অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন কেন প্রয়োজন

শওগাত আলী সাগর
Published : 18 Feb 2021, 07:33 AM
Updated : 18 Feb 2021, 07:33 AM

ক্যালেন্ডারের পাতা ধরে হিসেব করলে এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এটি ঠিক পরিকল্পিত বা সংঘবদ্ধ কোনো আন্দোলন নয়। তবু এক বছর পর আমরা যখন পেছনে ফিরে তাকাই- নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার মতো বেশ কিছু ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। আমাদের মনে হতে থাকে, টরন্টোর হাড় কাঁপানো বরফ শীতকে উপেক্ষা করে এক বছর আগে আমাদের রাস্তায় দাঁড়ানোটা একেবারে বিফলে যায়নি। কোনো ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই এই আন্দোলনটি এখনো টিকে আছে। বরং এটি এখন একটি চেতনায় রূপান্তরিত হয়েছে। এমন একটি আন্দোলন যে দেশে বিদেশে নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়া দরকার সেটিই বরং বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লুটপাট এবং দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা-পয়সা পাচার করে কানাডায় নিয়ে আসার বিরুদ্ধে কানাডার টরন্টোতে গত বছর যে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল, তার কথা বলছি। 'লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও'- শ্লোগান দিয়ে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানোর গত বছরের ১৪ জানুয়ারি কিংবা ২৪ জানুয়ারির গানে-কবিতায় লুটেরাবিরোধী প্রতিবাদী সমাবেশ- যে কোনোটিকেই আমরা আমাদের প্রারম্ভিক পয়েন্ট হিসেবে ভাবতে পারি। হিমাঙ্কের শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যাওয়া তাপমাত্রায় বরফের ভেতর ডুবে যেতে যেতে টরন্টোর বাংলাদেশিরা সেদিন শ্লোগান তুলেছিল- লুটেরা রুখো স্বদেশ বাঁচাও।

বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে- এ তথ্য সবাই জানত। পত্রিকায় নানা পরিসংখ্যান, নানা খবর ছাপা হয়েছে। এই পাচারকারীরা কানাডায় আসছে, দেশের মানুষের কষ্টে উপার্জিত টাকা-পয়সা লুট করে কানাডায় পাচার করা হচ্ছে- এই তথ্যটি ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের। টরন্টোর বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত কোনো কোনো বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বা সরকারি কর্মকর্তার বাড়ির সামনে থাকা একাধিক অত্যাধুনিক গাড়ি আর আর তাদের লাইফস্টাইলের সাথে দৃশ্যমান আয়-রোজগারহীন জীবনের বৈসাদৃশ্য নিয়ে কমিউনিটিতে এমনিতেই ফিসফাস ছিল। তাদের কেউ কেউ আবার কমিউনিটির নেতা হওয়ার বাসনায় নানা অনুষ্ঠান- সংগঠনে অর্থ বিনিয়োগও শুরু করেন। এই তৎপরতাগুলো প্রবাসীদের মনের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়। এই সময়টাতেই বেশ কয়েকজন ঋণ খেলাপির শত-হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের খবর আসে পত্রিকায়। তাদের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়- এরা তারাই যাদের দৃশ্যমান কোনো আয় রোজগার নেই, অথচ বিলাসী জীবন যাপন করেন, যারা কমিউনিটির নেতা হতে টাকা পয়সা বিলাতে চান। ঢাকার পত্রিকার খবর আর ছবিগুলো যেন বারুদে দেয়াশলাইর কাঠির স্পর্শ ঘটিয়ে দেয়। সেই থেকে শুরু।

'লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও'- আন্দোলনের সংগঠক কে? কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই আন্দোলনে? কেউ না। কোন সংগঠনের ব্যানারে হচ্ছে এই আন্দোলন? কোনো সংগঠন নেই। তবে ব্যানার আছে। ব্যানার হচ্ছে- 'লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও'। এটি আসলে কোনো ব্যানারও নয়, একটি চেতনাবোধ মাত্র। এটি একটি কমিটমেন্ট। এই আন্দোলনে কোনো নেতা নেই, সংগঠন নেই- কিংবা বলা চলে টরন্টোয় বসবাসরত প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি এই আন্দোলনের নেতা, এই আন্দোলনের কর্মী, সংগঠক।

