গাছ কেটে ‘উন্নয়ন’ ও ‘সৌন্দর্য বর্ধনে’র ধারণা প্রসঙ্গে

Published : 10 May 2021, 09:19 PM
Updated : 10 May 2021, 09:19 PM

একজন নেতা বা নেত্রী একটি জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন যদি তার জনগণ তাকে সহায়তা করে। আমাদের উপমহাদেশে এমন দুজন নেতা ছিলেন। তারা হলেন মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সঙ্গীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে ছিল দেশ। সে অবস্থা থেকে তিনি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে এসেছেন নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে। আর তার কাজের মাধ্যমে তিনি বর্তমান উন্নয়নের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষের হটকারী সিদ্ধান্ত অনেক সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজকে ম্লান করে, করে প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ সে কাজের দায় কোনওভাবেই তার উপর বর্তায় না।

গত কয়েকদিন যাবত একটা খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও জাতীয় দৈনিকগুলো গুরুত্বের সাথে প্রচার করা করেছে। খবরটি হল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে বানানো হচ্ছে রেস্তোরাঁ। এ খবর পরিবেশবিদ, ইতিহাসবিদসহ সমগ্র জাতির নজর কেড়েছে এবং তাদেরকে আহত করেছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের যেসব নেতা পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তাদের মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০১৫ সালে পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ বৈশ্বিক পুরস্কার 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পেয়েছেন। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় দূরদর্শী পদক্ষেপে নেওয়ায় তাকে সে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

আরেকজন নেতা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিশ্ব মঞ্চে সক্রিয় ছিলেন। তিনি হলেন ২০০৮ সালে মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে প্রথমবারের মত অবাধ এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী মোহাম্মদ নাশিদ। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশের ১৭ ভাগ ভূখণ্ড জলের নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। আর মালদ্বীপ পুরো দেশটাই জলের গভীরে হারিয়ে যাবার ঝুঁকিতে। 

অনেকে মনে করেন, জলবায়ু নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে কথা বলার কারণেই, আন্তর্জাতিক চক্রান্তে মোহাম্মদ নাশিদকে মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগে এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি নাশিদ এখন মালদ্বীপের জাতীয় সংসদের স্পীকার। তার উপর হামলা এবং চক্রান্ত এখনও অব্যাহত আছে। এ বছরই ৬ মে দেশটির রাজধানী মালেতে তার বাড়ির বাইরে এক বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন তিনি। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ছিল।

সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদীরা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কাউকে পছন্দ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এসব আন্তর্জাতিক ও দেশি মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার আছেন। কারণ যদি বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি জলের নিচে তলিয়ে যায় সেক্ষেত্রে বিশ্বে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ ভূমির হিসেবে। 

ইউনিয়ন অব কনসার্নাড সায়েন্টিস্টস এর ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে কার্বন নির্গমনকারী প্রথম ৫টি দেশ হল: ১. চীন ১০.০৬ জিটি , ২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫.৪১ জিটি, ৩. ভারত ২.৬৫ জিটি, ৪. রাশিয়ান ফেডারেশন ১.৭১ জিটি ৫. জাপান ১.১ জিটি। জিটি হল মেট্রিক গেগা টন। পরিবেশ দূষণের জন্য সর্বোচ্চ দায়ী দেশগুলো হল চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। আর মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের দিক দিয়ে প্রথম ৫টি দেশ হলো: ১. সৌদি আরব ১৮.৪৮ মেট্রিক টন, ২. কাজাখস্তান ১৭.৬০ মেট্রিক টন, ৩. অস্ট্রেলিয়া ১৬.৯২ মেট্রিক টন, ৪. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৬.৫৬ মেট্রিক টন এবং ৫. কানাডা ১৫.৩২ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশের ভূমির পরিমাণ খুবই কম। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে দেশটি বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে আছে, আর মালদ্বীপ পঞ্চম স্থানে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশটির ১৭ ভাগ জলের নিচে তলিয়ে গেলে ভূমির অভাব দেখা দেবে মারাত্মকভাবে। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনসাধারণকে অন্য এলাকায় সরিয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃষি জমির স্বল্পতা দেখা দেবে। বাংলাদেশের আর একটা বড় সমস্যা এখানে ইতিমধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। কৃষি জমির অভাব দেখা দিলে, সেখানে খাদ্যাভাবও দেখা দেবে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই পদক্ষেপ নিতে হয়, নিজের জনগণের কথা ভেবে। সবচেয়ে বড় কথা হল তিনি কখনোই মৃত্যু ভয়ে ভীত নন। তা যদি হতেন তাহলে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টের পর আর রাজনীতি করতেন না। তাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্র এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৯ বার হত্যা চেষ্টা চালিয়েছে। যা কিউবার বিপ্লবী মহান নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পর আর কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

