স্বাধীনতার ৫০ বছর: দ্বিতীয় এশিয়া কাপ এবং হকিতে বাংলাদেশের সেরা সময়

নাজমুল হক তপন
Published : 17 Feb 2021, 11:51 AM
Updated : 17 Feb 2021, 11:51 AM

স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্ট কোনটি? এক কথায় উত্তর- ১৯৮৫ সালের দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকি। ইরানকে হারানো, জাপান-চীনকে রুখে দেওয়া, পাকিস্তানকে আটকে রাখা গল্পের শুরুও হয়েছিল এ আসর দিয়ে।

যদিও ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এই আসরের আগে বিদেশি দলের উপস্থিতিতে বেশ কিছু টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। এর আগ পর্যন্ত উল্লেখ করার মত আয়োজন ছিল আগা খান গোল্ডকাপ, ২০তম এশিয়া যুব ফুটবল, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবল। তবে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলের অংশ নেওয়া বলতে যেটা বোঝায়, এ আসরগুলোর কোনটিই তেমন ছিল না। যেমনটি ছিল হকির ১৯৮৫ সালের এশিয়া কাপটি।

দ্বিতীয় এশিয়া কাপের সময়কাল ছিল ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের দিকে সংক্ষেপে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ক্রিকেট তখনও সম্ভাবনার জায়গাতে পৌঁছায়নি।  ততদিনে অবশ্য আইসিসির দুটো আসরে অংশ নেওয়া হয়ে গেছে বাংলাদেশের। আইসিসির দ্বিতীয় আসরে সেমি-ফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল দল। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে জিম্বাবুয়ের কাছে ৮ উইকেটে হেরে বিদায় নেয় শফিকুল হক হীরার দল। 

বড় অর্জন এসেছে দাবায়। ১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ দাবায় শিরোপা জিতে চমকে দেন রানী হামিদ। দাবার সর্ব্বোচ্চ উচ্চতা গ্র্যান্ডমাস্টারের পথে এগিয়ে যান নিয়াজ মোরশেদ। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল ফুটবল। আন্তর্জাতিক অর্জন না থাকলেও ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের নামে উত্তাল হয়ে উঠত পুরো দেশ। যদিও গুণে-মানে ফুটবলের চেয়ে এগিয়ে ছিল হকি। আগের বছর ওয়ার্ল্ড জুনিয়র হকি প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান পায় বাংলাদেশ। এরকম একটা সময়ে দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকির আসর বসল ঢাকায়। ১০ জাতির এ আয়োজনের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা স্টেডিয়ামে; বর্তমানে যেটির নাম বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।

অংশ নেওয়া দলগুলোর অন্যতম ভারত ও পাকিস্তান। ওই সময়ের বিশ্ব হকির সবচেয়ে সফল দল উপমহাদেশের এ দল দুইটি। এ টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার আগে পাকিস্তানের নামের পাশে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ও এশিয়া চ্যাম্পিয়নের মুকুট। বলা বাহুল্য এর আগেরবার (১৯৮০ সালের অলিম্পিক) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। দুই গ্রুপে পাঁচটি করে দল। 'এ' গ্রুপে স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও ছিল পাকিস্তান, জাপান, চীন ও ইরান।  জয়ে দিয়ে শুরু স্বাগতিকদের মিশন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইরানের বিপক্ষে জয় আসে ৩-১ ব্যবধানে। ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে হ্যাটট্রিক করেন রক্ষণ সেনানী জুম্মন লুসাই। এটি ছিল কোন বিদেশি দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের কোন হকি খেলোয়াড়ের প্রথম হ্যাটট্রিক। ম্যাচে ইরানের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জয়ের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি স্বাগতিক স্ট্রাইকাররা। যার খেসারত দিতে হয় পরে। গোল গড়ে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে যায় জাপান। 

বাংলাদেশের জয়ে শুরুর প্রভাব পড়ে গ্যালারিতে। পরের ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের খেলা মানেই উপচে পড়া ভিড়। মনে রাখতে হবে, ওই সময় ঢাকা স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ছিল ৪০ হাজার। পরের ম্যাচে শক্তিশালী জাপানের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ড্র করে বাংলাদেশ। ঘটনাবহুল ম্যাচটি ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট খানেক বাকি থাকতে পেনাল্টি স্ট্রোক লাভ করে জাপান। সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলকে এগিয়ে নেন তাকামোরি। ম্যাচের শেষ দিকে এই পেনাল্টি স্ট্রোক দেওয়াতে ক্ষেপে ওঠেন দর্শকরা। শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ! খেলা বন্ধ ১৫ মিনিট। এরপর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অনুরোধে দর্শকরা শান্ত হয়। খেলা মাঠে গড়ায়। এবং শুরু হতে না হতেই গোল পরিশোধ করে বাংলাদেশ। লক্ষ্যভেদ করেন সালাউদ্দিন তিসা। গ্যালারিরর উচ্ছ্বাস তখন সপ্তম আকাশে।

তৃতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ চীন। স্নুায়ুক্ষয়ী ওই ম্যাচে একটা পর্যায়ে ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। তবুও দমেনি স্বাগতিকরা। হার না মানা মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের উপর। সুফলও মেলে। প্রথমে ব্যবধান কমান ইসলাম নাসিম। এরপর সমতাসুচক গোল করেন মালেক চুন্নু। এই ড্র দারুণভাবে জাগিয়ে তোলে বাংলাদেশের মানুষকে। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। এই ম্যাচকে ঘিরে যথারীতি উত্তাপের পারদ চড়ে চরমে।  টিকিটের জন্য পড়ে যায় হাহাকার। সারা দেশেই টিভি সেটের সামনে উপচে পড়া ভিড়। যেমনটা পরবর্তীতে দেখা গেছে ক্রিকেটে।

হকির সুবাসে তখন মাতোয়ারা পুরো দেশ। সেমি-ফাইনালে খেলতে হলে ড্র করতে হবে, এই সমীকরণ মেলানোর প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নামে চুন্নু-নাসিমরা। উত্তেজনা ঠাসা ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল উপভোগ্য; শিহরণ জাগানো। শুরু থেকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা জমে ওঠে। গোলের সুযোগও আগে পায় বাংলাদেশ। কিন্তু ফরোযার্ডরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। প্রথমার্ধ গোলশুন্য। দ্বিতীয়ার্ধেও সময়ও প্রায় শেষ। দু'মিনিটেরও কম সময় বাকি। আক্রমণে বাংলাদেশ। এ সময় দলের একজন সদস্য, টিম ম্যানেজার সাব্বির ইউসুফের কাছে সময় কত বাকি জানতে চান। টিম ম্যানেজার বলতে পারেননি। বল নিয়ে ওভারল্যাপ করে উপরে উঠে এলেন অধিনায়ক শাহাবুদ্দিন চাকলাদার। শেষ সময়ে এই আক্রমণাত্মক মনোভাবই কাল হলো। কাউন্টার অ্যাটাক থেকে কলিমুল্লাহর বাড়ানো বল পেয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় গোল করলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তীর হকি স্ট্রাইকার হাসান সরদার। হৃদয়ভাঙা বেদনায় পুড়ল বাংলাদেশ।

ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাইট ইন পজিশনে খেলা কামরুল ইসলাম কিসমত। তিন যুগ আগে খেলা ওই ম্যাচ এখনও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল, "ম্যাচ শেষ হওয়ার দেড় মিনিট বাকি থাকতে গোল খাওয়ার দৃশ্যটা এখনও আমার চোখে ভাসে। বল নিয়ে উপরে উঠে গেলেন অধিনায়ক শাহাবুদ্দিন। ম্যাচ শেষ হতে কত সময় বাকি, জানতে চাইলাম টিম ম্যানেজারের কাছে। বলতে পারলেন না। বল নিয়ে এগুনোর সময় স্লিপ কেটে পড়ে গেলেন আমাদের অধিনায়ক। বল পেয়ে গেলেন ওদের দলের নাইম আখতার। বল দিলেন কলিমুল্লাহকে। জুম্মন লুসাইও ঠিকমত মার্কিং করতে পারেনি। আমি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। কলিমুল্লাহ বল বাড়িয়ে দিলেন হাসান সরদারকে। গোল করতে কোন ভুল করেননি সরদার।" আক্ষেপ বাড়ানো ওই হারে সেমি-ফাইনালে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে ওই আক্ষেপ থেকে হকির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মনে জন্ম নেয় এক গভীর ভালোবাসা।

দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে হকি। মাঠ তো বটেই, নদীর চর, বাড়ির আঙিনা, মোট কথা যেখানেই ফাঁকা জায়গা, সেখানেই হকি। তৈরি হয় অদ্ভুত এক হকি জাগরণের। স্টিকেরও ধার ধারেনি শিশু কিশোররা। প্রত্যন্ত গ্রামেও গাছের ডাল, লাঠি, বিশেষ করে নারকেলের ডাল দিয়ে হকি খেলা শুরু হয়ে যায়। সেসময় বিশেষ করে শহরে হকি স্টিকের সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার ছিল ভাঙচুর আর মারামারি করার সময়। মারামারিতে ব্যবহৃত হকি স্টিকগুলো ফিরতে শুরু করল মাঠে। হকির রাজ্যে যেন বাংলাদেশ পদ্যময়। অবশ্য এই পদ্য সময় লাগেনি জটিল গদ্য হয়ে উঠতে।

