শিশু-কিশোরদের পরমানন্দে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে

লাভা মাহমুদা
Published : 5 May 2021, 06:34 AM
Updated : 5 May 2021, 06:34 AM

করোনাভাইরাস গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববাসীকে এক অস্বাভাবিক  অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এ সময়ে কোনওকিছুই স্বাভাবিকভাবে ঘটছে না। মৃত্যু ভয় মানুষকে সারাক্ষণ তাড়া করছে। কীভাবে জীবনযাত্রা আবার আগের মতো সচল হবে, মানুষকে আর মানুষের সঙ্গে মেলামেশায়, দেখাসাক্ষাতে মুখ ঢেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে না, তা এখন কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। নানা অভাব, শূন্যতা, অপূর্ণতাকে সঙ্গী করে রুদ্ধ জীবন পার করছি আমরা। শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে মানসিক অবসাদকে বরণ করতে বাধ্য হচ্ছি। ইচ্ছায় যা করি, অনিচ্ছায় করি তারচেয়ে বেশি। 

মহামারীকালে দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুনিয়াজুড়েই হয়তো এই বাধ্যতামূলক শিক্ষাছুটি। শিক্ষাজীবন তীব্রভাবে ব্যাহত শিক্ষার্থীদের, এত বড় ক্ষতি কীভাবে পোষানো হবে তা কেউ জানে না। আবার দীর্ঘদিন ধরে চার দেয়ালে অবরুদ্ধ থেকে শিক্ষার্থী, বিশেষ করে শিশু-কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক-মানসিক সমস্যায় পড়েছে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলো, যেখানে করোনার ছোবল মারাত্মক, সেখানকার অবস্থা আরও করুণ।

এমনিতেই বড় শহরের শিশুরা খোলামেলা পরিবেশের অভাবে এক ধরনের খাঁচাবন্দী জীবনযাপন করে। স্কুলেই কেবল তারা একটু হলেও মুক্ত পরিবেশ পায়, বন্ধুদের সাথে উচ্ছ্বসিতভাবে মেশার সুযোগ পায়, পায় কথা বলার সুযোগ। কিন্তু করোনার ভয়াল গ্রাসে তাদের কলকাকলি বন্ধ, নেই প্রাণের আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের পথ।

ইদানীংকালের শিশুরা বেড়ে উঠছে পড়াশোনার এক প্রচণ্ড চাপের মধ্য দিয়ে। বইয়ের ভারী ব্যাগ বহন করতে করতে তারা হারিয়ে ফেলছে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা, শিশুসুলভ চপলতা আর জানার অপরিসীম কৌতুহল। বইয়ের পোকা বানাতে গিয়ে তীব্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা জড়তায় জড়ানো, নিরানন্দ। 

আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ও যাপিতজীবন পদ্ধতি এমনিতেই আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে, পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রবল হয়ে উঠছে, জীবনাচরণে এসেছে স্বার্থপরতা। ইলেকট্রনিক ডিভাইসে নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছি আরও অসামাজিক। অর্থে বিত্তে সমৃদ্ধি অর্জন করলেও মানসিকভাবে, সৃজনশীল উদ্যোগ-আয়োজনের দিক থেকে আমাদের দীনতা না ঘুচে বরং বেড়েছে। আমরা ক্রমশ বৃত্তবন্দী হয়ে পড়ছি। করোনাকালের ঘেরাটোপ কি মনের সংকীর্ণতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে?

কালোকে সরিয়ে আমরা আলোর কাছে যেতে চাই। আঁধারের বোঁটা নয় আলোর বৃন্ত আমাদের প্রত্যাশা। খোলা আকাশ, উন্মুক্ত খেলার মাঠ, আত্মীয়-পরিজনে ভরা কোলাহল মুখরিত পারিবারিক পরিবেশ; শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে অপরিহার্য এ উপাদানগুলোর কোনোটিই আর শিশু-কিশোরদের নাগালে নেই। সৃজনশীলতার বিকাশ ও প্রকাশের সুযোগ এখন অতিমাত্রায় সীমিত। মানবশিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ না দিয়ে তাদের আমরা যন্ত্র-মানবে পরিণত করছি। অথচ চিন্তাশীল মানবিক গুণসম্পন্ন উদার ও মুক্তমনের মানুষ হিসেবে শিশুদের গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের সৃজন-উদ্যোগ। শিশুরা অবশ্যই বই পড়বে, পাঠমুখী হবে; কিন্তু একই সঙ্গে তারা লিখবে, ছবি আঁকবে, গান গাইবে, খেলাধুলা করবে। যখন মন যা চাইবে তাই করবে, তাতে হৃদয়বৃত্তি কুসুমিত হবে। শৃঙ্খলার নামে জীবন শৃঙ্খলিত হবে না। আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে চেতনাকে শানিত করবে একজন সৃজনশীল মানুষের গুণাবলি দিয়ে।

কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।

করোনাকাল নিশ্চয়ই একদিন বিদায় নেবে। মানুষ মুক্তি পাবে তার প্রাণের আবেগ চেপে রাখার যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু শিশুদের জীবন বিকাশের মুক্ত পরিবেশ কি আমরা আদৌ নিশ্চিত করতে পারব?

শিশুদের সজীবতা ফিরিয়ে আনতে, সৃজনশীলতা বিকাশে জোর জবরদস্তি করে পড়ানো অসংখ্য  বইয়ের  পরিবর্তে পরমানন্দের সাথে শিক্ষালাভের পরিকল্পনার কথা ভাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। 

তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই; আমরা কি কৃত্রিমতায় ভরা আড়ষ্ট ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করবো, নাকি সিস্টেমটাকে খানিকটা বদলে দিয়ে অসীম কৌতুহল আর অবারিত প্রসন্নতার এক শিক্ষাজীবন তাদের উপহার দেবো। যে জীবন তাদের প্রাপ্য, অধিকার; যে জীবনে তারা নিজেকে নিজেই ভাঙা গড়ার ভেতর দিয়ে ঋদ্ধ করবে, শানিত করবে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে  অবগাহন করবে সৃষ্টির অপার আনন্দময় এক ভুবনে। শিশুরা জানবে, শিখবে আনন্দে- বাধ্য হয়ে নয়।

বর্তমান অবরুদ্ধ সময়ে ঘরে বসে চিন্তাভাবনার সময় একটু বেশি। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবিক গুণ ও উদার মনের মানুষ হিসেবে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তা কী ভাববেন আমাদের দেশের শিক্ষানুরাগী চিন্তকেরা? মুক্তপ্রাণের মুক্ত মানুষ হয়ে পুরনো চিন্তার অচলায়তন ভাঙার সাহসী নতুন প্রজন্ম আমাদের খুব দরকার।