ভুটান-নেপালেও চীনা দখলদারিত্ব!

বিপ্লব কুমার পালবিপ্লব কুমার পাল
Published : 25 Sept 2020, 05:08 PM
Updated : 25 Sept 2020, 05:08 PM

প্রতিবেশিদের জমি আগ্রাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। ভূমিদস্যুদের মতো প্রতিবেশিদের জমির দখল নিয়ে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত কমিউনিস্টশাসিত মুসলিম-বিরোধী দেশটি, চারিদিকেই গোলমাল পাকাচ্ছে। করোনা-কালের সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশির ভূখণ্ডে সেনা ঢুকিয়ে গড়ে তুলছে পাকাপাকি দখলদারী। সম্প্রতি নেপাল ও ভুটান সীমান্তে চীনের এমনই হানাদারির খবর প্রকাশ্যে এসেছে। শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। কিন্তু তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই চীনের। পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ সদস্যরা প্রতিবেশীর জমিতে রীতিমতো দাদাগিরি দেখিয়ে চলেছে। স্থানীয় মানুষ বা প্রশাসন ঢুকতে পারছেন না নিজেদের জমিতে। নেপালে তো বর্ডার পিলারই 'হাপিস' হয়ে গেছে।

নেপালের হুমলা জেলার লেপচা-লিমি অঞ্চলে পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়েছে চীনের পিএলএ। রাস্তাঘাট বানানোর পাশাপাশি সেখানে ১২টি পাকা বাড়ি বানিয়েছে তারা। নেপালের সীমান্তে ঢুকে চীনা ফৌজের এধরনের কার্যকলাপ নিয়ে নেপালে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অথচ নেপাল চিরকালই চীনকে নিজেদের বন্ধু ভেবে এসেছিল। আর সেই বন্ধুত্ব বাংলাদেশের মতো হাল-আমলের নয়। বহু আগের। তাই চীনের 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড' প্রকল্পে স্বাক্ষর করতে সময় নেয় প্রতিবেশী দেশটি। কিন্তু তারপরও নেপাল রক্ষা পায়নি চীনা আগ্রাসনের হাত থেকে। হুমলার সহকারী মুখ্য জেলা আধিকারিক দলবাহাদুর হামালেপ এর প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে নতুন করে ৮টি বাড়ি নির্মাণের তথ্য। ৩০ অগাস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি দুর্গম এলাকা পরিদর্শন করেন। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে নেপালের গৃহ ও বিদেশ মন্ত্রককে বিষয়টি জানানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলিও নেপাল সরকারের কাছে চীন অধিকৃত জমি উদ্ধারের দাবিতে সরব। নেপালের সংবাদ মাধ্যম খবরহাব সূত্রে এই তথ্য জানা গিয়েছে।

জেলা প্রশাসনের রিপোর্ট থেকেই পরিষ্কার নেপালের জমিতে চীন সরকার শুধু গৃহ নির্মাণই নয়, গড়ে তুলেছে সড়কও। সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পিএলএ। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে তারা সেখানে যেতে দিচ্ছেনা। এই এলাকাটি চীনের সীমান্ত থেকে নেপালের এক কিলোমিটার ভেতরে। স্থানীয় প্রশাসনের চেয়ারম্যান বিষ্ণুবাহাদুর লামাও ছিলেন জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি দলে। তিনি বলেন, "চীন শুধু বাণিজ্যিক ভবনই নির্মাণ করেনি, আমরা দেখেছি একাধিক চীনা গাড়ি এলাকা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রয়েছেন চীনা সেনারাও। এর থেকেই স্পষ্ট, চীন সড়ক পথও নির্মাণ করেছে আমাদের ভূখণ্ডে।"

উল্লেখ্য, লিমি লেপচা এলাকায় ২০০৯ সালে চীন ৩টি বাড়ি নির্মাণ করে। আরও একটি বাড়ি নির্মিত হয় ২০১৭ সালে। কিন্তু নেপালের তীব্র আপত্তিতে স্থগিত ছিলো চীনা আগ্রাসন। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে নয়া দখলদারি। অপরের জমিতে এক ডজন পাকা বাড়ি নির্মিত হলো কমিউনিস্ট দেশটির ছত্রছায়ায়। জানা চীনারা এসে থাকছেনও ঘরগুলিতে। তবে নেপালিদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছেনা।

এই ভবনগুলির কাছেই রয়েছে ১২ নম্বর বর্ডার পিলার। অথচ ১১ নম্বর বর্ডার পিলার রহস্যজনকভাবে উধাও। স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান পালজর তামাঙের সাফ কথা, নেপালে ঢুকে চীন গায়ের জোরে বানিয়ে তুলেছে ঘরগুলো। গোটা ঘটনায় উদ্বিগ্ন নেপাল সরকার। হুমলার জেলাশাসক চিরঞ্জীবি গিরি জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি নেপালি সেনা, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা ও গ্রাম সংসদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যৌথ প্রতিনিধি দল ফের খতিয়ে দেখবে এলাকার পরিস্থিতি। দেশের গৃহ সচিব মহেশ্বর নিউপেনের নির্দেশেই তৈরি হয়েছে দলটি। ইতিমধ্যেই নেপালের বিরোধী দলগুলো দাবি তুলেছে, চীনা দখলদারি থেকে নিজেদের ভূখণ্ড উদ্ধার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির কাছে এখনই কূটনৈতিক ততপরতা বৃদ্ধির দাবি তুলেছে। গত মাসেই নেপাল সরকার তিব্বতে চীন সড়ক নির্মাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেটা করা হচ্ছে নেপালের জমি দখল করে। নেপাল জাতীয় সংসদের সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে বিরোধিরা মোট ৬৪ হেক্টর জমি চীনের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছে। তাদের অভিযোগ, ডোকলা, হুমলা, সিন্ধুপালচক, গোর্খা ও রসুয়ার বহু জমি দখল করেছে চীন।

