মৌলিক চার নীতি বনাম অষ্টম সংশোধনী

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 31 August 2020, 02:43 PM
Updated : 31 August 2020, 02:43 PM

১.

সেকুলারিজম শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ইহজাগতিকতা বা ইহবাদ। এটি একটি পশ্চিমা মতবাদ। ব্রিটিশ লেখক জর্জ হলিওক ১৮৫১ সালে প্রথম এই ধারণাটি প্রকাশ করেন। ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমালোচনা না করে ধর্ম থেকে পৃথক সামাজিক শৃঙ্খলার কথা বলেছিলেন তিনি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অভিধানে সেকুলারিজম শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে- 'রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় পক্ষপাতহীন নীতি'।

অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষদিকে ফ্রান্সে সংঘটিত বিপ্লব ও রাজনৈতিক পরিবর্তন যা ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত, তা শুধু পশ্চিমা সভ্যতাকেই নয় মানবজাতির ইতিহাসই পাল্টে দিয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিপ্লবের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক আদর্শের সূচনা হয়। শুধু তাই নয়, এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় গির্জার প্রভাব মুক্ত হয়। রোমান ক্যাথলিক চার্চ তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ত্যাগ করে। মূলত এই বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা 'নিরঙ্কুশ রাজনীতি' ও 'অভিজাততন্ত্র' থেকে বেরিয়ে নাগরিকতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রশাসনে তাদের মতামত প্রদানের সুযোগ অর্জন করে। এই বিপ্লব রাজনীতি তথা রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মের প্রভাব ও ব্যবহার ক্ষুণ্ণ করে একেবারে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। সে সময় থেকে ইউরোপের দেশে দেশে কমতে থাকে গির্জার প্রভাব।

আজ ইউরোপ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের যে এতটা সাফল্য অর্জন করেছে তা ফরাসি বিপ্লবেরই অবদান।

ফ্রান্সে যখন এই বিপ্লব শুরু হয় ১৭৮৯ সালে তার ৩২ বছর আগে ১৭৫৭ সালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজদের উপনিবেশের গোড়াপত্তন হয়েছে। ইউরোপের এত বড় বিপ্লবের সামান্য ঢেউ তখনও ভারতবর্ষে লাগেনি। প্রকৃত অর্থে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে লাগেনি। বরং ভারতবর্ষের দেশগুলো অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এখনো আধা-সামন্ততান্ত্রিক এবং ধর্মীয় রাজনীতির অন্ধগলিপথে আলোর পথ হাতড়াচ্ছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করে। ইংরেজরা যখন ভারত দখলে নিচ্ছিল তখনও ভারতে বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ১৯০ বছর উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ শেষে যখন তারা ফিরে যাচ্ছে তখন ভারত হলো দুটো ভাগে বিভক্ত- হিন্দুদের জন্য ভারত বা ইন্ডিয়া আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান।

ফরাসি বিপ্লবের ১৮২ বছর এবং জর্জ হলিওকের মত প্রকাশের ১২০ বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণে ছোট্ট একটি দেশের জন্ম হলো যে দেশটি তার সংবিধানে উৎকীর্ণ করল 'প্রজাতন্ত্রের মালিক হইবে জনগণ' এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করল। এটি ছিল একটি অসাধারণ বিপ্লব। কারণ বিশ্বের খুব কম সংবিধানেই এই ধরনের কথা ও মতাদর্শ সন্নিবেশিত আছে। আর তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা এই কঠিন ও শক্তিশালী নীতি তখন আশেপাশের কোনো দেশেই ছিল না, এমনকি ভারত, যার অকৃত্রিম সহযোগিতায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ করা সহজসাধ্য হয়েছিল এবং দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেই ভারতেও তখন ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ছিল না। বাংলাদেশের চার বছর পর ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রাষ্ট্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধু দ্রুত সংবিধান প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার নির্দেশ ও পরামর্শে দেশের সংবিধানের মৌলিক নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি গ্রহণের পর তা দেশে একশ্রেণির রাজনীতিকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে এমনকি মাওলানা ভাসানী, যিনি নিজেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি পর্যন্ত সরকারের এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এদেশে সব ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী তথাকথিত ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের নাগরিকত্ব বাতিল এবং কারও কারও বিরুদ্ধে কোলাবোরেটর আইনে মামলাও করেছিলেন। এর ফলে সে দলগুলো প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করতে না পারলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে অপপ্রচার শুরু করে। এদের মধ্যে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্তকে ভারতের চাপিয়ে দেওয়া বলে প্রচার করে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে ভারত নিজেই বাংলাদেশের পর ১৯৭৬ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে।

