রায় সব মহল থেকে ওঠা বিস্ময়-জাগানিয়া এ প্রশ্নের আছড় কিছুটা পড়ল তাহলে! যারা আইনের তোয়াক্কা করলেন, কথার বরখেলাপ করলেন, কর ফাঁকি দিলেন, অবৈধ পন্থায় পকেটে রেস্ত ভরলেন তাদের 'জামাই আদর'-এর বন্দোবস্ত বহাল রাখলেন বটে অর্থমন্ত্রী, তবে খাতিরদারিতে একটু রাশ টানলেন। তাই ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখা হলো বাজেটে। এই করের ওপর বাড়তি ৫ শতাংশ জরিমানা গোনার অতিরিক্ত বিধানও যুক্ত করা হয়েছে।  

অর্থাৎ কালোটাকার মালিকরা সরকারের চোখে আগের মতোই 'সাদা' থাকছেন, শুধু অন্যদের মুখ বন্ধ রাখতে একটু 'কড়া' ব্যবস্থা। এই প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাধর, 'মাননীয়'দের বিত্তের ক্ষুধা মেটাতে যত ফন্দিফিকির, এর বিপরীতে সামান্য নেক নজরে দূর হতে পারে লাখো-কোটি গরিবের পেটের ক্ষুধাকষ্টের অতীত, দুর্বিষহ বর্তমান, গন্তব্যহীন ভবিষ্যৎএই তিনের মিলমিশের অদ্ভুদ আঁধারে খাবি খাওয়া এই মানুষগুলোর হাতে না থাকে সাদা টাকার ছিটেফোঁটা, না জানে তারা কালো টাকা করায়ত্তের কারিকুরিঅর্থমন্ত্রীর কথা বুঝবেন কী করে!

গেল অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হয়েছেএতে ৭ হাজার ৪৪৫ জনের কাছ থেকে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর পাওয়া গেছেএই পরিসংখ্যান অর্থমন্ত্রীকে, রাজস্ব বিভাগকে যতই উৎসাহিত করুক, এখানে ন্যায্যতা নেই। এর চেয়েও বড় কথা, আইনের চোখে সবাই সমানকথাটি লুপ্ত হয়

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জবানিতে উচ্চারিত হলমার্কের হাতিয়ে নেওয়া ‌'৩ হাজার কোটি টাকা কিছুই না' দেশবাসীর কানে কিন্তু এখনো বাজেপূর্বসূরির দেখানো 'স্বজনতোষী পুঁজিবাদ'-এর পথে হাঁটতে হাঁটতেও যদি আ হ ম মুস্তফা কামাল এদিক পানে একটুখানি নজর দিতেন, তাহলে অন্তত খামারের কিছুসংখ্যক রাজহাঁস পালকসহ বেঁচে থাকে! দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার হলে আপনারও নাকি আমাদের মতো 'কষ্ট' লাগে; কষ্টে আমাদের বুকটা ফেটে যায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী!