জল্পনা চলছেই বাইডেনকে ঘিরে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 11 Nov 2020, 04:57 PM
Updated : 11 Nov 2020, 04:57 PM

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বে বিরাজ করছে একক ক্ষমতাবলয়, যে ক্ষমতার অধীশ্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীন এবং রাশিয়া কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হলেও, এর কোনটিই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দেওয়ার অবস্থানে নেই। যার কারণে পৃথিবীব্যাপি ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা এখন যুক্তরাষ্ট্রেরই। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের সকল দেশেই জল্পনা কল্পনা। বিশ্বের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতির উপর। 

পর্লামেন্টারি এবং রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতির একটি মৌলিক একটি পার্থক্য হলো প্রথম পদ্ধতিতে সরকার প্রধানকে তার রাজনৈতিক দলের কথা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থায় অনেকখানি ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। তার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় তার মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের উপদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল দুটি দলের মধ্যে  বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ডানপন্থি কট্টরবাদ এবং বামপন্থি উদার নৈতিকতায়। তাই ব্যক্তি বিশেষ সে দলই বেছে নেন যেটি তার ব্যক্তিগত মেজাজ মর্জি, মনন এবং দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই অর্থে একজন ডেমোক্র্যাট এবং একজন রিপাবলিকানের দলীয় পরিচয় থেকে তার অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশনীতি অনেকাংশে আঁচ করা যায়।

প্রাথমিকভাবে ১৩টি অঙ্গরাজ্য ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বিদ্রোহী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে যা পূর্ণতা পায় ১৮৭৩ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে। যুদ্ধ শুরু হয় ১৭৭৫ সালে এবং ১৭৭৬ এর জুলাই মাসে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে ১৩টি অঙ্গরাজ্য ব্রিটিশ রাজ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। 

শুরুতে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন সর্বসম্মতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল কমান্ডার হিসেবে তার একচ্ছত্র জনপ্রিয়তার কারণে। তিনি কোনও দল তো করেননি। বরং আমেরিকা রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে বিভক্ত হোক সেটাও তিনি চাননি, যা তিনি বিদায় বাণীতে প্রকাশ্যেই উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী- যথা আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, থমাস জেফারসন এবং জেমস্ মেডিসন, যারা সকলই আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জনক, দল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ছিলেন। তবে সে দলগুলো বর্তমান দল প্রথার আদলে ছিল না। তখন দলীয় বিভক্তি ছিল দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী মতধারার মধ্যে- যার একটি ছিল যারা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষে, যাদের নাম হলো ফেডারেলিস্ট, অর্থাৎ যারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান অনুমোদনে ভোট দেন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন হ্যামিলটন এবং অপরটিতে ছিলেন তারা যারা জোড়ালো কেন্দ্রিয় শাসনের বিরোধী, যারা সংবিধান অনুমোদন করেননি, যার নেতৃত্বে ছিলেন জেফারসন এবং মেডিসন, যার নাম হয় ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান দল। ফেডারেলিস্ট নেতা জন অ্যাডামস ১৮০০ সালে দেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে হেমিলটনের প্রয়াণের পর ফেডারেলিস্ট দলের অবক্ষয় শুরু হয় এবং ডেমোক্র্যাট -রিপাবলিকানদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৮২০ এর দিকে প্রথমে শুরু হওয়া দল দুটির অবসান ঘটে। অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ৭ম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর প্রাক্তন রিপাবলিকানদের একটি অংশ জ্যাকসনের সমর্থনে যোগ দিলে, সেটিই পরবর্তিতে বর্তমান ডেমক্র্যাট দলে রূপান্তরিত হয়। আর যারা জ্যাকসন বিরোধিতায় হেনরি ক্লেকে সমর্থন দিলেন তারা হুইগ দলের সাথে মিশে গেলেন, শুরু হলো ২য় রাজনৈতিক দল পদ্ধতি। জ্যাকসনপন্থিরা ছিলেন সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের এবং সাম্যের ভিত্তির পক্ষে। তারা উত্তরাধিকারসুত্রে এলিট নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং রাজনীতিতে সকল মানুষের পক্ষে নীতি গ্রহণ করেন। মোট কথা তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতিফলনের দল হিসেব আত্মপ্রকাশ করে বিধায় বর্তমানে ডোমোক্রেটরাও সেই ধারার বাহক। অন্যদিকে হুইগ গ্রুপ অনুসরণ করল জেফারসন- মেডিসনের অভিজাত শ্রেণীনীতি যার প্রতিফলন লক্ষিত হয় বর্তমান রিপাবলিকান দলে।

