কেলেঙ্কারির পর কেলেঙ্কারি, ডুবুডুবু ভাবমূর্তি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 July 2020, 09:54 AM
Updated : 25 July 2020, 09:54 AM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নকল মাস্ক সরবরাহের মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী শারমিন জাহানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান জানিয়েছেন। শাহবাগের কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এ বিষয়ে এখন কিছু বলব না। তাকে (শারমিন) ইতোমধ্যে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়েছে।"

সকালে মিডিয়া খুলেই এই খবরটি দেখলাম। আমরা ভেবেছিলাম করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে মানুষ অন্তত সৎ আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করবে বা জীবন যাপন করবে। বাংলাদেশে তা বোধকরি কোনো কালে সম্ভব হবে না। দুর্নীতি সব দেশে সব সমাজেই আছে। কোথাও বেশি কোথাও কম। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ তা সর্বগ্রাসী। এখন যেটা দেখছি সবকিছুই হচ্ছে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে। নাম ভাঙিয়ে কথাটাও বিতর্কিত। বলা উচিৎ সরকারি দল আওয়ামী লীগের নামেই চলছে অনাচার। আমি দূরদেশ থেকে যা দেখছি তাতে স্পষ্ট এই সময়কাল আর বঙ্গবন্ধুর সময়কালে তেমন কোনো ফারাক নাই। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সরলতা আর ঔদার্যের সুযোগ নিয়ে চোর ডাকাতের দল এতটাই বাড়াবাড়ি করেছিল যে বঙ্গবন্ধু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার কপালে জুটেছে চোরের খনি। বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, সব মানুষের জন্য রিলিফের কম্বল আসলেও তিনি তার কম্বল পাননি। সে সময় এই কম্বল চোরদের নিয়ে গান প্যারোডিও রচিত হতো।

বুঝলাম তখনো প্রশাসন গুছিয়ে ওঠার সময় পাননি। অনভিজ্ঞ আমলাতন্ত্র হয়তো প্রস্তুত ছিল না। ছিল না বাঙালির দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু এত বছর পর কয়েকবার লাগাতার দেশ শাসনে থাকার পরও আজ এই হাল কেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা আর দূরদর্শী চিন্তা দেশকে এগিয়ে নিলেও দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা এদের কারণে আজ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আসলে কোন জায়গায় এসে ঠেকছে তার হিসেব কি নেতারা রাখেন? ঢাকায় কথা বললেই শুনি প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত নাকি একা হয়ে পড়ছেন। এটা অবিশ্বাস করার কারণ দেখি না। যে সমাজে যে রাজনীতিতে দলের সবাই চোর-ডাকাত বা দুর্নীতিপরায়ণ সেখানে ভালো মানুষ একা হবেন এটাই স্বাভাবিক।

আমরা যদি বাস্তবতার দিকে তাকাই আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিমুখ মুখপাত্র নির্ভর দলে পরিণত হতে চলেছে। দলের সাধারণ সম্পাদককে দেখি রোজ টিভি ক্যামেরার সামনে আসেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সবাই যখন গৃহবন্দী তখন বাড়িতে বসে বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হররোজ নতুন নতুন মুজিবকোট আর একই কথা শুনতে কি মানুষের ভালো লাগে? আজ যখন এ লেখা লিখছি তখনো তিনি স্বভাবসুলভ বিএনপির বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। বিএনপি আতঙ্ক আর গেল না তাদের। অবশ্য দেশে কথা বললেই বুঝি এই অদৃশ্য দলটি নির্বাচন করার সুযোগ ও নিশ্চয়তা পেলে কি ঘটাতে পারে। মানুষের মনে মনে যে রাগ, ক্রোধ আর জ্বালা সেটা সরকারি দলের নেতারা বুঝতে পারছেন না। এটা আমরা বহুদেশে বহুকালে দেখেছি। অধিক সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দল বাস্তবতা ভুলে যায়। পাশের বঙ্গে ত্রিশ বছরের অধিক সময় রাজ্য শাসনে থাকা সিপিএম আজ বিলুপ্ত প্রায়। কমিউনিস্ট পার্টির নাম নিশানা মুছে গেছে সেখানে। জ্যোতি বসুর শাসনকাল পর্যন্ত বাঘে-মোষে একঘাটে পানি খেত। তারপর এলেন বুদ্ধদেব বাবু। বুদ্ধদেব বাবুর মতো সহজ সৎ মানুষ বিরল। কিন্তু তাতে কী কিছু ঠেকে আছে না ঠেকে ছিল? তার সব গুণ বরবাদ করে দিয়েছে ক্যাডার আর চাঁদাবাজ দাদারা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বাংলাদেশে।