হুমলা এই এলাকাটি আসলে খুব সুন্দর। এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় মানস সরোবর। কৌশলগত কারণেও চীনের পছন্দ জায়গাটি। মেষ আর ইয়াক নিরাপদেই চরে বেড়াত এই বনাঞ্তলে। দুর্গমতার কারণে সেইভাবে নেপাল জায়গাটিকে দেখভাল করতে পারতোনা। আর তারই সুযোগ নিয়েছে 'বন্ধু প্রতিবেশী' চীন। বাস্তবেই নেপাল সবসময় চীনকে বন্ধুই ভেবে এসেছে। গত বছরেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে স্বাক্ষর করেছে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পে। কিন্তু সেই বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়েই বন্ধুর জমি দখল করছে চীন। সাহায্য করার নামে পাকিস্তান-সহ একাধিক দেশকে কব্জা করার চীনা কৌশল এখন সকলেই জানা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করলেও এখন চীন এদেশেও আসছে বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে। তাই অনেকেই সতর্ক চীনের এই 'বাংলাদেশ প্রেমে'। শুধু নেপাল বা ভারতের জমি দখল নয়, ভুটানকেও ছাড়ছেনা চীন।

ইদানিং চীন-ভুটান সীমান্তে বেড়ে গিয়েছে পিএলএ-র তৎপরতা। ভুটানের পশ্চিম দিকের ৩১৮ বর্গ কিমি ও মধ্যভাগের ৪৯৫ বর্গ কিমি জমি অনেক আগেই দখল করে রেখেছে তারা। সেখানে দখলদারি পোক্ত করতে সেনা ছাউনিও বানিয়েছে লাল ফৌজ। ভুটান সেনা সূত্রকে উদ্ধৃত করে এমনই খবর ভুটানি মিডিয়ার। নতুন করে পশ্চিম দিকের ৫টি ভুটানি এলাকাও দখল করেছে চীন। জানা গিয়েছে, চুম্বি উপত্যকার প্রায় ৪০ কিমি ভিতরে ঢুকে রাস্তা ও হেলিপ্যাড বানিয়েছে চীন। ভুটানের গণমাধ্যমের খবর, ১৩ ও ১৪ অগাস্ট ডোলং চু পার হয়ে ডোকলামের রাজা-রানি হ্রদের কাছে অবস্থান করছে চীনা সেনা। স্থানীয় পশুপালকদের হঠিয়ে দিয়ে তারা ঝাম্ফেরি গিরিশিরার গিয়েমোচেন পর্যন্ত এলাকা নিজেদের কব্জায় আনতে চাইছে।  এরজন্য ইতিমধ্যে নজরদারি যন্ত্র বসিয়েছে বলেও অভিযোগ। ইতিমধ্যে পূর্ব সেক্টরের সীমান্ত-লাগোয়া সাকতেং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিজেদের বলে দাবি করতে শুরু করেছে চীন। ২৯ জুন আন্তর্জাতিক সংস্থা 'গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফেসিলিটি' (জিইএফ)-এর সাধারণ পরিষদের ভার্চুয়াল সভায় অবশ্য চীনের উদ্দেশ্য সফল হতে দেয়নি ভারত-বাংলাদেশ সহ বেশ কয়েকটি দেশ। সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ভুটান ও চীন ১৯৮৪ সাল থেকে ইতিমধ্যে ২৪ বার বৈঠক করেছে। কিন্তু চীন আগে কখনওই এ অভয়ারণ্যের দাবি তোলেনি। এবার নতুন করে দাবি তোলায় স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের ভুটানের জমি দখলের অভিপ্রায়ও।

আসলে চীন হিমালয় পর্বতে তাঁদের 'ফাইভ ফিঙ্গার' বা 'পাঁচ আঙুল' নীতির কার্যকর করতে চাইছে। এমনটাই মনে করেন তিব্বতের নির্বাসিত রাষ্ট্রপতি লবসাং সাংগে। তার সাফকথা, শি এখন মাও জে দং-এর নীতিকেই কার্যকর করছে। ষাটের দশকে তিব্বত দখলের পর চীনের লক্ষ্যই ছিল হিমালয়ের 'পাঁচটা আঙুল'কে দখল করা। লবসাঙের মতে, এ পাঁচ আঙুল হলো- লাদাখ, নেপাল, ভুটান, সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশ। তিনি বলেন, 'গোটা দুনিয়া ব্যস্ত চীনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলায়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ চীনা সাগরের মতো শি জিনপিং এখন প্রতিবেশীদের জমি দখলে মত্ত। প্রতিটি সীমান্তেই নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি।'