১৮৫৪-তে শুরু হয় তৃতীয় রাজনৈতিক দল সৃষ্টির অধ্যায়। সে অধ্যায়ে প্রভাবিত হয় নতুন রিপাবলিকান ধারায় বা পুরোনো হুইগ দলীয় ধারা। এর মধ্যে কৃতদাসদের বিষয় আমেরিকার রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকায় চলে আসে, যা শেষ অবধি গৃহযুদ্ধের কারণ ঘটায় এবং যে যুদ্ধে জয়ী হন আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে নতুন রিপাবলিকান দল। ১৮৫২ সাল থেকে এই দুটি দলের নতুন সংস্করণই সকল রাষ্ট্রপতি এবং কংগ্রেস নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে আসছে। তৃতীয় রাজনৈতিক দল পদ্ধতির পর থেকেই নতুন সংস্করণে রিপাবলিকান দল আমেরিকার রক্ষণশীল মতবাদের ধারক হিসেবে অস্তিত্বে রয়েছে। অন্যদিকে ডেমোক্রেট দল প্রগতিপন্থী, শ্রমিক এবং সামাজিক উন্নয়নের দল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে সেই অবস্থানে এখনও  রয়েছে।

অনেকে ডেমোক্র্যাট দলকে যুক্তরাজ্যের শ্রমিক দলের সাথে তুলনা করলেও, সেটি ঠিক নয়। মূলত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ যেন ব্রিটেনে ধাক্কা দিতে না পারে সে উদ্দেশ্যেই ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের ধারায় এবং ওয়েলফেয়ার রাজ্যের ধারণা নিয়ে শ্রমিক দল গড়ে উঠে। তবে সেই দলে বিভিন্ন সময়ে কট্টর মার্কসপন্থিদের আধিপত্য ছিল। যেমন, অ্যান্থনি ওয়েজউড বেন, লাল কেন বলে পরিচিত কেন লিভিং স্টোন, স্কারগিল, এমনকি সদ্য বহিষ্কৃত নেতা জেরেমি করবিন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম শ্রমিক দলীয় প্রধানমন্ত্রী ক্লেম এটলিও কিছুটা মার্কসপন্থি ছিলেন। কিন্তু আমেরিকান কোন দলই সমাজতন্ত্রের কথা বলেন না। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের আদর্শের প্রতিফলন অনেক ক্ষেত্রে অভিন্ন। আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং জনবান্ধব রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচিত, আব্রাহাম লিংকন কিন্তু সাধারণ মানুষের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ডেমোক্র্যাট দলের ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন রক্ষনশীল রিপাবলিকান নেতা এবং সে দলের প্রথম রাষ্ট্রপতি। কৃতদাস মুক্ত করার মতো আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রগতিশীল কাজটি তিনিই করেছেন, দিয়েছেন গণতন্ত্রের সার্বজনীন সংজ্ঞা।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে কয়েকটি অতি সমালোচিত এবং প্রগতি বিরোধী ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন প্রগতির ধারক হিসেবে পরিচিত ডেমোক্র্যাট দলের রাষ্ট্রপতিরা। ১৯৪৫ সালে জাপানে দুইটি আনবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লাখ লাখ নিরস্ত্র, নিরীহ জাপানিদের হত্যা করে বিশ্ব সমাজের কাছে ঘৃণীত হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট হ্যারি ট্রুম্যান। তাছাড়াও তিনি সোভিয়েত বিরোধী নীতি গ্রহণ করে শীতল যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, তার 'ট্রুম্যান মতবাদ' এর উপর ভর করে। একইভাবে ১৯৬২ সালে বিশ্ব নিন্দিত কিউবা সংকটও সৃষ্টি করেছিলেন ডেমোক্র্যাট জন কেনেডি। গাদ্দাফি হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট ওবামা।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূচনায় রিপাবলিকান আইজেন হাওয়ার ক্ষমতায় থাকলেও, ডেমোক্র্যাট কেনেডি এ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ডেমোক্র্যাট কেনেডি ব্রিটিশ রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ম্যাক মিলনের সাথে মিলে ইন্দোনেশিয়ার  রাষ্ট্রপতি সুকর্ণকে হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সুহার্তকে ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছিল কয়েক লাখ ইন্দোনেশিয়ানকে। অতি ভদ্র ডেমোক্র্যাট রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারও কিন্তু নিকারাগুয়ার বামপন্থি সান্ডানিস্টা নেতা ডেনিয়েল অরটেগাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এসব ঘটনা থেকে নিশ্চিত বলা যায়, যে পররাষ্ট্র বিষয়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের কোনও পার্থক্য অতীতে কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ডেমোক্র্যাটরা একটু বেশি কট্টর ভূমিকায় ছিলেন। তাই ডেমোক্র্যাট হিসেবে বাইডেন নমনীয় বিদেশনীতি অনুসরণ করবেন ভাবার কোন কারণ নেই। বরং তিনি অনেকটা ট্রাম্পীয় নীতিতে চলবেন বলেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

