সংসদে প্রলাপ এবং স্পিকার সমীপে বিনীত নিবেদন

মামুন আল মাহতাব
Published : 30 Jan 2021, 01:48 PM
Updated : 30 Jan 2021, 01:48 PM

গত ১৯ তারিখ ছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ত্রিশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। লিখি-লিখি করেও লেখা হয়ে ওঠেনি এ নিয়ে। কারণ কিছুটা আলসেমি সত্যি, কিন্তু তারচেয়েও বড় কারণটা হলো ভয়। ভয়টা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে। নির্মূল কমিটি শুধু যে পৃথিবীর বৃহত্তম সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট তাই নয়, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলমান আন্দোলনের নামও বটে। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর বাংলাদেশের যে ক্রমাগত পেছনে হাঁটা আর জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সরকারগুলোর নিঃশর্ত পৃষ্ঠাপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তির এদেশে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠা, সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের 'বাংলাদেশত্ব' ধরে রাখায় প্রথাবিরোধী এ আন্দোলনটির সূচনা। সূচনাটি ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের হাত ধরে আর চলার পথে যে ছিল কত বাধা আর বিঘ্ন, সেতো সহজেই অনুমেয়।

নির্মূল কমিটির গত ত্রিশ বছরের ইস্যুভিত্তিক অবদানগুলো নিয়ে লিখতে বসলে 'মহা প্রবন্ধ' লেখা হয়ে যাবে। কাজটা কঠিন, কারণ এতই বিশাল সেই ব্যপ্তি। গত বছর নির্মুল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি লেখা লিখতে বসে আমার হাড়ে-হাড়ে এ শিক্ষাটি হয়েছে। পঁচাত্তরের পরবর্তী বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীগুলো তাদের পাকিস্তানি প্রভূদের সন্তুষ্টি আদায় করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছিল প্রতিবেশী একটি দেশের লেজুড়বৃত্তিকারী একটি দল হিসেবে। জয় বাংলা থেকে বাংলাদেশ বেতার – খোলনালচে পাল্টে ফেলা হয়েছিল '৭১ আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট কিংবা সম্পৃক্ত প্রতিটি জিনিস। পাকিস্তানিরা হয়েছিল হানাদার, অর্বাচীন মেজর হয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক আর নরঘাতক গোলাম আযম হয়ে বসেছিলেন নেপথ্যে দেশের নিয়ন্তা।

শরণার্থী জীবন শেষে বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন করে চলার সূচনা। সেই সাথে আবারো সঠিক গন্তব্যে যাত্রা শুরু বাংলাদেশেরও। কারণটা সঙ্গত। কারণ 'এ দেশ আর এ দল' একে-অপরের সমার্থক মাত্র। আর বাংলাদেশের সেই নতুন পথ চলায় সঙ্গী ছিল নির্মুল কমিটি। সেদিনের আওয়ামী লীগ অনেক সত্যই উচ্চারণ করতে পারেনি। কারণ দালালের দল সেসব সত্যকে অনায়াসে উড়িয়ে দিত ভারতের দালালী বলে আর বোকার মত বিভ্রান্ত প্রজন্ম গিলেও বসতো মিথ্যার সেই ট্যাবলেটগুলো। আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের জন্য সেই সত্যগুলো উচ্চারণের প্রেক্ষাপটটি তৈরি করেছে নির্মূল কমিটি দফায়-দফায়, নানা প্রেক্ষাপটে, নানা সময়ে এবং করে চলেছে আজও। গোলাম আযমের বিচারের জন্য গণ আদালত থেকে শুরু করে এই সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে লাখো জনতার মানব বন্ধন- এমনি অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে নির্মূল কমিটির গত ত্রিশটি বছরের চলার পথের বাঁকে-বাঁকে। আর সেকারণেই বাংলাদেশের যারা বিবেক, সেসব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা সম্পৃক্ত থেকেছেন নির্মূল কমিটির আন্দোলন-সংগ্রামে বরাবরই। নামের তালিকা দিয়ে এ লেখার দৈর্ঘ্যকে বাড়িয়ে আর ভুল করে বাদ পরা কোন একটি নামের যে ভার, সেই ভার সামলানোর সাধ্য আমার সাধ্যাতিত। তবে এটুকু জেনে রাখুন বাদ ছিলেন না কেউই এবং বাদ নেই এখনও কেউই।

নির্মূল কমিটি যার দালালি করে তার নাম 'বাংলাদেশ' আর এ দালালিতে নির্মূল কমিটি সংশ্লিষ্ট কারো কোন রাখ-ঢাকের বালাই নেই। সেই দালালির জায়গা থেকেই নির্মূল কমিটির লক্ষ্য এদেশ থেকে সেসব দালালদের নির্মূল করা যাদের আফ্রিদিকে দেখলে বলতে ইচ্ছে করে 'মেরি মি' আর ফেইসবুকে 'আমি রাজাকার' লেখা টি-শার্ট পড়ে সেলফি পোস্ট করাতেই যাদের বিকৃত আনন্দ। নির্মূল কমিটির সাথে যুক্ত আমরা কেউই ঘাতক নই, কারো টুঁটি চিপে ধরা বা টেনে-হিচড়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো আমাদের এজেন্ডাও নয়। এর জন্য রাষ্ট্র আছে, আছে রাষ্ট্রের আইন। আমাদের কাজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের পাশে থাকা সহায়ক হিসেবে। পাশাপাশি 'বাংলাস্তানী' ধ্যান-ধারণা আর আদর্শগুলোকে সমূলে উৎপাটন করাও আমাদের লক্ষ্য বটে।

'ঘাতক', 'দালাল' আর নির্মূলের এ ভেদাভেদ বোঝার মেধা যার থাকবে, আমার বিশ্বাস তিনি আর যাই করুন আর নাই করুন, কোন জেনারেলের দালালি করে এমপি-মন্ত্রী হবার খায়েশে নিজের মুক্তিযোদ্ধা সত্তাকে বিসর্জন দিতে পারেন না। মাওলানা মান্নানের মত রাজাকার যার মন্ত্রী ছিল, সেই জেনারেলের ছবি পোস্টারে ছেপে নির্বাচনে প্রার্থী হতেও পারেন না। ক্ষমতা আর অর্থের মোহে কিছু-কিছু মুক্তিযোদ্ধা যে এদেশে দেশ-বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি তা অবশ্যই নয়, তবে তাদের পরিণতিও আমাদের জানা। তাদের গলিত শবদেহ তুলে আনতে হয়েছে প্রত্যন্ত পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে আর তাদের পাকাপোক্ত আসন হয়েছে ইতিহাসের ভাগাড়ে। তাই সংসদে দাঁড়িয়ে নির্মূল কমিটি নিয়ে কোন্ অর্বাচীন কী মন্তব্য করল- তা আমার কাছে কোন বিবেচনাতেই বিবেচ্য নয়। এতে নির্মূল কমিটির কিছুই যায় আসেও না। আমার অস্বস্তির জায়গা একটাই। জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণীতে কোন পাগলের এমনি প্রলাপ আর বিকৃত ইতিহাস বাণীবদ্ধ হয়ে থাকলে তা আমাদের গণতান্ত্রিক আর সংসদীয় ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করে। তাই সংসদে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বন্ধের দাবি তুলেছেন সেই সম্পর্কে মাননীয় স্পিকার সমীপে আমার  নিবেদন, 'অনুগ্রহ করে এই প্রলাপটুকু এক্সপাঞ্জ করুন'!