জলবায়ুর স্বাভাবিকতা রক্ষায় বিশ্বে দেশ হিসাবে ভুটানের কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয়। অন্য কোন রাষ্ট্র এমন একক ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভুটানই একমাত্র দেশ কার্বন নির্গমনের চেয়ে শোষণ করে বেশি। কিন্তু অন্যান্য দেশের কার্বন-ডাই-অক্সাইড আগ্রাসনের কারণে এই দেশটিও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভুগছে। ভুটানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগায় জানিয়েছিলেন, তার দেশের ৭২ শতাংশ বনাঞ্চলের আওতায় রয়েছে। ভুটানের অর্ধেকেরও বেশি অংশ জাতীয় উদ্যান, বন্য জীব-জন্তুর অভয়ারণ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ হিসাবে সুরক্ষিত। ভুটান তাদের জাতীয় বিকাশকে পরিমাপ করে জাতীয় সুখ-শান্তির উপর নির্ভর করে। দেশের  জনপ্রিয় রাজা জিগমে সিংগেই ওয়াংচুক মনে করতেন, "The gross national happiness is more important than gross national product since 1972." ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং গত মার্চে যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকায় বক্তব্য রাখেন তখন রাজার এই বিখ্যাত উক্তিটির উল্লেখ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বঙ্গবন্ধুর একটি বিখ্যাত উক্তিরও উল্লেখ করেন আর তা হল, "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়।" ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তাদের রাজা ও বঙ্গবন্ধুর উক্তির মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।

ভুটানের জনগণ তাদের রাজার দর্শনকে ধারণ করে। তারা ভোগবিলাসের চেয়ে নিরাপদ দেশ এবং নিরাপদ পৃথিবী গড়ার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। বনসম্পদ ও প্রাণী সম্পদ তারা রক্ষা করছে। তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে বিশ্বকে সুরক্ষিত করতে। তারা আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর দর্শনকেও ধারণ করে এক অর্থে সে কথা ভুটানের প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন। কিন্তু আমরা আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর দর্শন 'কারো প্রতি বৈরিতা বা শত্রুতা নয়' ধারণ করতে পারিনি সঠিকভাবে। আমরা প্রকৃতির প্রতি বৈরী আচরণ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ নিধন করেছি।

আমাদের দেশে বনাঞ্চল খুবই কম। বিগত সরকারগুলোর ক্ষমতায় থাকার সময়ে গাছ লাগানোর চেয়ে কাটা হয়েছে বেশি। বঙ্গবন্ধুর যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন বনায়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনাও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন, পরিবেশ রক্ষায় বনায়নকে গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তার আদর্শকে উপেক্ষা করে কিছু কর্মকর্তা রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রেসকোর্স ময়দানে বৃক্ষ নিধনযজ্ঞ চালিয়েছেন। 

রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, গৌরবের স্থান। এখানকার একটা গাছের পাতাও সেই অর্থে অনেক গুরুত্ব বহন করে। এখানে কোনও গাছ কাটতে হলে জাতির মতামত নেওয়া উচিৎ। গাছ কেটে সেখানে যে স্থাপনা গড়ে তোলা হবে, তা জাতীয় জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সেখানে গাছে কেটে রেস্টুরেন্ট বানানো হবে- এজাতীয় কোন সিদ্ধান্ত মন্ত্রী পরিষদে গৃহীত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা কোন সংবাদ মাধ্যম তা পূর্বে জানতে পারিনি। জানলে গাছগুলো উজাড় করার আগেই জাতি এর প্রতিবাদ জানাতো এবং তা রহিত করা যেত।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার মক্কেলের পক্ষে, রেসকোর্স ময়দানে অর্থাৎ বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিত করা এবং সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। ২০০৯ সালের ৮ জুলাই উক্ত রিট মামলার রুলের চূড়ান্ত শুনানি গ্রহণ করে রায় প্রদান করে উচ্চ আদালত। আর ২০১০ সালের ৭ জুলাই রায় প্রকাশ করে। রায়ে উচ্চ আদালত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক সাতটি স্থানকে চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। সে সাতটি স্থান হল:

১. ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেওয়া ভাষণের স্থান।

২. ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের স্থান।

৩. ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ দল থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান।

৪. ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের স্থান।

৫. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান।

৬. ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রদানের স্থান এবং

৭. ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ স্থান।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অংশে আত্মসমর্পণ করে, সে অংশকে "স্বাধীনতা স্কোয়ার'' বা  "লিবার্টি স্কোয়ার" নামকরণ করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হল।

এছাড়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের জন্য বলা হয়। আর  স্থাপনা অপসারণের পর চিহ্নিত সাতটি স্থানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আর রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জন্ম এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সে জাতিজন্মের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে স্থানে এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সে স্থানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদি কেউ বাঙালি হয়ে থাকে, তাহলে ওই স্থানে দাঁড়িয়ে তার প্রাণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে। এছাড়া চোখ বন্ধ করে চিন্তা করবে এখানে জেনারেল এ কে নিয়াজি তার বাহিনীসহ বাঙালি জাতির সম্মুখে আত্মসমর্পণ করেছিল।

উপরের রায়ে আমরা যা দেখেছি তাতে বলা হয়েছে, ইতিহাসকে মুছে ফেলতে যে সকল অবৈধ স্থাপনা সেখানে স্থাপিত হয়েছে তা অপসারণ করতে হবে। সেখানে নতুন কোন অবৈধ স্থাপনা তৈরি করার নিমিত্তে বৃক্ষ নিধনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। 

এ নিবন্ধ লিখতে লিখতে আমি আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে ফোন করেছিলাম। তিনি জানান, এ প্রকল্পের কোন কর্মকর্তা বা মন্ত্রণালয় তাদের সাথে কোন পরামর্শ করেননি। এবং কখনও তাদেরকে দাপ্তরিকভাবে জানানো হয়নি কী কী পদক্ষেপ সেখানে নেওয়া হচ্ছে, রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তিনি মনে করেন, "পুঁজিবাদীরা মুনাফা লোটার স্বার্থে সেখানে অবৈধভাবে রেস্তোরা স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে।"

আমার আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এটা আদালতের রায়ের অবমাননা। যারা আদালতের রায় অবমাননা করছে তাদের সাজা খুব কম হচ্ছে। সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে গত ছয় বছরে জেল জরিমানা হয়েছে। আদালতে আবেদন দাখিল করে বলেছি অবৈধভাবে গাছ কাটা ও রেস্তোরাঁ নির্মাণের বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনি। আর মাননীয় প্রধান বিচারপতিও ইতিপূর্বে তার বক্তব্যে আদালতের রায় বাস্তবায়ন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, যা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।"

আমি কোনভাবেই মনে করিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জ্ঞাতার্থে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ বানানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনি কখনও জেনেশুনে এরকম স্ববিরোধী প্রকল্পে অনুমোদন দিতে পারেন না। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন পরিক্ষিত পরিবেশবাদী নেতা। তিনি ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) বর্তমান সভাপতি। অতএব তিনি এ জাতীয় হটকারী প্রকল্পে কোনভাবেই অনুমোদন দিতে পারেন না। এতে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে তা তিনি জানেন এবং বোঝেন।