তাছাড়া আমেরিকার ব্যাপারে একটি কথা কিন্তু বহু বছরের পরীক্ষিত সমীকরণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যা হলো রাষ্ট্রপতি বদল হলেও নীতি নির্ধারকরা অপরিবর্তিতই থাকেন। তবে বাইডেনের সাম্প্রতিক উক্তি থেকে বলা যায়, কিছু কিছু বিষয়ে মৌলিক পরিবর্তন হবে। বিশ্ব যেসব বিষয় নিয়ে মনোযোগী- তার মধ্যে রয়েছে চীনের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য ট্রাম্প আমলের ইন্দো-প্যাসিফিক মোর্চা গঠন প্রক্রিয়া, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যনীতি, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্বস্বাস্থ্য নীতি, বিশ্ব জলবায়ুনীতি, পরমানু নিয়ন্ত্রণনীতি এবং একান্তভাবে বাংলাদেশের জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা বিষয়ে নীতি এবং অভিবাসননীতি। বাইডেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তিনি ট্রাম্পের কিছু বিকৃত সিদ্ধান্ত পরিহার করবেন যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসা এবং অর্থায়ন বন্ধ করার ট্রাম্পের অপ্রকৃতস্ত সিদ্ধান্ত, বিশ্ব জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। এই পরিবর্তন উন্নয়নশীল দেশের জন্য পরম হিতকর হবে।

চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক মোর্চার পরিকল্পনার বিষয়ে নিশ্চিত বলা যায় যে এ ব্যাপারে বাইডেন ট্রাম্পের সিদ্ধান্তই অব্যাহত রাখবেন। নির্বাচন পূর্বে বাইডেন চীনের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করে বলেছিলেন চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তিনি চীনা রাষ্ট্রপ্রধানকে একজন ঠগি দস্যু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং উইঘুর মুসলিম নির্যাতনকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করেন। তিনি হয়তো চীনের সাথে আলোচনার টেবিলে যেতে পারেন কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক মোর্চার ব্যাপারে নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এই প্রস্তাবিত মোর্চা পরিত্যাগ করলে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, কোরিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা বাইডেন হতে দেবেন না। তাছাড়া এই পরিকল্পিত মোর্চা থেকে প্রস্থানের অর্থ হবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, যা হবে যুরাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী। তদুপরি এটি হবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক সমুদ্র সম্মেলনের (আনক্লস-তিন) ধারাবাহিকতায় সমুদ্র নিয়ে যে সকল কনভেনশন হয়েছে এবং কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনে মহাসাগর নিয়ে যেসব বিধান রয়েছে সেগুলোকে চীনের বেআইনি দাবির কাছে সমর্পণ করা। চীনের সরকারি গ্লোবাল টাইমস সাময়িকীও সম্প্রতি একই ধারণা ব্যক্ত করেছে। চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

চীনের আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যের একটি বড় সংঘটক হচ্ছে হুয়াই কোম্পানি। এই কোম্পানির সাথে এক সুবৃহৎ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার পর ব্রিটিশ গোয়েন্দারা দাবি করেন , এই কোম্পানির সাথে চুক্তি টিকিয়ে রাখলে ব্রিটিশ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং এর পরেই ব্রিটিশ সরকার চুক্তি থেকে সরে যায়। ইউরোপের আরও ক'টি দেশও একই কারণে হুয়াইকে বর্জন করেছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উক্ত কোম্পানির সাথে বাণিজ্য রাখার সিদ্ধান্ত অকল্পনীয়। যেখানে চীনের আলিবাবা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের আমাজনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, সেখানে আমাজনের এবং ই-বেই এর স্বার্থ রক্ষায় 'আলিবাবা'কে বর্জন করাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুলে। কোভিড-১৯ মহামারীর জন্য স্যামসং, অ্যাপল প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানি চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়েছে। এগুলোর আর চীনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। করোনাকালে চীন যুক্তরাষ্ট্রে যে সকল স্বাস্থ্য সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে তার এক বৃহৎ অংশ নিম্নমানের বলে ধরা পরার পর যুক্তরাষ্ট্র সেগুলো ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

চীনা সামগ্রী আমদানিতে রয়েছে অনেক বাধা, বাড়ানো হয়েছে শুল্ক। শুল্ক কমানোর কোন ইচ্ছেই বাইডেনের সাম্প্রতিক বক্তব্যে পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলোকে তিনি চীনা আগ্রাসন এবং বাণিজ্যিক সম্প্রসারণবাদ ঠেকানোর পন্থা হিসেবেই ব্যবহার করবেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।  ইসরায়েল এবং মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প শেষ সময়ে কয়েকটি আরব দেশকে প্রভাবিত করেছেন ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করতে। আর সে দেশগুলোও বহু যুগ ধরে আন্দোলনরত প্যালেস্টাইনিদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে শান্তিচুক্তি করেছে ট্রাম্পের উস্কানিতে। একই সময়ে ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস  ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়েছে। এ ব্যাপারে বাইডেন  ট্রাম্পের আয়োজনই অনুসরণ করবেন বলে ধরে নেওয়া যায়।