তা হলে কিভাবে এই আন্দোলন সংগঠিত হলো, কার ডাকে মানুষ রাস্তায় নামল? কেউ একজন নিশ্চয় সূতো ধরেছিলেন। হ্যাঁ, ডাক একটা ছিল, সেই ডাকটা দিয়েছিল বাংলাদেশ, মাতৃভূমি বাংলাদেশ। জন্মভূমির বুক ছিদ্র করে দেশের কিছু কুসন্তান দেশের সম্পদ পাচার করে বিদেশে নিয়ে আসছে- এই বোধ তাদের একত্রিত করেছিল। তাদের মনে হয়েছিল- বাংলাদেশ তাদের ডাকছে, বলছে- লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও। কোনো নেতা ছাড়া, সংগঠন ছাড়া কোনো আন্দোলন হতে পারে? হয়েছে তো। হচ্ছে তো। লুটেরাবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এখনো সেটি চলমান আছে।

এই আন্দোলনের এটিই আসলে একটি বড় সৌন্দর্য। কেউ নেতা খুঁজছে না, কেউ সংগঠন খুঁজছে না। সবাই শুধু আন্দোলনের কারণটাকেই বড় করে দেখছেন। চেতনাবোধটাই আসলে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছে।

টরন্টোর ডেনফোর্থের রাস্তার মানববন্ধন আর বাঙালি পাড়ায় সভা-সমাবেশ করলেই কি তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়? এগুলো কি কানাডার সরকারের কানে পৌঁছে? আমরা আমাদের বক্তব্যগুলো, আন্দোলনের বিষয়টা কানাডার মূলধারার রাজনীতিকদের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি, কানাডিয়ান মিডিয়ার কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি। মুদ্রা পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি। আমরা বলি না, আমাদের আন্দোলনের জন্য হয়েছে, কিন্তু কানাডা সরকার গত এক বছরে মুদ্রা পাচার রোধে বেশ তৎপরতা দেখিয়েছে। বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। এটা সত্য, মুদ্রা পাচার রোধে শিল্পোন্নত সাতটি দেশের সমন্বয়ে গঠিত জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে কানাডার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। কিন্তু কানাডা সেগুলো নিয়ে নড়াচড়া শুরু করেছে। মুদ্রা পাচারের ফাঁক ফোকরগুলো বন্ধে উদ্যোগী হয়েছে। ইমিগ্রেশনের যে সুযোগগুলো নিয়ে বিত্তশালীরা সহজে কানাডায় চলে আসে সেগুলো বন্ধ করেছে বা স্থগিত রেখেছে।

এখন পর্যন্ত কানাডার তথ্য হচ্ছে- ভারত, শ্রীলংকা নেপাল হয়ে দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়ার পথ ধরে কানাডায় বাইরে থেকে ডলার ঢুকে। অধিকাংশই আসে তৃতীয় দেশ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকিং চ্যানেলে। সেগুলো কিভাবে চিহ্নিত করা যায়- তা নিয়েও কানাডার সংশ্লিষ্ট সংস্থা কাজ করছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ- বাংলাদেশ থেকে টাকাটা তৃতীয় কোনো দেশ যায়। সেখান থেকে ডলার হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে এক কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ওয়্যার ট্রান্সফার হয়ে যায়। কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের নজরে যেহেতু এগুলো এসেছে, তারা এ নিয়ে নিশ্চয়ই কাজ করবেন। সে সব নিয়ে না বলে আমরা বরং আমাদের আন্দোলনের কথাই বলি।

