প্লেজারিজম: শিক্ষক রাজনীতির নয়া হাতিয়ার?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 31 March 2021, 02:21 PM
Updated : 31 March 2021, 02:21 PM

এশিয়াটিক সোসাইটি একটি গবেষণা কাজের জন্য অনুদান দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিভাগের দুজন নারী শিক্ষককে। তারা সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্মের প্রতিবেদন জমা দেন। কর্তৃপক্ষের কাছে এই প্রতিবেদন ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে গবেষকদের একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে গবেষণা প্রতিবেদনটিকে "মানের দিক দিয়ে একটি জগাখিচুড়ি" আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল যে এটি "অসংখ্য ত্রুটি দ্বারা পরিপূর্ণ যা চূড়ান্ত অবহেলা এবং পেশাদারিত্বের অভাব প্রদর্শন করে"। গবেষকদের বিরুদ্ধে বানান ভুল ও প্লেজারিজমের অভিযোগও আনা হয়।

গবেষণার নিয়ম অনুয়ায়ী, তাদের মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট গবেষকদের জানানোর কথা। সে অনুযায়ী গবেষকরা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিমার্জন করবেন। তারপর আসবে চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে গবেষণার চিরাচরিত এই নিয়ম মানা হয়নি। গবেষকরা প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছেন। মূল্যায়নকারীরা নানা মত-মন্তব্য করেছেন। কিন্তু গবেষকদের আর প্রতিবেদনটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়নি। এরপর এই গবেষণার জন্য নির্ধারিত অনুদান বাতিল করা হয়েছে।

এই খবরটি সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। খবরটির বিষয়বস্তু এবং প্রথম পৃষ্ঠায় এর স্থান পাওয়া দেখেই বোঝা যায়, এর পেছনে কোনো অভিসন্ধি আছে। কারো স্বার্থ ও ইন্ধন ছাড়া এ ধরনের একটি খবর প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পাওয়ার কথা নয়।

খবরে গবেষকদের বক্তব্যও আছে। গবেষকরা বলেছেন, অনবধানতা বশত গবেষণা-সহযোগীদের তৈরি করা খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। পরে এ জন্য তারা দুঃখপ্রকাশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটির জমা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সম্মত না হওয়ায় তারা অগ্রিম টাকা ফেরত দিয়ে এই গবেষণাকর্ম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

পরে এশিয়াটিক সোসাইটি ওই গবেষণাকর্মের অনুদান বাতিল করে। ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। যে গবেষণা প্রতিবেদন গৃহীত হয়নি, কোথাও প্রকাশিত হয়নি, এমনকি অনুদানও বাতিল করা হয়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। কিন্তু না, ঘটনাটি মোটেও মিটে যায়নি। একটি বিশেষ মহল জল ঘোলা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ ছাপা হচ্ছে। আর এই সংবাদের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা হচ্ছে ওই বিশেষ মহল থেকে। কারণ? ওই দুই গবেষক-শিক্ষককে সামাজিকভাবে হেয় করা। তারা যেন মাথা উঁচু করে কথা বলতে না পারে, সেই চেষ্টা করা। এর পেছনে রয়েছে কিছু ব্যক্তির নোংরা রাজনীতির খেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান কিছু শিক্ষক সবখানে কর্তৃত্ব করতে চায়। লুটেপুটে খাওয়ার ধান্দাও আছে। এ ক্ষেত্রে 'অনুগত নয়', এমন শিক্ষকরা প্রায়ই সামান্য ব্যাপারে অসামান্য হেনস্থার শিকার হন। যেমন হয়েছেন এই দুজন শিক্ষক।