জেরুজালেমে মার্কিন রাজধানী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বাইডেন পরিবর্তন করবেন না বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তিনি ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য- 'যা করণীয় যুক্তরাষ্ট্র তাই করবেন' বলে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন এবং নিজেকে নেতানিয়াহুর ত্রিশ বছরের বন্ধু এবং ইহুদিবাদী বলে দাবি করেছিলেন।

উল্লেখ্য যে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের ইহুদীরা গণমাধ্যম, ব্যাংক, আইনপেশা, চিকিৎসা পেশা, ব্যবসা এবং সর্বোপরি রাজনীতি এত শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যে, কোনও মার্কিন রাষ্ট্রপতির পক্ষে ইহুদীদের খেপিয়ে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়, যা তারা সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের শ্রমিক দলের সক্ষম নেতা করবিনকে অপসারণ করতে পেরে প্রমাণ করেছেন। এমনকি ওবামাকেও ইসরায়েল তোষামদনীতি লালন করতে হয়েছে। তবে যেটুকু পরিবর্তন হতে পারে তা হলো ওয়াশিংটনে প্যালেস্টাইন মিশন পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুমোদন এবং প্যালেস্টাইনকে সংযুক্ত করে আলোচনা পুনরায় শুরু করা।

ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি পুনরায় আলোচনায় আনতে বাইডেন ইচ্ছা প্রকাশ করলেও দেশটি মার্কিন শর্তে রাজি হবে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। একই সাথে রয়েছে ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়। ইরান আগেই বলেছে- যুক্তরাষ্ট্রে কে নির্বাচিত হবেন তাতে ইরানের কিছু আসে যায় না। ট্রাম্পের 'আমেরিকা প্রথম' নীতির ফলে প্রায় সব রাষ্ট্রই বাণিজ্যিক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাইডেন সে নীতি পরিহার করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ট্রাম্প সূচিত অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করে তা সহজ করবেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার উপর যে বিধি -নিষেধ ট্রাম্প আরোপ করেছিলেন তাও তুলে নেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। উত্তর কোরিয়ার সাথে কী হবে তা আচঁ করা কঠিন, তবে যুদ্ধ নিশ্চয়ই বাঁধবে না। 

বাইডেনের বিজয় যে বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদ তা প্রায় সকল পর্যবেক্ষকদেরই ধারণা। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একমাত্র চীনই নিশ্চিত করতে পারে, যে দেশটি বারবার নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দিয়ে এই সমস্যা জিইয়ে রাখছে। রোহিঙ্গা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে বিষয়টি যতবার নিরাপত্তা পরিষদে উঠেছে ততবারই মিয়ানমারেরর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু চীন-রাশিয়ার ভেটোর কারণে কিছু করতে পারেনি। মিয়নমারের উপর চীনের যেমন নিরঙ্কুশ প্রভাব রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা নেই। তাই চীন মিয়ানমারের সমর্থনে অন্ধ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। প্রয়োগ ক্ষমতা, নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অবরোধ ক্ষমতা, অস্থায়ী ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সবগুলো ক্ষমতা একান্তই নিরাপত্তা পরিষদের, যা চীন-রাশিয়া তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করলে সম্ভব হবে না। কোন দেশ আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার দেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের সেটা জেনেই মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তবর্তীকালীন আদেশগুলো অমান্য করে যাচ্ছে। তবে পৃথিবীর শীর্ষ সম্পদশালী দেশ হিসেবে চাপ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই পারে, এবং নিজ উদ্যোগে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যেমনটি ইরানের বিরুদ্ধে করেছে।

আমেরিকায় বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। অপরাধ দমনে কঠোরতার মন্ত্রে দীক্ষিত ডেমোক্র্যাট দলের রাষ্ট্রপতি এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আমাদের রপ্তানি দ্রব্যের উপর আরোপিত জিএসপি সুবিধার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে দাবি তুলেছেন, সে ব্যাপারে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, আশার আলো দেখা যাচ্ছে আমাদের থেকে আরও অধিক তৈরি পোশাক ক্রয়ের ব্যাপারে। জাতিসংঘের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে আমাদের দেশ থেকে আরও অধিক সৈন্য এবং পুলিশ শান্তিরক্ষা মিশনে নেওয়ার ব্যাপারেও আমরা আশাবাদী থাকতে পারি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-বহরের সাথে আমাদের নৌ-বহরের একটি যৌথ মহড়া শেষ হয়েছে। এটি নিশ্চিতভাবে একটি শুভ উদ্বোধন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্তের সুচনার স্বাক্ষর।