মানবতার দায় বিঁধেছে গলায়!

সালেক উদ্দিন
Published : 11 Jan 2021, 12:39 PM
Updated : 11 Jan 2021, 12:39 PM

আবারও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গআমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে  প্রসঙ্গটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, যে কোনও না কোনওভাবে এটি এসেই যায় একে আড়াল করার উপায় নেই। তাইতো ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে পুস্তক প্রকাশনা উৎসবে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়কে বলতে হয়- 'রোহিঙ্গা ফেরাতে আমাদের  চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে আমরা চীনের সাথে চারটি মিটিং করেছি। চীন সাহায্যের হাত প্রসারিত করার আশ্বাস দিয়েছে। ভারত-চীন-থাইল্যান্ড সহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গা বিষয়ে আমাদের সাথে একমত পোষণ করেছে। আমেরিকা বলেন, ইউরোপ বলেন- সবাই একবাক্যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বলেছে। সেদিক থেকে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি ড্রাইভার সিটে আছে।"

সবশেষে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও মিয়ানমার এবার কথা রাখেনি। গত সাড়ে তিন বছরে একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যাননি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের এমন কথায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারছিনা বলে দুঃখিত। কারণ এ ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়ন একদিনে হয়নি এটা ছিল মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার সফল প্রয়োগরোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্বিচারে গণহত্যাগণধর্ষণের নরক রচনার মাধ্যমে ১৯৭৮, ১৯৯০, ২০১২, ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৭ বছরগুলোতে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গা নরনারী  শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাদের আশ্রয় দিয়ে সেই সময় বিশ্বমানবতার কাছে বাংলাদেশ ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিল

সর্বশেষ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন দেশত্যাগে বাধ্য করাতে  মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের আকাশ বাতাস যখন কাঁদছিল, যখন তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়নের সে এক করুণ কাব্য পৃথিবীর বুকে লেখা হচ্ছিল, তখন থেকেই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ  নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারে বিশ্বাসীরা অনেক কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরসহ অনলাইন পোর্টাল প্রিন্ট মিডিয়ায় 'সুচির কাছে খোলা চিঠি', 'জ্বলছে রাখাইন হাসছেন  সুচি', 'বিশ্ব বিবেক অং সান সুচি'  'পৃথিবীকে রোহিঙ্গা শিশুর বসবাসযোগ্য করে যাবে কে'? 'আশ্বাসে বিশ্বাস নেই'! 'বিশ্ব মানবাধিকার রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার অধিকার' 'ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারার গোসাই' ইত্যাদি শিরোনামে আমারও বেশ কয়েকটি লেখা ছাপা হয়েছে

এসব লেখায় রাখাইনে রোহিঙ্গা নরনারীর উপর পৈশাচিক নির্যাতনের হাজারো লোমহর্ষক ঘটনা স্থান পেয়েছে, স্থান পেয়েছে গণতন্ত্র মানবাধিকারের মানস কন্যার তকমা পাওয়া এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির দেশের সেনাদের অমানবিক নির্যাতনের কারণে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবন বাজি রেখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার কথা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের করুণ ইতিহাসের কথা, রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি রাখাইন প্রদেশে ফিরিয়ে নেয়ার মতো মিয়ানমারের মিথ্যা আশ্বাসের কথা, মিয়ানমারে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কফি আনান পরিষদের সুপারিশমালা বাস্তবায়িত না হওয়ার কুচক্রের কথা আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার কথা এবং ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস মামলার কথা লিপিবদ্ধ করেছি কোন কোন লেখায় অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা যারা মানুষের কথা বলতে চাই এবং লিখতে ভালবাসি তাদের সেসব লেখা রচনাবলী এখন স্থান পেয়েছে ডাস্টবিনে মোচড়ানো কাগজ হিসেবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি

অথচ  বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলের আট হাজার একর এর উপরে বন উজার করে বসতি স্থাপন করেছে  জ্বালানি হিসেবে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে ভূমিরূপ পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় ঘটিয়ে যাচ্ছে সংসদীয় কমিটির হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুধু কি তাই? শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আধিপত্যের কারণে কক্সবাজারের ওইসব এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের কর্মসংস্থান জীবিকার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে  পরিণত হয়েছে 

শুধু পুস্তক প্রকাশনা উৎসবে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কথায়ই নয় বরং সার্বিক পরিস্থিতি দেখে ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে, এসব শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা কি আদৌও সম্ভব হবে? এবিষয়ে গেল সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী  জনাব ওবায়দুল কাদের তার প্রাত্যহিক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বললেন, "বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করে আসছে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।" এবার তিনি  'মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কার্যকর কৌশল অবলম্বন করাতে হবে' বলে উল্লেখ করলেন

সরকারের একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন বলেন 'চাপ সৃষ্টি করাতে হবে' তখন বড় জানতে ইচ্ছে করে- এই চাপ সৃষ্টির জন্য উল্লেখযোগ্য কী করতে পেরেছি আমরা? আমরা কি মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করেছি?  নিজেরা ব্যবসাবাণিজ্য চালিয়ে যাব আর আশা করব পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সমূহ আমাদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করবেএটা কী হয়!