আমাদের দেশে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি এখন ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। 'যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে' এই নীতিতে দলছে ব্যাপক দলবাজি। এতে করে যে বা যারা দলবাজির বাইরে থাকতে চায়, প্রচলিত স্রোতে গা না ভাসিয়ে স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে চায়, কর্তা-ভজা কীর্তন না গেয়ে নিজের মতো করে মত প্রকাশ করতে চায়, তাদের জন্য নিত্যনতুন বিপদ অপেক্ষা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ক্ষমতার জোরে প্রায়ই তাদের ওপর দমন-পীড়ন-হয়রানি নেমে আসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে প্লেজারিজম ও যৌন হয়রানি এখন কাউকে ফাসানো বা কাউকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার একটা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্লেজারিজমের অভিযোগগুলো উঠছে নারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। যারা সামনে চলে আসছেন, গড্ডলপ্রবাহে গা না ভাসিয়ে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতে চাইছেন, তাদের বিরুদ্ধে খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছে প্লেজারিজমের অভিযোগ। অথবা যৌন হয়রানির অভিযোগ। পুরুষ শিক্ষকরা যার প্রধান শিকার। এই দুটি স্পর্শকাতর বিষয় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষকদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এবং এটা অত্যন্ত সচেতনভাবে করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে গ্রামে কোনো প্রতিবাদী ব্যক্তিকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তার নামে নানা কলঙ্ক আরোপ করা হয়। যেমন সে নেশা করে, খারাপ পাড়ায় যায়। বাসায় খারাপ মানুষদের এনে ফুর্তি-ফার্তা করে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও সেই গ্রামীণ রীতিতেই কাউকে দমন করার কাজটি করা হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে একজনের নামে কলঙ্ক আরোপ করা হয়। এতে করে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিও নিশ্চুপ হয়ে যান। অথবা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাতে মতলববাজরা তাদের স্বার্থ হাসিলের অবারিত সুযোগ পেয়ে যায়। এটা আমাদের জন্য একটা বড় দুর্ভাগ্য।

তার মানে এই নয়, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই খুব ভালো, এখানে প্লেজারিজম হয় না, যৌন হয়রানি হয় না। কোনো অনিয়ম দুর্নীতি হয় না। হ্যাঁ, প্লেজারিজম হয়, হয়তো বেশি পরিমাণেই হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার হন নিরীহরা। ক্ষমতাবানরা পুকুর-সমুদ্র-চুরি করেও পার পেয়ে যান। আর কেউ কেউ সামান্য ভুলের কারণে 'দাগী চোর' সাব্যস্ত হন। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যারা নিয়মিত যৌন হয়রানি করেও ক্ষমতার জোরে পদ-পদবি-খ্যাতি ধরে রাখেন। আবার এমন শিক্ষককেও চিনি যারা ছাত্র-শিক্ষক সাধারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো ছাত্রীর সঙ্গে রুমে কথা বলার কারণে বিশেষ মহল দ্বারা যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। আমরা যৌন হয়রানিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চাই। খুব বেশি করেই চাই। কিন্তু যৌন হয়রানিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো নিরীহ শিক্ষকের নৈতিক মেরুদণ্ড যেন ভেঙ্গে দেয়া না হয়, সেটাও চাই।

আর প্লেজারিজমও প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার নয় বরং তা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন প্রবেশ না করে, কারও মাধ্যমে না ঘটে এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। সম্প্রতি উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্লেজারিজমের অভিযোগ আনা হয়েছে বলেও প্রশ্ন উঠেছে। প্লেজারিজমের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেমই দায়ী। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লেজারিজমকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে কোনো পলিসি নেই। এমনকি সচেতনতাও নেই। প্লেজারিজম বিষয়টি কি সেটাও অনেক শিক্ষক ভালোভাবে জানে না। আর এই অবহেলার জন্যই পিএইচডি থিসিস ও বিভিন্ন গবেষণা-প্রবন্ধে প্লেজারিজম হচ্ছে।

আর থিসিসের ক্ষেত্রে প্লেজারিজমের দায় থাকে নিরীক্ষকের। কারণ সার্বিক থিসিস পর্যবেক্ষণের মূল দায়িত্ব নিরীক্ষকের। তিনি যদি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে সেখানে প্লেজারিজম হওয়ার কথা নয়। নিরীক্ষায় অবহেলার জন্যই প্লেজারিজম হচ্ছে। তাই নিরীক্ষককে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। তাহলে প্লেজারিজম হবে না।

স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শোর বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন খাতে হাজারো গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণা প্রকল্প সহায়তা করে থাকে। দেশের বহু শিক্ষক চুরি করা লেখা বা প্লেজারাইজড গবেষণার মাধ্যমে পদোন্নতি লাভ করে থাকেন বলে অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে প্লেজারিজমের কোনও নীতিমালা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্টভাবে প্লেজারিজমের কোনও নিজস্ব নীতিমালা বা বিধিবিধান নেই। গবেষণায় প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি কাকে বলে সেটিও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। অন্যদিকে, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে লিখিত গবেষণাপত্র যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও, বাংলা লেখা যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। ফলে, প্লেজারিজম যাচাইয়েরও সর্বজনগ্রাহ্য সুযোগ তৈরি হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্লেজারিজমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে অভিযোগগুলো যথাযথভাবে উত্থাপন করতে হবে। তা না হলে নোংরা শিক্ষক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে এটা ব্যবহার হতেই থাকবে।