রোহিঙ্গা শরণার্থীর তিন বছর ও প্রত্যাবাসন

মো. শফিকুল ইসলাম
Published : 26 August 2020, 11:25 AM
Updated : 26 August 2020, 11:25 AM

২৫ অগাস্ট রোহিঙ্গাদের জন্য কষ্ট ও বেদনার দিন এবং বিশ্বের ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক অধ্যায়। ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে প্রায় ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। অগাস্ট ২০১৮-এর এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে ২৫ অগাস্ট ২০১৭ "নিধন কার্যক্রম" শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা ২৪,০০০ এরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত এবং কমপক্ষে ১৮,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিম নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তারা যে রোহিঙ্গাদের ওপর কত নির্যাতন করছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাদের মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে মিয়ানমার সরকার। সেই জন্য ২০১৮ সালে ২৫ অগাস্টকে 'রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস' হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা এই ঘোষণা দেন। তখন এই সংক্রান্ত কিছু লিফলেট, ফেস্টুন ও ব্যানার নিয়ে প্রচার করছে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন (রোহিঙ্গা মুক্ত কর মোর্চা) নামের একটি সংগঠন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তখন মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের নামে বিভিন্ন চুক্তির কথা বলে যাচ্ছে, বাস্তবে কোনোটা কার্যকর করছে না। বিগত তিন দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের সহিংস অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে ৩,০০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। যা আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত ৭৩তম জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে এখন ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় আমাদের ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শরণার্থীদের পরিসেবা, শিক্ষা, খাদ্য, পরিষ্কার পানি এবং স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশনের অ্যাক্সেসের অভাব আছে; তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশন, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তায় প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। ১ মার্চ ২০১৯ এ বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে যে তারা আর নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। কারণ বাংলাদেশ একটি অধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ।

বর্তমানে করোনাভাইরাস সংকটের এই সময়ে ভয়াবহ আতঙ্কে বসবাস করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কক্সবাজারের উখিয়াতে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে মৌলিক চাহিদা, জীবিকার সুযোগ এবং চিকিৎসা সেবার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশু, গর্ভবতী মহিলা, নতুন মা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিপজ্জনকভাবে জনাকীর্ণ পরিস্থিতিতে সেখানে আটকা রয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারীর সংকটে শরণার্থী শিবিরগুলোতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে সরকার। ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ তেমন হয়নি রোহিঙ্গা শিবিরে।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা অমানবিক। শিবিরগুলোতে পানি, শৌচাগার এবং গ্যাসের সুবিধা অত্যন্ত সীমিত। লোকজনকে খাবারের পানির জন্য কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ তাবুতে বাস করতে হয়। চিকিৎসা ও নার্সিং কর্মীদের অপর্যাপ্ত সংখ্যার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরে পরিষ্কার পানিরও সংকট রয়েছে। অনেক শরণার্থী নিকটবর্তী নদী থেকে পানীয় জল নিয়ে থাকেন। বেসরকারি রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে এই নদী স্নান এবং খোলা মলত্যাগের উৎস। মহামারীর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্বল অবকাঠামো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে অন্তরায়। তাদেরকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় সরকার শরণার্থীদের চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করছে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে অনেক সুপারিশ দিয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কঠোর লকডাউন নীতির মতো গুরুতর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ইত্যাদি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অনেক ভালো কাজ করছে।

এছাড়াও সরকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা ও চিকিৎসাসহ আশ্রয়প্রার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। তবে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই রোহিঙ্গা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে তারা কোনো বেআইনী কর্মে জড়িত না হতে পারে। এছাড়াও কক্সবাজারের নাগরিক সমাজ শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য রোহিঙ্গা শিবিরে ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নিকট অনুরোধ করেছিল। গতকাল সংবাদপত্রে দেখতে পাই সরকার কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ইন্টারনেট সুবিধাসহ মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।

তবে সম্প্রতি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিওর কিছু কর্মচারী সেখানে গেছেন; যা কোভিড-১৯ প্রতিরোধের জন্য ঠিক নয়। সুতরাং করোনাভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে থেকে শরণার্থী শিবিরে যেকোনো চলাচল সীমাবদ্ধ করা উচিত। তবে সুসংবাদও রয়েছে, কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি হ্রাস এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনটি প্রকল্পের অর্থায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ৩৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে।

