ধর্ষণের রাজনীতি!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 Oct 2020, 02:01 PM
Updated : 7 Oct 2020, 02:01 PM

দেশে ধর্ষণের মচ্ছব চলছে তো চলছেই। প্রতিদিন নিত্যনতুন ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ নিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষাও চোখে পড়ার মতো। দলবদ্ধভাবে একটি নারীকে ধর্ষণ করা হলে তাকে বলা হচ্ছে গণধর্ষণ। যদিও 'গ্যাং রেপ' এবং 'গণধর্ষণ' কথা দুটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। অনেকে আবার ধর্ষিতা নারীকে 'ভিক্টিম' হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এই বিশেষণ ঘোষণা করে: পুরুষ হলো শিকারী, নারী তার শিকার। হরিণ শিকার, পাখি শিকার, মাছ শিকারের মতো ধর্ষণও হয়ে ওঠে একটি প্রত্যাশিত ঘটনা!

ধর্ষণের মূলনীতি বলাৎকার। বলাৎকার কথাটার একটি অর্থ যেমন 'ধর্ষণ', তেমনই বলাৎকার কথাটার অপর অর্থ বলপ্রয়োগ, তথা 'শক্তিপ্রয়োগ', 'অত্যাচার', 'জুলুম', 'জবরদস্তিমূলক আচরণ' (বাংলা একাডেমি সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান)। 'বলাৎকার' হচ্ছে এক দিকে 'বল দ্বারা করণ, বলপ্রয়োগ', 'অন্যায়', 'অত্যাচার'; এবং অন্য দিকে 'বলপূর্ব্বক সতীত্বনাশ (রেপ)'। বলাৎকার শুধু নারীর ওপরই ঘটে না, পুরুষের ওপরও ঘটে। যেহেতু ঘটনাটা বলপ্রয়োগের, আধিপত্যের– টার্গেট সবসময়ই তাই দুর্বল সত্তা। টার্গেট তাই নারী, শিশু, গরিব, প্রান্তিক জনজাতি ইত্যাদি। পুরুষ-শিশুও ধর্ষণ এবং সহিংস যৌন নিপীড়ন থেকে রেহাই পায় না। বাসায় না, স্কুলে না, স্কাউট ক্যাম্পে না, ছাত্রাবাসে না, মক্তবে না, মাদ্রাসায় না, এমনকি মসজিদেও না। পুরুষ-বাচ্চার বলাৎকার অবশ্য আমাদের সমাজে অনালোচ্য। স্ট্যান্ডার্ড পুরুষতান্ত্রিক কোড মোতাবেক পুরুষ ধর্ষণযোগ্য নয়। ধর্ষিত পুরুষ আরেকটা 'মাগি' মাত্র, 'মরদ' নয় (ধর্ষণ বলপ্রয়োগ বলাৎকার, সেলিম রেজা নিউটন, ২৯ জানুয়ারি ২০১৩, দৈনিক ইত্তেফাক)।

নারী এবং পুরুষের মাঝখানে উপস্থিত যৌন ক্ষুধা এবং যৌন অবদমন। দু-জনের বেলায় এর প্রকাশ দু-রকম। পুরুষের বেলায় আগ্রাসন-আক্রমণ, অর্থাৎ নারীধর্ষণ। নারীর বেলায় যৌনসত্তার 'সেক্সি' বিনির্মাণ ও বিনিময় দিয়ে পুরুষকে ম্যানিপুলেট করা, করায়ত্ত করা। নির্দিষ্ট মাপমতো যৌনতা এখন ক্ষমতা বৈকি। এ দিয়ে পুরুষকে কব্জা করা যায়। দুটোই পুরুষতান্ত্রিক। দুটোই প্রেমহীন। কামপরায়ণ। প্রেম মানে সঙ্গীকে পরিতৃপ্ত করে নিজে সুখী হওয়া। কাম মানে সঙ্গীকে ব্যবহার করে আত্মরতি চরিতার্থ করা। এ আসলে কর্তৃত্বপরায়ণ বাসনা। অথরিটারিয়ান ডিজায়ার অফ ডমিনেশন। এই সুখ আধিপত্যের বিকৃত সুখ (সেলিম রেজা নিউটন, ঐ)।

ধর্ষণে যৌনসুখ নেই। এমনকি এতে কামও চরিতার্থ হয় না। আছে কেবল শক্তির প্রকাশ, বিকৃতি। তারপরও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণকে অনেকে আবার 'ইজ্জত লুণ্ঠন'ও বলে। কিন্তু ধর্ষণের সঙ্গে 'ইজ্জতের' সম্পর্ক কোথায়? কারও শরীরের সঙ্গে জবরদস্তি করা, ধর্ষণ করাকে 'ইজ্জত লুটে' নেওয়া কেন বলি আমরা? আমরা কি সত্যিই বিশ্বাস করি, যে একজন নারীর যাবতীয় সম্মান স্রেফ যোনিপথেই আবদ্ধ হয়ে আছে?