'লুটেরা রুখো স্বদেশ বাঁচাও'- আন্দোলনের গন্তব্য কী? খুবই ভালো একটি প্রশ্ন। আমরা শুরু করেছিলাম, এই শুরু হওয়াটা জরুরি ছিল। দেশের টাকা বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, করা যায়- এই বার্তা দেয়াটা জরুরি ছিল। আন্দোলনের শুরুতেই আমরা বলেছি, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। আমরা প্রবাসী বাংলাদেশি, দেশের জন্য প্রাণ কাঁদে- এমন কিছু বাংলাদেশি। আমরা সরকার নই, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান নই, আমরা পুলিশ নই। এমনকি আমরা কোনো সংগঠনও নই। আমরা কিছু 'অসংগঠিত' মানুষ মাত্র। আমরা কোনো অর্থ পাচারকারীদের ধরে জেলে দিতে পারব না, শাস্তি দিতে পারব না। আমরা একটা সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলাম- সচেতনতা তৈরি করতে, লুটেরাদের বিরুদ্ধে, দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। আমাদের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার ভাবে একটি বার্তা দেয়া- দেশ থেকে লুটপাট এবং দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা নিয়ে সেগুলো পাচার করে বিশ্বের অন্য গোলার্ধে এসে শান্তিতে বসবাস করা যায়- এই ধারণাটি যে সঠিক না, তেমন একটি বার্তা দিতে চেয়েছি আমরা। আমরা মনে করি, সেই বার্তাটা আমরা কমিউনিটিতে, পাচারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। টরন্টোর মানুষ এখন সামজিক বলয় তৈরির ক্ষেত্রেও লুটেরাদের এড়িয়ে চলে। অর্থ পাচার করে আসা লোকগুলো এখন কমিউনিটি থেকে নিজেদের আড়ালে রাখে।

এটি কি আমাদের সাফল্য? আমরা আসলে সফল হওয়ার জন্য এই আন্দোলনটি শুরু করিনি। আমরা শুধু বার্তা দিতে চেয়েছি, আমরা চেয়েছি দেশে বিদেশে প্রতিটি মানুষের মেনে সেই বার্তাটি সক্রিয় থাকবে, প্রত্যেকেই 'লুটেরা রুখো স্বদেশ বাঁচাও'- এই বক্তব্যটা নিজের অন্তরে ধারণ করবেন। 'লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও'-এই আন্দোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া, এর সফলতা নেই, ব্যর্থতাও নেই। আছে কেবল এগিয়ে চলা। দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের সরকার এখন অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলছেন, উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিচ্ছেন, সরকারি পর্যায়ে নানা রকম তৎপরতা হচ্ছে- এগুলোকেও আমরা আমাদের সফলতা হিসেবে দেখি না। এই ঘটনাগুলো অবশ্যই কাঙ্খিত এবং আন্দোলনের অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া। তবে সরকারের এই উদ্যোগ দিয়ে আমরা আমাদের আন্দোলনের অগ্রগতির পরিমাপ করি না। কারণ আমরা জানি, আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, সচেতনতা তৈরি করা, সামাজিক সচেতনতা। আমরা জানি, অনেক মানুষ, সব মানুষ এই সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে গেলে লুটেরাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ শুরু হয়ে যাবে। সে পর্যন্ত এই আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য অবশ্যই।

আমাদের আরো একটি লক্ষ্য আছে। বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীরা কি কেবল কানাডায় টাকা পাচার করে? না, তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই বসবাস এবং টাকা পাচারে সক্রিয়। কানাডার বাংলাদেশিরা অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, সেকারণে কানাডা আলোচনায় আছে। কাল সিডনি, প্যারিস, লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এই সামাজিক আন্দোলনটা শুরু করলে, সেখানকার নামও আলোচনায় আসবে। আমরা চাইব, বিশ্বের বিভিন্ন শহরের দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিরাও তাদের মতো করে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করবেন, আন্দোলন গড়ে তুলবেন।

আমাদের চাওয়া একটাই – দেশে কিংবা বিদেশে, পৃথিবীর যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আছে, সেখানেই বাংলাদেশিরা 'লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও' – এই কথাগুলো একে অপরের কানে পৌঁছে দেবেন। এটা অত্যন্ত জরুরি।