এর বহুবিধও কারণ ব্যাখ্যা করলেন ওই সময়ের হকি তারকা কিসমত। 

তার বিশ্লেষণগুলোর দিকে চোখ বোলানো যাক-

১. একটা অপেশাদার কাঠোমোর মধ্য থেকে উঠে এসেছিল আমাদের দলটি। 

২. একই সঙ্গে অনেকগুলো মান সম্মত খেলোয়াড় ছিল দলে। ঘরোয়া লিগে এক সঙ্গে খেলতে খেলতে দলের মধ্যে বোঝাপাড়াও ছিল চমৎকার। যেমন ধরুন, তিসা ও আমি। তিসার একশটা গোলের আশিটাতেই আমার অ্যাসিস্ট ছিল। ঘরোয়া আসরে অনেক দিন ধরে একসঙ্গে খেলতে খেলতে এই কম্বিনেশন তৈরি হয়েছিল। এখন তো দেশে হকি খেলাটাই অনিয়মিত।

৩. অনেক দেরিতে অ্যাস্ট্রোটার্ফ যুগে প্রবেশ। হকির প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর থেকে কমপক্ষে ১৫/২০ বছর পর আমাদের হকি প্লেয়াররা অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলার সুযোগ পেয়েছে। অথচ ১৯৮০'র দশকের শুরুর দিক থেকেই আমরা অ্যাস্ট্রোটার্ফ আনার দাবি তুলেছিলাম। ২০০০ সালেরও পরে এসে অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলার সুযোগ পেয়েছে আমাদের খেলোয়াড়রা। 

৪. অপেশাদার কাঠামো নিয়ে খুব বেশি দুর এগোনো যায় না। ওই সময় যে সমস্যাগুলো ছিল, তা পর্যায়ক্রমে শুধু বেড়েছে। যেমন ১৯৮৫ সালের এশিয়া কাপ হকির কথাই ধরুন। শাহাবুদ্দিন চাকলাদারকে দলে নেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করেন দুই কোচ প্রতাপ শংকর হাজরা ও এহতেশাম সুলতান। প্রতিবাদ স্বরূপ এ দুজন কোচিং করানো বন্ধ করে দেন। এরপর যা ঘটল তা নিশ্চয় জানা আছে? প্রতাপ শংকরকে ১০ বছর আর এহতেশাম সুলতানকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হল। বাংলাদেশ হকিতে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে হকিতে মাঠের খবরের চেয়ে মাঠের বাইরের খবরই মিডিয়াতে বেশি আসছে। গ্রুপ-পাল্টা গ্রুপ, অবাহ্নিত ঘোষণা, নিষিদ্ধ করা, আইন-আদালত করা, এসব হকির নিয়মিত চিত্র। 

৫. হকি খেলাটা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। ফুটবল তো অনেক দুরের ব্যাপার ক্রিকেটের চেয়েও অনেক খরচের খেলা হকি। একটা হকি স্টিকের দাম ৭/৮ হাজার টাকা। হকি কেডস কিন্তু অনেক দামী। আগে ক্রীড়া পরিদপ্তর থেকে বেশ সাশ্রয়ী মূল্যে হকি সরঞ্জামাদি দেয়া হত। এখন এই কার্যক্রম বন্ধ । নিম্নবিত্ত তো দুরে থাক, মধ্যবিত্তদের পক্ষেও হকি খেলতে আসা দুরূহ হয়ে পড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হকি প্লেয়ার উঠে আসা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। হকি প্লেয়ারের জন্য এখন কেবল বিকেএসপিই ভরসা। 

৬. আর্থিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সাহায্য নাই। ফুটবলে আভ্যন্তরীন আয় যাই হোক না কেন, ফিফা কিন্তু নিয়মিতভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়। এ সুযোগ হকিতে নাই। 

হকিতে শুধু বাংলাদেশ কেন ভারত, পাকিস্তানের মত এক সময়ের পরাশক্তিরাও ধুকছে।  এ বিষয়ে কিসমত বললেন, "অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই উপমহাদেশের দলগুলোর পারফরম্যান্স নিম্নগামী। প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে খেলা হলে আবারও সেরা হবে উপমহাদেশের দলগুলো। কেননা আমাদের রিস্টের ফ্লেক্সিবিলিটি অনেক বেশি। তবে এখন তো আর ঘাসের যুগে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নাই। ইউরোপিয়ান পাওয়ার হকির সঙ্গেই মানিয়ে চলতে হবে।" তবে ভারত-পাকিস্তান আর বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন বলেও জানান কিসমত, "হকি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের কিন্তু চেষ্টা আছে। বাংলাদেশের চেষ্টাটুকুও নাই।"

কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে… আমার প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে কিসমত বললেন, "এভাবে চলতে থাকলে …  লিখে রাখুন, দু/তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হকি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আশা করব, আমার এই ধারণা যেন মিথ্যা প্রমাণ হয়।"