আসলে ধর্ষণ আর ইজ্জত, আপাত সম্পর্কহীন এই দুটো শব্দকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে সমাজ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা। সমাজ তো আমাদের নিয়েই তৈরি! এই 'ইজ্জতের' সঙ্গে নারীর শরীরকে বহুকাল আগেই জুড়ে দিয়েছি আমরা। আমরা সবাই মিলে 'রীতি' বানিয়েছি যে, মেয়েরাই সম্মান-লাজ-লজ্জার ধারক-বাহক।

ধর্ষণ একটা জঘন্য অপরাধ। স্রেফ যৌনতা নয়। স্রেফ সেক্সুয়াল আর্জ নয়! বরং এটা সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স। ধর্ষণ আসলে রাজনৈতিক একটা অপরাধ। শরীরের রাজনীতি, জবরদখলের রাজনীতি। একজনের শরীরে অন্যজনের জবরদস্তির দখলদারি। মজা দেখানো। ভয় পাওয়ানো। ক্ষমতার জোর ফলানো! বুঝিয়ে দেওয়া, যে আমার এতটাই ক্ষমতা, যে চাইলেই তোমাকে 'ভোগ' করতে পারি, তোমাকে নিয়ে 'মজা' করতে পারি। তোমার শরীরকে দুমড়ে-মুচড়ে খামির বানাতে পারি।

প্রত্যেকটা ধর্ষণের হিংস্রতায় এই ক্ষমতার-রাজনীতি লুকিয়ে আছে। যে ক্ষমতার জোরে বিরোধীদের কোণঠাসা করা যায়, ঠিক সেভাবেই একজন নারীর শরীর দখল করে তাকে সমাজের একেবারে কোণে ঠেলে ফেলা যায়! ধর্ষণের বিচার চেয়ে গলা চড়াতে হলে তাই এই শরীর-রাজনীতির দিকেও আঙুল তুলতে হবে। এমন একটা ভয়ঙ্কর পাওয়ার-পলিটিক্সকে শুধু যৌন লালসা বলে দেওয়া মানে অপরাধের অভিঘাতকেই খাটো করা! পেশিশক্তির পাশবিক বহিঃপ্রকাশকে, কোনও এক নারীকে 'ক্ষমতা' দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে কেবল যৌন লালসা বলাটা ভুল হবে। ধর্ষণ কেবল নারীর উপর নিরন্তর ঘটতে থাকা 'লালসা'র বহিঃপ্রকাশ নয়!

ধর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি। ধর্ষণ ক্ষমতার রাগ বা ক্ষমতাবানের রাগের প্রকাশ। এটা ক্ষমতার প্রত্যাঘাত বা অপমানের প্রতিশোধও বটে। আমার শক্তি আছে, তোমাকে সম্ভোগ করব। ধর্ষণকাণ্ড মানেই তো ক্ষমতার উল্লাস। একটা মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, বাধার বিরুদ্ধে, একা কিংবা কয়েকজন তার শরীরটাকে তছনছ করলাম, মেয়েটা কিছুই করতে পারল না এটা তো আমার শক্তির জয়, আমার আধিপত্যের সুপ্রতিষ্ঠা। অনেক দেশের সেনাবাহিনী যুগে যুগে অন্য দেশ দখল করার সময় (এমনকী নিজের দেশের ভেতরেও বিদ্রোহ দমন করার সময়), মোটের ওপর ধর্ষণ করে থাকে, সেটা কিন্তু শুধুই দীর্ঘ দিন ঘর-পরিবার ছেড়ে থাকা, মেয়েমানুষের মুখ দেখতে না পাওয়ার খিদে থেকে নয়! দখল করা ভূমির মেয়েদের শরীরের ওপরেও একতরফা দখলদারি আসলে আধিপত্য কায়েমে সাহায্য করে। পদানত জনতার মগজে অধীনতা ও আনুগত্যের ভাব পয়দা করে। দরিদ্র, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের মেয়েদের যে ধর্ষণ করে, সেটা ওই মেয়ের রূপ-যৌবনের মোহে নয়। ওই প্রত্যেকটা ধর্ষিত নারীর শরীর আসলে শক্তিমানের, সংখ্যাগুরুর দাপটের কাছে হেরে ভূত হয়ে যাওয়ার এক-একটা লজ্জা-চিহ্ন। সংখ্যা যত বেশি, জয়ের উত্তেজনাও তত বেশি। ফুটবল মাঠে বিপক্ষকে গুনে গুনে হাফ ডজন, এক ডজন গোল দেওয়ার মতো!

ধর্ষণকারীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেক দিন গবেষণা করছেন ডেভিড লিজাক। মার্কিন এয়ারফোর্স একাডেমিতে পরামর্শদাতা হিসেবে আছেন, ২০০৩-এ বাহিনীর মধ্যে একটা যৌন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকেই। তার কেস-স্টাডি বলছে, যৌন নির্যাতনের ঘটনার পিছনে ক্ষমতা জাহির করার পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার কাজ করে: রাগ। ধর্ষণকারী কোনও ভয়ানক অন্ধ, উৎকট রাগের উত্তেজনায় কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলল, এমন যে হয় না তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই রাগটা আসে অন্য জায়গা থেকে। আমি তোমার শরীর চাইছি আমি মনে করি এটা আমার পাওনা তোমার এত সাহস, তুমি দিচ্ছ না! ব্যস, আমার রাগ হয়ে গেল। সেই রাগেই তুমি যেটা দিলে না, আমি সেটা কেড়ে নিলাম। যেহেতু তুমি আমায় দিলে না, আমায় জোর করে কেড়ে নিতে হল সেই রাগেই কেড়ে নেওয়ার আগে তোমায় আমি পেটাব, কেড়ে নিতে নিতে পেটাব, কেড়ে নেওয়ার পরেও পেটাব, চলন্ত গাড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দেব।

রাগ যে শুধু বাধা পাওয়া থেকেই হবে, এমন নয়। মেয়েরা দেখো সব ভালো ভালো চাকরি নিয়ে নিচ্ছে, আমরা চাকরি-বাকরি পাচ্ছি না এই ধরনের হতাশা থেকেও রাগ হতে পারে। সেই রাগ ধর্ষণ অবধি পৌঁছে যেতেই পারে। আমরা হাজার চেষ্টা করেও গার্লফ্রেন্ড জোটাতে পারি না; অথচ ওই মেয়েটা দেখো পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে আমাদের মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। সিনেমা-পর্নগ্রাফিতে সুন্দরী নায়িকাদের দেখে নিজে কোনো মেয়ের সান্নিধ্য না পেয়েও মাথা গরম হতে পারে। এই গরম মাথাই তখন মেয়েটিকে আওয়াজ-টিটকিরি ও প্রতিবাদী পুরুষ-বন্ধুটিকে ধরে চড়-থাপ্পড় দিতে পারে। তবে পুরুষের রাগের আর একটা কারণ তো 'বিপন্ন পৌরুষ'ও! মেয়েদের শরীর চাইলেই পাওয়া যায়! যে পুরুষের তা-ও জোটে না, তার তো 'মর্দাঙ্গি' নিয়েই সংশয়! সুতরাং, পুরুষত্ব ও পুরুষাঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য তাকে একটা-দুটো ধর্ষণ করে ফেলতেই হয়!

তবে ক্ষমতা, আধিপত্য বিস্তার, রাগ, বিপন্নতা, হঠাৎ যৌন উত্তেজনা কিংবা 'জাস্ট মাস্তি' ধর্ষকের মগজে যে কারণটাই থাকুক, ডেভিড লিজাকের বিশ্বাস, যে লোকটা বা লোকগুলো ধর্ষণ করে, তারা আসলে মেয়েদের ঘৃণা করে। নাৎসিরা যেভাবে ইহুদিদের ঘৃণা করত, সেই একই রকম চিড়বিড়ে, ধ্বংসাত্মক, আগ্রাসী সেই ঘৃণা। এই ঘৃণার জন্ম শৈশবে, পরিবারে, বাবার হাতে মা-র রোজ মার খাওয়ায়, চাচা-ফুফা-মামাদের হুঙ্কারে-দাবড়াদাবড়িতে চাচি-ফুফু-মামিদের নিত্য চুপসে যাওয়ায়, পাড়ার বড়ভাইদের কাছে মেয়েদের যৌন-পুতুল হিসেবে দেখতে শেখায়, স্কুলের ওপর-ক্লাসে বন্ধুরা মিলে সামনের বেঞ্চের চশমা-পরা, বইমুখো, গোবেচারি মেয়েটিকে দিনভর নানা নামে ডেকে ডেকে কাঁদিয়ে ছাড়ায়!

প্রশ্ন হলো, তাহলে এর নিদান কি? হ্যাঁ অবশ্যই দোষীদের কঠিন শাস্তি কার্যকর করা, উপযুক্ত তদন্ত-বিচার, পুলিশসহ বিচারিক কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের সংবেদনশীলতা, তদন্ত-বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। কিন্তু ব্যক্তির চেতনা নির্মাণ বা নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সমান সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের শিক্ষাটা আমরা কোথায় পাব? সম্পদ ও শিক্ষার উৎকট বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা সমাজ যখন ভোগ আর লালসার সাধনায় মাতে, তখন বিকারের এমন মহামারী জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক! সেখান থেকে উদ্ধার পাবার পথ কী? সেই রাজনীতিই বা কোথায়?