এ ডিজিটাল যুগে কোন কিছুই আর গোপন করে রাখা যাচ্ছে না। আর কোন ভাষায় কোন খবর লেখা সেটাও খুব বেশি বাঁধা না। যে কেউ খুব সহজেই ইংলিশে বা তার মাতৃভাষায় অনুবাদটি পড়ে নিতে পারে। সোহারাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হয়েছে। আমার এক পরিবেশবাদী জার্মান বন্ধু ব্যাপারটা নিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলো- "তোমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে বেশ সরব জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে, সেখানে তোমরা কেন গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট বানাচ্ছো?" আমি তাকে সন্তোষজনক কোন উত্তর দিতে পারিনি।

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক মো.হাবিবুল ইসলাম বলেছেন, "যখনই যেই গাছ কাটা পড়বে, সেই গাছের বিপরীতে ১০টা গাছ লাগানো হবে। আর সামগ্রিকভাবে অন্তত এক হাজার গাছ লাগানো আমাদের লক্ষ্য।" 

গাছপালা ধরিত্রীর সন্তান, এদের বিনাশে তার কষ্ট হয়। একজন মায়ের একটা সন্তানের অকাল মৃত্যু তার মাকে ব্যথিত করে। ভবিষ্যতে তিনি আরও পাঁচটি সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারেন কিন্তু যে সন্তান তিনি অকালে হারিয়েছেন সে ব্যথা ভুলতে পারেন না। এর আগেও কয়েকবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি গাছের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য স্বাধীনতা জাদুঘরও নির্মাণ করা হয়েছে উদ্যানের মাটির নিচে। সেখানে গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট বানানোর কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে?

গাছ কাটা প্রসঙ্গে স্থাপত্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, "প্রথম কথা হচ্ছে, এখানে যা হচ্ছে তা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নকশার ভিত্তিতেই হচ্ছে। অনুমোদিত নকশার বাইরে কোনো কাজ হচ্ছে না। সবুজ ঘাসে পা না দিয়ে মানুষ যাতে হাঁটতে পারে, তাই হাঁটাপথের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এটা করতে গিয়ে যে গাছগুলো রাখা জরুরী, আর যেগুলো অপ্রয়োজনীয়, তা কাটা হচ্ছে। উদ্যানের গাছগুলো কোনো নিয়মনীতি মেনে লাগানো হয়নি। নতুনভাবে গাছ লাগানোর পরিকল্পনাও আছে।"

স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক  মো.হাবিবুল ইসলাম ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া গাছ কাটার পক্ষে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা যথেষ্ট না। যে গাছগুলোর বয়স পঞ্চাশ বছর বা তারও বেশি- ওই গাছগুলোর যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, এটা তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ গাছগুলো বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকার সময়ে রোপণ করা হয়েছে। এ গাছগুলো ইতিহাসেরও সাক্ষী, অতএব এখানে জাতির আবেগ জড়িত। কোন অজুহাতেই এ গাছ কাটার কোন যৌক্তিকতা নেই। একটির পরিবর্তে দশটি গাছ লাগিয়েও ওই গাছগুলির অভাব পূরণ করা যাবে না। এটা ইট-কাঠ-বালি নিয়ে কাজ করা নির্দয় প্রকল্প পরিচালক ও স্থপতির বোঝার কথা না। উনাদের কোন প্রিয়জনের বিয়োগেও হয়তো তারা কোন নতুন দশটি প্রিয়জনের জন্ম-চিন্তা করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করবেন।

আমাদের আরেকটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হল অপরিমিত পরিমাণ গাছ লাগানো ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের গুরুত্ব লাঘব করবে। কারণ এটা ছিল একটা ঘোড়দৌড়ের মাঠ। একসময় মাঠের মাঝে এত গাছপালা ছিল না, সবকিছুই ছিল ফাঁকা। সেখানে অতিরিক্ত গাছপালা রোপণ করলে এই মাঠে যে জনসভা হত তা বোঝা যাবে না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন কোন্ জায়গায় সেটা অনুভব করতে পারা যাবে না। অতএব সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একসময় জনসভার জন্য একটি আদর্শ স্থান ছিল সেটাও ধরে রাখতে হবে। আর গাছ বাঁচিয়ে পায়ে হাঁটার রাস্তাগুলো ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব। এগুলো তো দ্রুতগামী গাড়ির চলার রাস্তা না যে, সোজা না হলে দুর্ঘটনা ঘটবে অহরহ।

