বামপন্থায় স্বর্ণলতা ব্যামোর সুলুক সন্ধান

শিহাব চৌধুরী বিপ্লব
Published : 23 August 2020, 07:40 AM
Updated : 23 August 2020, 07:40 AM

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে "ভদ্রলোক" নামের পরজীবী গোষ্ঠী। যারা ছিলেন স্পষ্টতঃ ব্রিটিশ শাসনের সরাসরি "বেনিফিসিয়ারি"। "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" প্রথা এদের জমি দিয়েছিল। কিন্তু, এরা জমির সাথে ততটুকুই সম্পর্কিত ছিলেন, যতটুকু ঐ জমি বর্গা দিয়ে মুফতে সে জমির ফসল পাওয়া যায় অবধি। এদের অনুগ্রহভাজন এবং উত্তরপুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি কলমজীবী কেরানীকুল। যারা বরাবরই ছিল ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে অনুরক্ত। অনেকটাই নুন খাওয়ার নীতি। তবে দশকের পর দশক ছাড়িয়ে, শতাব্দী পেরিয়ে এদের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই গড়ে ওঠে একদল চিন্তাদাস। যারা মনেই করত, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ফলশ্রুতিতে এসেছে এক নতুন সভ্যতা, আধুনিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান। এই চিন্তা সর্বাংশে ভুলও নয়। "ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল" প্রবন্ধে মার্কস তার অনন্য সাধারণ উজ্জ্বলতায় তা তুলেও ধরেছেন। একই সাথে তার দৃষ্টি এড়ায়নি, তৎকালীন ভারতীয় উপনিবেশ থেকে কী বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পাচার হয়েছে। কী ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দিয়ে ইতিহাস এর জঘন্য লুণ্ঠন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু, শিক্ষা অর্জন করেও পরজীবী গোষ্ঠী ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের লুটেরা চরিত্র উন্মোচন করেননি বা করতে পারেননি। শতাব্দী চলে গেছে তাদের বিনম্র আবেদন-নিবেদন আর অনুকম্পা লাভের জন্য পত্র রচনায়। রাজা-মহারাজা-নবাব-কেরানী-ভৃত্যকুল নিজেরা প্রসাদ পেয়ে পরিতৃপ্ত বোধ করেছেন। উপমহাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের জন্য তা স্বাভাবিক ও ন্যায্য বলে ভৃত্যকুলের মনে হয়েছে। শতাব্দী জুড়ে তাদের চিন্তার জগতকে ঢেকে দিয়েছিল দাসোচিত জীবন ও মানসিকতাকে ন্যায্য ও সঙ্গত মনে করার মধ্যে। তাদের রচিত লেখা ও জীবনযাপনে তা ফুটে উঠেছে নানাভাবে।

গোপন রাজনীতি ও সংগঠন পরিচালনার একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে গোপনীয়তা। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন নিজের পরিচয় লুকোনো। আত্মপরিচয় লুকিয়ে ধারণ করতে হয় ছদ্মনাম। বছরের পর বছর ধরে এই লুকোচুরি জীবনযাপন করতে হয়। অনবরত বলতে হয় মিথ্যা। ধারাবাহিক মিথ্যা বলতে বলতে কখন যে একজন মানুষ "প্যাথলজিক্যাল লায়ারে" পরিণত হয়, সে নিজেই জানে না। সত্তরের দশকে মাওবাদী সশস্ত্র সংগ্রামীদের ক্রমাগত দল ভাঙ্গা-পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস এমনকি নিজেদের মধ্যে হানাহানির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা আজিজুল হক এরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মিথ্যার সাথে অবিরাম বসবাস করে, মিথ্যাবাদী হয়ে ওঠে মানুষ।

অবিশ্বাস আর উত্তেজনার মধ্যে থেকে, অবিশ্বাসী আর সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে মানুষ। এক আদর্শের জন্য জীবন প্রাণ উৎসর্গকৃত মানুষের জীবন পরস্পরের কাছে হয়ে ওঠে অচেনা। জীবনের জন্য মিথ্যা কী করে জীবনকেই মিথ্যে করে দেয়? কী ট্রাজেডি!