মূলত রাষ্ট্রপরিচালনায় বঙ্গবন্ধু যে মৌলিক চারটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা অন্য দেশ বা পক্ষের চাপিয়ে দেওয়া ছিল না। তা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রজ্ঞারই প্রকাশ। পাকিস্তানের ২৩ বছরের অধিকাংশই কেটেছে দেশে সামরিক শাসন বা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। দেশভাগের পর পর ভারত গণতান্ত্রিক পথ বেছে নিলেও শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে থাকে। শুরু থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন নেতারা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে বেশিদিন দেশ পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি।

দেশকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিচালিত করার বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আকস্মিক নয়। তিনি চিন্তা-চেতনায় পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, "আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন থাকবে ততদিন দুনিয়ায় মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজেদের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্ব শান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।"

একটি সভ্য, মানবিক ও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশ যে অভিযাত্রা শুরু করেছিল তা থামিয়ে দেয়া হয় যাত্রা শুরুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। পঁচাত্তরের এই হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং এই হত্যাকাণ্ড স্রেফ ক্ষমতা বদলের জন্যও নয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো মহোত্তম আদর্শকে হত্যা। একটি সভ্য, মানবিক, আধুনিক ও উদার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হত্যা। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সবাই অন্তত দুটি নীতির কারণে বঙ্গবন্ধুর ওপর রুষ্ট ছিল তার একটি সমাজতন্ত্র এবং অন্যটি ধর্মনিরপেক্ষতা। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী শক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সব সময় অভিন্ন।

১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলায় ফিরে এসে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানেও তিনি দ্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, "আমার রাষ্ট্রে, এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।" দেশভাগের সময় এই উপমহাদেশে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল তা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় তিনি কলকাতার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। পরে পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক আচরণ দেখে তিনি আগে থেকেই নির্ধারণ করেছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