আমি ১৯৯৪ সালে নুরেনবার্গের পাশের শহর সোয়াবাখে থাকতাম। সেখানে হাসপাতালের পাশে পাঁচ রাস্তার মিলন কেন্দ্রের কাছে বিশাল বড় একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। তখন গাছটির বয়স ছিল প্রায় ১৯০ বছর। সে গাছটির মাঝে ডালে মোড়ক লেগেছিল। বিশেষজ্ঞরা আসলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মরা অংশটুকু অপসারণ করে দিলেন। আর দুই অংশকে সংযুক্ত রাখতে গাছটিকে ধাতব পাত আর স্ক্রু দিয়ে প্লাস্টার করে দিলেন বেশ কিছু স্থানে। এরপর গাছটি অনেক বছর টিকে গেল। এখনও সামান্য অংশ বেঁচে আছে। এর নাম ইতিহাস ঐতিহ্য। সোয়াবাখ শহর নূরেনবার্গ শহরের চেয়ে পুরানো, আর ওই গাছটি ছিল শহরের সবথেকে পুরানো গাছের একটি। গাছটি ছিল ওই শহরের ঐতিহ্যের প্রতীক।

২০০০ সালের কথা আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু সমাজকর্মী জাহিদ হোসেন নজরুল সুইডেনের মালমো শহরে সমুদ্র আইনে পড়াশোনা করছিলেন। তিনি একদিন জানালেন, মালমো শহরের গুরুত্বপূর্ণ একটি চৌরাস্তার মোড়ে বড় একটা গাছ ছিল। কিন্তু গাছটির কারণে রাস্তা সোজা ছিল না। এবং সেখানে দুর্ঘটনা ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। সেক্ষেত্রে গাছটাকে অপসারণ জরুরি ছিল। কিন্তু তারা গাছটাকে কেটে না ফেলে বিশাল এলাকা নিয়ে গর্ত করে গাছটাকে কিছুদূর সরিয়ে দিয়ে রাস্তা সোজা করেছিল। এ কাজে বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল। তবুও গাছটিকে তারা কেটে ফেলেননি। এটাই হল হল সভ্যতা। তারাও চাইলে এত ঝামেলা এবং খরচ না করে গাছটিকে কেটে ফেলে আরো দশটি গাছ লাগাতে পারতেন। দশটি গাছ আমরা লাগাতে পারি, কিন্তু সে দশটি গাছ কোন সময়ই বিশেষ সেই গাছটির মত ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইতিমধ্যে দাবি উঠেছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্থান ও পরিবেশ সংরক্ষণ করতে একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে; উদ্যানে রেস্তোরাঁ, ওয়াক ওয়ে কিংবা এ জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বিস্তৃতভাবে অবিলম্বে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং উদ্যানসহ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা বা এলাকার উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পক, স্থপতি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, উদ্যানবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরিবেশবিদ ও কবি-সাহিত্যিক সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। যারা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দেবেন। আমি মনে করি এ দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আরেক জাতীয় দৈনিকে বলেছেন, "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষায় হাইকোর্ট এক যুগ আগে রায় দিয়েছেন। ওই রায় অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা যাবে না। এমনকি উদ্যান রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০০ সালে একটি আইন করে। সেই আইন অনুযায়ীও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা যাবে না। অথচ গাছ কেটে সেখানে দোকান বানানো হচ্ছে।" 

তিনি বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থান আগে চিহ্নিত হতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই স্থান চিহ্নিত হয়নি। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী হচ্ছে তার নকশা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু সেখানে কিসের ভিত্তিতে এসব কাজ হচ্ছে, তা কেউ জানতে পারছে না। সরকার আইন করে নিজেই আইন মানছে না। আদালতের রায়ও মানছে না। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে।"

ইতিমধ্যে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দোষারোপ করছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে, আর গণপূর্ত দায় চাপাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে। আমরা আশা করব অনতিবিলম্বে এ রশি টানাটানি বন্ধ হবে এবং ভুলটা শুধরে নিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দোষীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় ও কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। আমরা আশা করবো এক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে দোষীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকেও অক্ষুণ্ণ রাখা হবে।