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার আন্দোলনে দারুণ পুষ্টি যুগিয়েছে উদ্বাস্তুদের লড়াই। ৬০-এর দশকে খাদ্য আন্দোলনে, ট্রাম-বাসের ভাড়া বৃদ্ধিসহ কলকাতার আরবান মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের লড়াইয়ে বামপন্থার পুষ্ঠি যুগিয়েছে উদ্বাস্তুদের অংশগ্রহণ। বামপন্থীরা উদ্বাস্তুদের সহায়তা দিতে গিয়ে সে আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়েছেন। ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা নেতারা বামপন্থীদের নেতা হয়ে উঠেছেন। কলকাতা মহানগরীর এক্সপানশন করে দমদম ও যাদবপুর অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্তি, বারে বারে বামপন্থীদের কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করেছে। কারণ, এই দু অঞ্চল ছিল উদ্বাস্তু অধ্যুষিত। সুতরাং, একটি দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ে কারো ওপর আশ্রয় করে কিংবা কোনো শক্তিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতে তার পরিবর্তন শুধু হয় না, যাদের ওপর ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়, তারাও রেখে যান দীর্ঘমেয়াদী ও অমোচনীয় দাগ। ফলে উদ্বাস্তু আন্দোলন যেমন পুষ্ট হয়েছে বামপন্থার হাত ধরে, তেমনি উদ্বাস্তু আন্দোলন রেখে গেছে বামপন্থার আন্দোলনে গভীর দাগ।

ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে নেমেছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। দেবী প্রতিমার সামনে রক্ত দিয়ে শপথ নিতেন সেই বিপ্লবীরা। "যুগান্তর" ও "অনুশীলন" নামে কার্যরত এই দলগুলোর অনুসারী বিপ্লবীরা অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দেশপ্রেমের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে জন্মভূমি থেকে বিদেশী দখলদারদের বিতাড়িত করার মরণপণ সংগ্রামে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দেশমাতৃকা আর দেবী মাতা অভিন্ন হয়ে উঠেছিল তাদের মানসজগতে। দেশের প্রতি অঙ্গীকারের সাথে ভক্তিবাদের অপূর্ব সংশ্লেষ ঘটে এতে। এই সকল সশস্ত্র সংগ্রামীদের অনেকেই পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারের সাথে তারা ভারতীয় ভক্তিবাদও নিয়ে এসেছিলেন। ফলে বামপন্থীদের মধ্যে মার্কসবাদী চিন্তা প্রসারিত হয়েছে ভক্তিবাদ চর্চার মতো করে। আদর্শের প্রতি নিবেদিত নীতিনিষ্ঠ একদল কর্মীর হাতেই বামপন্থার রাজনীতি প্রথম যুগে প্রসারিত হয়েছে। বামপন্থা যেমন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের টেনেছে, তেমনি সেই সকল বিপ্লবীদের ভক্তিবাদও বামপন্থার রাজনীতিতে আত্মীকৃত হয়েছে।

পঞ্চাশের দশকে সিপিআই নেতা বি টি রণদীভের থিসিসের ওপর ভিত্তি করে কমিউনিস্টরা শ্লোগান তোলে "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়"। পাকিস্তানি রাষ্ট্র শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার ফলশ্রুতিতে নেমে আসে প্রচণ্ড দমন পীড়ন। এই নীতি পরিত্যক্ত হবার পরেও, তখনকার সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে বামপন্থীদের ওপর নেমে আসা নিপীড়নের অবসান ঘটেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব অবধি। পাকিস্তানি জমানায় প্রায় আড়াই দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ দলের ভেতরে লুকিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম করেছে বামপন্থীদের বড় অংশ। বিভিন্ন গণসংগঠনের গতিমুখ পরিচালনার ক্ষেত্রেও এই নীতি সর্বাগ্রে প্রাধান্যে ছিল যে, অপরাপর বড় গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিকে সাথে নিয়ে শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলতে হবে। ফলে জাতীয় কর্তব্য, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কর্তব্য, জাতীয়তাবাদী চেতনার ঐক্য গড়ে তোলা যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, ঠিক ততটা অবহেলিত থেকে গেছে শ্রেণি প্রশ্ন। মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম যতটা কেতাবে ছিল, কার্যতঃ তা প্রাধান্য পায়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পরেও এই প্রক্রিয়া ছিল অব্যাহত। ফলে বামপন্থীরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে শ্রেণি মুক্তি, শোষণ বঞ্চনা মুক্তির প্রশ্নে ততটা দাগ কাটতে পারেননি। জাতীয় কর্তব্য সম্পাদনে সাফল্য, আত্মদানের গৌরবগাথা সত্ত্বেও তার নিজস্ব শ্রেণির মধ্যে তার পৌঁছে যাবার কাজটি যেমন অধরা থেকে গেছে, তেমনি মেহনতিদের মধ্যে তার শক্তিশালী অবস্থান গড়ার লক্ষ্য স্বপ্নই থেকে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বামপন্থীদের বৃহত অংশ কার্যতঃ নিজেরাই হয়ে গেছেন জাতীয়তাবাদী কর্তব্য ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কর্তব্য সম্পাদনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাতে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তির জায়গাটি হল, সে স্বভূমিচ্যুত হয়েছে। জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন এই শক্তিকে আরো হতভম্ব ও স্বকর্তব্য থেকে বিচ্যুত করে। যাদের ওপর এত বছর আছর হয়ে ছিল, তাদের চিন্তার আত্মীকরণের ঘটনা ঘটে গেছে অলক্ষ্যে।

স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অপরিসীম ভক্তিবাদী চিন্তাশ্রিত রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধুকে দল ও শ্রেণির ঊর্ধ্বে একটি সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছে বামপন্থীদের সবচেয়ে প্রাচীন দলটি। আবার তাদের পরবর্তী কংগ্রেসে এ জাতীয় মূল্যায়ন ভুল বলেও সিদ্ধান্ত টেনেছে। কিন্তু, ব্যক্তিকে তার কাজ-অবস্থান-ফলাফল থেকে বিযুক্ত করে ভাবার প্রবণতা বাদ দিতে পারেননি অনেকেই। '৭৫ পূর্ব ও '৭৫ পরবর্তী এই মোটা দাগে রাজনৈতিক সমীকরণের চেষ্টা ছিল তাদের বরাবরই। অথচ '৭২-'৭৫ কালপর্বে লুটেরারা দলও বোল পাল্টাতে খুব একটা দেরি করেনি। '৭৫ উত্তর রাজনৈতিক প্লাটফর্মে রাষ্ট্রের নীতি ও অর্থনীতির প্রশ্নে শাসক দলের চেহারা পাল্টালেও অভিন্ন নীতি অনুসৃত হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষুদে বুর্জোয়াদের যে অংশের মধ্যে ছিল দেশপ্রেম, তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে লুটপাটের সর্বগ্রাসী ধারায়, দেশপ্রেম বর্জিত গণস্বার্থবিরোধী চুক্তি প্রক্রিয়ার সাথেও এই ধারা যুক্ত। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেও নারাজ যখন এই নব্য লুটেরারা, তখন বামপন্থী রাজনীতির নিবেদিত শক্তির মধ্যে অগণতান্ত্রিক লুটপাটের শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে, নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে ভক্তিবাদের ঐতিহাসিক প্রভাব এখনো স্পষ্ট এবং তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা, পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান, সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলা ইত্যাদি আওয়াজ তুলে বিপরীতের সংগ্রাম ও ঐক্যের নামে বিপরীতে আত্মীকৃত হয় এই বামপন্থা। লুটেরা দুর্বৃত্তদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তাদের লক্ষ্য কিভাবে অর্জিত হবে, এই প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে তারা ফিরে যেতে চান ঐতিহাসিক পরম্পরার মধ্যে। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সমর্পিত জীবনে, আদর্শের আড়ালে। যা জীবন ঘনিষ্ঠ নয়, মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের জন্য কাম্যও নয়। কার্যতঃ তা লুটেরা পুঁজিবাদ এর আয়ুষ্কালকে দীর্ঘায়িত করার আদর্শিক রসদ যোগায়।