সার্বিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, সরকারকে রোহিঙ্গাদের ভ্রমণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে মনে করছি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়িত প্রকল্পটি রোহিঙ্গা শিবির অঞ্চলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে, মনো-সামাজিক পরামর্শে এবং টিকাদানে ব্যাপক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে বলে মনে করি। দায়িত্ববোধ, মানবতাবোধ এবং সচেতনতা ধারণ করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে একসাথে কাজ করা উচিত।

সীমান্ত ইস্যুতে ভারত এবং চীনের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলমান। প্রায়ই ভারত ও চীন সীমান্তে উত্তেজনার খবর পাওয়া যাচ্ছে গণমাধ্যমে। উত্তেজনার মধ্যে সেখানে চীন শিবির তৈরি ও অস্ত্র মোতায়েন করেছে বলে ভারত দাবি করছে। পূর্ব লাদাখে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর প্যাংগং ও গালোয়ান উপত্যকায় সেনাসদস্য বৃদ্ধি করছে দুই দেশই। চীন বাংকার তৈরি করেছে। অস্থায়ী পরিকাঠামোও তৈরি করেছে। সেখানে তারা দুই থেকে আড়াই হাজার সেনা বাড়িয়েছে। ভারতও একই কাজ করছে। এ নিয়ে ভারত ও চীন সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারত বলেছে, সীমান্তের ভেতরই ভারতের সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সীমান্ত পরিচালনায় ভারত বরাবরই অত্যন্ত দায়িত্বশীল। তবে ভারত তার সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষার জন্য দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ নিয়ে দুই দেশ ব্যস্ত রয়েছে।

হংকংয়ের জন্য নতুন যে নিরাপত্তা আইন চীন বাস্তবায়ন করছে, সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহ, বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, এ আইন হংকংয়ে রাজনৈতিক স্বাধীন মতামত প্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে এই ইস্যুতে চীন বিশ্ব রাজনীতিতে চাপে আছে। এছাড়াও ভারত রয়েছে নানামুখী বিপদে। পাকিস্তান ও চীন কিন্তু ভারতের পুরানো শত্রু। ভারতের মাথাব্যথার জন্য এই দু'টি উপসর্গই যথেষ্ট। এর মধ্যেই সম্প্রতি মানচিত্র নিয়ে ঝামেলা শুরু করছে আরেক প্রতিবেশী নেপাল। মিত্র দেশ ভুটান উজানে অভিন্ন নদী থেকে তাদের সেচের পানিও আটকে দিয়েছে। ফলে আঞ্চলিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে ভারত। অনেকেই মনে করছে নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে ভারতের এই ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে আসলে ভারতের দায় বেশি। সব কিছু মিলে ভারত অস্বস্তিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আঞ্চলিক 'ছোট দেশ'গুলোর প্রতি বন্ধুত্বের পরিবর্তে কর্তৃত্বের মনোভাব পোষণ করাই সম্ভবত ভারতের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে আজকের এই অবস্থা।

মিয়ানমার সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করেনি। মিয়ানমারের ক্ষমতার উৎস হল চীন। বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখা চীনও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তেমন কিছু করতে পারেনি। গত তিন বছরে কয়েকবার চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। কিন্তু একজন রোহিঙ্গাও এখনো প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ফিরে যায়নি। কিন্তু মিয়ানমারের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখা চীনের কৌশলী ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কোনো ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি ভারতও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে। তারা বাংলাদেশের জন্য এই ইস্যুতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি।

বর্তমানে চীন ও ভারত উভয় যেহেতু ঝামেলায় রয়েছে এবং ভূরাজনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে বেশি করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে এবং চীনকে বুঝাতে হবে আমরা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্কে বন্ধু হিসেবে থাকতে চাই। অন্যদিকে ভারত তো আমাদের পরিক্ষিত বন্ধু এবং ভারত সরকারকে বুঝাতে হবে আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে তাদের পূর্ণ সমর্থন চাচ্ছি। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সম্পূর্ণ নজর এবং গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান কার্যক্রম চালানো উচিত। এটাই সবচেয়ে উত্তম সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কারণ চীন ও ভারত দুই দেশ এখন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে।