অভিজিৎ-দীপন হত্যা মামলার রায় ও হতাশা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 18 Feb 2021, 11:17 AM
Updated : 18 Feb 2021, 11:17 AM

দীর্ঘ ছয় বছর অনিশ্চয়তা আর দীর্ঘসূত্রতার পর অবশেষে লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে পাঁচ জঙ্গি সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷

এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার রায় ঘোষণা করা হয়। এই রায়েও মোট আটজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। আসামীরা হচ্ছে সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার ও শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের। আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে পুলিশের ভাষ্য।

প্রতিটি হত্যার বিচার হোক, অপরাধীরা সাজা পাক, এটা প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো নাগরিকেরই একান্ত প্রত্যাশা। সেই অর্থে অভিজিৎ ও দীপন হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৩ জন আসামীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু তারপরও একটা হতাশা ও অসন্তোষ কাজ করছে। এখনও এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক। পুলিশ তাদের এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এই ঘাতকেরা গোপনে কার কল্লা ফেলে দেবার জন্য ছুরিতে শান দিচ্ছে কে জানে!

অভিজিৎ ও দীপন হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যেমন দেশের বুদ্ধিজীবী ও শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে বাঙালি জাতিকে চিরতরে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে পাকিস্তানি আদর্শের ধারকবাহকরা ২০১৩ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে একের পর এক মুক্তমনাদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিচিন্তার চর্চাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। অভিজিৎ হত্যার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, "অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হল জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।"

আদালত যথার্থই বলেছেন। অভিজিৎ রায়কে হত্যার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবুদ্ধির অনুশীলনকে হাজার বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর শুধু অভিজিৎ কিংবা দীপন নয়, সেই সময় বেছে বেছে আহমেদ রাজিব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ বহু মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আসলে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশ ও জাতির জন্য যা অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতির প্রতিবিধান কোনো আদালতের পক্ষেই সম্ভব নয়।

অভিজিৎ রায় সাধারণ একজন ব্যক্তি নন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তার যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞাননির্ভর লেখা দিয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার, সেকুলারিজম, এলজিবিটি অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। অভিজিৎ রায় ও তার চিন্তাকে চিরতরে থামিয়ে দিতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাকে হত্যা করেছিল। এরপর শুরু হয়েছিল তাকে নিয়ে কুৎসা রটনা। এসব করেও যখন অভিজিৎ চর্চাকে থামানো যায়নি, তখন হামলা করা হয়েছে তার বইয়ের প্রকাশকারী সংস্থা জাগৃতির স্বত্ত্বাধিকারী দীপনের ওপর। এভাবে তারা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা পর্যন্ত থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।

অভিজিৎ এবং দীপন হত্যায় যাদের দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে, তারাই কেবল এ হত্যাকাণ্ডের মূল মদদদাতা ও পকিল্পনাকারী, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। সেই সময় যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, যারা নাস্তিকতা ইস্যুকে সামনে এনে ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনা লেখকদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছিল, একেকটা হত্যাকাণ্ডের পর যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করেছিল, মৃতদের নিয়ে কটুক্তি করেছিল, যারা মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিহত ব্যক্তিদের লেখালেখি নিয়ে উস্মা প্রকাশ করেছিল, তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন হবে কি? তারাও কী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়? যে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে, তারা হয়তো সামনে ছিল, চাপাতি হাতে আঘাত করেছিল, কিন্তু সত্যিই কি তারা হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী? মদতদাতা?

আসলে ২০১৩ সালে ধারাবাহিকভাবে যে ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মীয় রাজনীতির বিষবৃক্ষের ছায়ায় আমাদের দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেই রাজনীতি ও রাজনীতির কুশীলবদের চিহ্নিত করতে না পারলে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার খণ্ডিতই রয়ে যাবে। অভিজিতের স্ত্রী ও হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী রাফিদা আহমেদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় যথার্থই বলেছেন, অল্প কিছু চুনোপুঁটির বিচার করে জঙ্গিবাদের উত্থান ও শেকড় উপেক্ষা করা ন্যায়বিচার হতে পারে না।

আসলে ন্যায়বিচার থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। একটি সামগ্রিক অন্ধকার আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। ২০১৩ সালের আগেও দেশে অতর্কিত হানায় মুক্তমনা নাগরিকের হত্যা সংঘটিত হয়েছে কিন্তু তা ছিল বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো। নিরবচ্ছিন্ন নয়। ২০১৩ সালের পর তা নিরবচ্ছিন্ন হয়েছে। এই নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মধ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা আছে। ধ্বংসের, নিষ্পেষণের, নিকষ কালো তমসার বার্তা। গত কয়েক শতকের প্রচেষ্টায় যা কিছু অর্জন ঘটেছিল, চেনা-অচেনা শক্তি তা বিনষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ইতিমধ্যে সমাজে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর মধ্য থেকে সরাসরি একটি প্রত্যাখ্যানের স্বর উঠে এসেছে। মুক্তচিন্তার আত্মপ্রকাশের প্রত্যাখ্যান। সঙ্গত কারণেই সবাই ভীত বোধ করছেন। প্রকাশ্যে মত জানাতে অস্বীকার করছেন। ফেসবুক-টুইটার ইত্যাদি নব-গণমাধ্যমের দ্বারা তারা যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদের সংস্কৃতি প্রসারের কথা ভেবেছিলেন, তা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন। নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে লুকিয়ে থাকছেন। তাদের অপরাধ, তারা গোঁড়া ধর্মে বিশ্বাস করেন না। যুক্তি-বুদ্ধি-গ্রাসকারী অন্ধ মতবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চান। ঘোর অপরাধ, সন্দেহ কী! চতুর্দশ শতকে তো এমন অপরাধের জন্য অগ্নিদগ্ধ করা হত। একবিংশ শতকেও সেটা হচ্ছে মৌলবাদীদের চাপাতি ও শাসকের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। মাঝে কিছু আলো এসেছিল, তা এখন আবার নিভছে! প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। অমনোযোগী। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যা বলছেন, তাতে মুক্তচিন্তা নয়, একমুখী ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা-এমনকি হিংস্রতাও সমর্থন পাচ্ছে।

২০১৫ সালে অভিজিৎ রায়কে হত্যার মাধ্যমে আমাদের পেছনযাত্রা যেন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, চিন্তাবিদ, সমাজপ্রগতির কর্মীরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কঠোর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন চালু হয়েছে। এখন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করলে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।

এখন কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, এলজিবিটিদের অধিকারের কথা বললে ধর্মের ষাঁড়দের কোপানলে পড়তে হয়। আর মুক্তমত প্রকাশ করলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের সম্মুখীন হতে হয়। আমরা অনেক সাধনার পর কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে লটকিয়ে, পেট্রোল-বোমায় মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপিকে কোনঠাসা করে চমৎকার এক 'উন্নয়নমুখী' সমাজ নির্মাণ করেছি বটে!