মাত্র তেইশ বছর আগে যে দেশ ভাগ হলো দ্বিজাতি তত্ত্ব তথা হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে সেখানে তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হলো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তথা সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করলেন যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে প্রথমবারের মতো সবাই একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছে এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রক্ত দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকগোষ্ঠী দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাধা দূর করে তাদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে পাকিস্তানি কায়দায় একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করেছে। রাষ্ট্রীয় এইসব উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে থাকে তখন। গত শতকের সাত দশকের মাঝামাঝি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর তেলের দাম বাড়তে থাকে আর সে সঙ্গে আরবের দেশগুলোতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হতে থাকে। সে সময় বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেতে থাকল। এই প্রবাসীরা গিয়ে শুধু পেট্রোডলারই আনল দেশে তা নয়, তারা সঙ্গে করে নিয়ে এলো আরবের সংস্কৃতি। আরবদের মতো বোরকা, লম্বা জুব্বার সঙ্গে যুক্ত হলো হাজার হাজার মাদ্রাসা গড়ে তোলার প্রবণতা। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা আখেরাতের আশায় পরিবারের একটি ছেলেকে অন্তত মাদ্রাসায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা দেশে ফিরে সাধারণ মানুষকে হেদায়েত করত এভাবে- আরবের লোকেরা বজ্জাত হলেও ওরা আযান দেওয়া মাত্রই নামাজ পড়ে। সমস্ত পাপাচার করার পরও ওরা নামাজ ঠিক রাখে। ওদের অনুসরণ করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা বলত, যত খারাপ কাজই করো না কেন নামাজ ঠিক রাখবে। আজকের সমাজ ব্যবস্থা দেখে ভাবি, তাদের এই কথাগুলোকে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। দেশে নামাজিও বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি, দুষ্কর্মও বেড়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানকে এখন 'রাষ্ট্রধর্ম' নামের একটি বোঝা বহন করতে হচ্ছে। যে বোঝাটি তুলে দিয়েছিলেন এরশাদ নামক এক দুশ্চরিত্র সেনাশাসক। তিনি তার পূর্বসূরী মোশতাক-জিয়ার মতো রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করে তুলেছিলেন। অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসা স্বৈরাচার এরশাদের চাপানো বোঝাটি নামাবার ক্ষমতা এখন দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেরও নেই। কারণ সমাজ এখন ৭১/৭২ সালের সেই অবস্থানে নেই। মুক্তিযুদ্ধকালীন চেতনায় এখন নেই। বৃহত্তর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নেই। দীর্ঘ ২৮ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে রাষ্ট্র ও সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ভীষণ জেঁকে বসেছে। 'রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকতে পারে না', 'ধর্ম শুধু মানুষের জন্য' – এসব বোঝার পরও সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম প্রত্যাহারে নিরঙ্কুশ সমর্থন ওরা দেবে না। এটা জেনে বা বুঝে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারও এই ঝুঁকি নিচ্ছে না। অথচ অষ্টম সংশোধনী রাষ্ট্রের মৌলিক চার নীতির পরিপন্থী বা সাংঘর্ষিক বলে টিকতে পারে না। যদিও বাস্তবতা এমন যে, হ্যাঁ/না ভোট বা রেফারেন্স দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামই টিকে যাবে।

সামাজিক অবস্থানও এখন তাই। দেশে এখন যিনি মুসলমান তিনি অতিরিক্ত মুসলমান। যিনি হিন্দু তিনি অতিরিক্ত হিন্দু। যিনি বৌদ্ধ তিনি অতিরিক্ত বৌদ্ধ। এদের ভিড়ে ও চাপে কমে যাচ্ছে মানুষের সংখ্যা। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা বলেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। ঈমান ও আক্বীদাবিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। এরাই আবার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তার স্বার্থে ধর্মনিরপেক্ষতা চায়। এ দেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে কিছু হিন্দু আছেন যারা বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চান অথচ ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনকে সমর্থন করেন। এরা নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনাকে ভারত-বিরোধিতা বলে ধরে নিচ্ছেন। তবে হ্যাঁ বাংলাদেশে যারা নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে সমালোচনা করছেন তারা একই সঙ্গে বাংলাদেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির সমালোচনা করছেন কি না তাও দেখতে হবে।

সমাজে অধিকাংশের মন ও মননে সাম্প্রদায়িকতা এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, তাদের এখন আলাদা করে চিহ্নিত করারও উপায় নেই। কারণ অসাম্প্রদায়িকতা একটি চেতনার প্রকাশ যা আয়ত্ত করতে হয়, চর্চা করতে হয়। সদ্য অর্জিত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করি। সপ্তাহখানেক আগে 'ইস্তানবুল থেকে অযোধ্যা: উম্মাদনার নিচে চাপা পড়েছে মানবতা' শীর্ষক আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এ লেখার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে সহমত পোষণ করেছেন তবে মুসলমানদের একদল আপত্তি করেছে হায়া সোফিয়ার সঙ্গে রামমন্দিরের প্রসঙ্গ আনায়। অন্যদিকে হিন্দুদের একদল আপত্তি করেছেন মোদীকে বেশি গালাগাল করেছি বলে। কেউ কেউ নিক্তি কোনদিকে একটু ভারী হয়েছে তা ধরিয়ে দিতেও ছাড়েননি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে আমরা অনেকে অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছি বটে, প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি বটে নিজে কিন্তু সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের উর্দ্ধে উঠতে পারছি না।

আর এভাবেই আটকে আছে বাহাত্তরের সংবিধান অর্থাৎ মৌলিক চারনীতিতে ফিরে যাওয়া।