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা করেছে গাম্বিয়ার মতো একটি দেশ আমরা করিনি? কেন করিনি? কার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে করিনি? চীনরাশিয়াভারতনা এর পেছনে অন্য কারণ আছেনাকি 'ধরি মাছ না ছুঁই পানিনীতিতে এই সমস্যার সমাধান চাচ্ছি আমরা? 

পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের বর্ণিত কূটনৈতিক তৎপরতার কথা প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক উদ্যোগ চীনের ভেটো, রাশিয়ার পিছপা এবং ভারতের ভোটদান থেকে বিরত থাকার ঘটনায় স্তিমিত হয়ে পড়ে। 'চীন সাহায্যের হার প্রসারিত করার আশ্বাস এবং ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গা বিষয়ে আমাদের সাথে একমত পোষণ করা'র কি এই নমুনা? রোহিঙ্গাদের দেশে  ফেরানোর বিষয়ে অন্তরায় সৃষ্টি করা চীন, রাশিয়া, ভারিত-এই তিনটি দেশই আমাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য পদ্মাসেতু থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বৃহৎ বৃহৎ প্রায় সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পার্টনার। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সৌহার্দ্যপূর্ণ ভার্চুয়াল বৈঠকে আমরা পরিতৃপ্ত হয়েছি তার পরপরই বাংলাদেশ  নিয়োজিত ভারতের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক- রক্তের সম্পর্ক।" এরপরও কূটনৈতিক তৎপরতার ফল পাচ্ছি না কেন?

আরেকটি সাম্প্রতিককালের খবর হল এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ (৫৫ হাজার রোহিঙ্গা) বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও চাকরি নিয়ে ইতিপূর্বে সৌদি আরব গেছেন। করোনাভাইরাসের সময়ে তাদের এক বৃহৎ অংশের পাসপোর্ট এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।সৌদি সরকার স্বাভাবিকভাবেই বলছে তাদের  পাসপোর্ট নবায়ন করতে অথবা বাংলাদেশে  ফেরত আনতে। তারা নাকি রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক সদয়! তবে তাদের দেশে আইনে ভিনদেশিদের নাগরিকত্ব দেয়ার নিয়ম নেই। তাই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে পারছেন না অথবা রাখতে পারছেন না। আর আমরা কত সহজে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে যাওয়ার পথ করে দেই! এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেল কিভাবেকাদের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশি হয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিল? এর হদিস হওয়া জরুরি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে এমন  ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যেন এধরনের রাষ্ট্রদ্রোহীতার ঘটনা আর না ঘটে। 

তারপরও অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, দায়ীদের পরিচয় আমরা কোনদিন জানবো না এবং তাদের শাস্তিও হবে না। এরা কারা? কেন এদের পরিচয় জানা যাবে না? উত্তর একটাই- সবকিছু সহজের দেশ বাংলাদেশ। অন্য দেশের নাগরিকরা এদেশে ন্যাশনাল আইডি কার্ড পেতে পারে, পাসপোর্ট পেতে পারে। এক মুহূর্তে বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে যেতে পারে। কোথাও কোনো বাঁধা নেই!

বাংলাদেশের জন রপ্তানির বড় উৎস হল সৌদি আরব সৌদি আরবের চাপাচাপিতে আমরা যদি রহিঙ্গাদের অবৈধ উপায়ে পাওয়া মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্টের নবায়ন করে দেই তবে তা হবে আরেক ট্রাজেডি।

মানবিকতার দায় হিসেবে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর হাত থেকে  বাঁচাতে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। মানবাধিকারের সর্বোচ্চ সন্মান প্রদর্শন করেছি, তাদের জন্য বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের  হুমকিকেও কাঁধে নিয়েছি, স্থানীয়দের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছি, তাদের জীবিকায় শরণার্থীদের ভাগ বসিয়ে  মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। বিশ্ববিবেকের বাহবা পেয়েছি। আবার তাদের নিজভূমে প্রত্যাবর্তনে এখনো সফলকাম না হতে পেরে বিশাল এক জনগোষ্ঠির কাঁধে নিয়ে ঘুরছি। সব মিলিয়ে মানবতার দায় গলায় বিঁধিয়েছি। এবার প্রয়োজন দায়মুক্তির। শরণার্থীদের ভাসান চরে পুনর্বাসন, অবৈধ পাসপোর্টের নবায়ন সমাধান নয়।

ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন। তার কথায় এদেশের মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। শুধু কথায় নয়- কাজে আসুন। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবর্তনের জন্যে অবশ্যই মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের বিষয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশসহ পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে সর্বোচ্চ এবং সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান এবং জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনসমূহকে এ বিষয়ে একসঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে আনার জন্যে যে কৌশল অবলম্বন প্রয়োজন, বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারকরা তাই করুন এবং সফলকাম হন- সেটাই প্রত্যাশা।