এটা কে না জানে সরকারি দলের ছায়া না থাকলে এই ডাকাতদের জন্ম হতো না। সাহেদ কেলেঙ্কারির পর স্বাস্থ্য বিভাগের যে ছবি যে চেহারা বের হয়ে আসল তাতে কি ভাবমূর্তি বেড়েছে? এই সাহেদ কে এখন তারা কেউই চেনে না। আন্তর্জাতিক আওয়ামী লীগ শাখা থাকার দরকার কী আসলে? দলের কেউ একজন এই বিষয়টা বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে পালন করলেই তো হতো। না, তা হবে না। কমিটি থাকতে হবে। আর এই কমিটি বিদেশে একটা আওয়ামী লীগের শাখা হলে দুইটা ফ্রি পাবার নিশ্চয়তা বিধান করবে। বিদেশের সব শহরে আওয়ামী লীগের শাখাসমূহের মধ্যে কোন্দল আর পারস্পরিক ঝগড়া। হবে না কেন? দলের মূল আন্তর্জাতিক কমিটিতে যদি সাহেদের মতো লেখাপড়া না জানা একটা বাটপার থাকতে পারে তো সব সম্ভব। আজ সাহেদকে কেউ চেনে না। মন্ত্রী চুক্তি সম্পাদনের সময় হাজির থাকলেও বলতে পারেন, তিনি কিছুই জানতেন না। এ এক আশ্চর্য সময় বটে। আর তারপরও মন্ত্রীর কিছুই হলো না। বিএনপির রিজভি সাহেবকে দেখলে আমার হাসি পায়। কেমন জানি একটা চেহারা করে রাখেন। কিন্তু এই যে তিনি বললেন স্বাস্থ্য সচিবের মতো দুয়েকজনকে সরানোর আইওয়াশে পরিস্থিতি ঠিক হবে না, কথাটা কি মিথ্যা? বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বলে একটা কথা চালু আছে। সরকারি দলের বড় নেতারা এখন নিষ্ক্রিয়। তারা আতংকে আছেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়েও চলে গেছেন। নানা অজুহাতে তাদের দেশত্যাগ মানুষের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক।

শুরুতে যে প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, এবার তোপের মুখে সাবেক ছাত্রলীগের নেতা। গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া এই নারী চীনে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। দেখলাম শেষ না করে ছুটিতে থেকে ব্যবসা করতে গিয়ে এই মাস্ক কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেছেন। এবার বুঝুন অবস্থা! পড়ালেখাও শেষ করেননি, এখনই কোটিপতি হবার খায়েশ। এই উগ্র খায়েশ দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে বড়লোক হবার উদগ্র বাসনা। বলাবাহুল্য যার সেইফ হেভেন বা দূর্গ হচ্ছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ। কারণ এসব নামের আড়ালে নিরাপদ থাকা যায়। বাস্তবতা এমনই, পুলিশও তাদের কিছু করে না, করতে পারে না। ক'দিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি তুঙ্গে ওঠে। পরিস্থিতি এতই খারাপ যে করোনাকালেও খুন-খারাবি হবার মতো অবস্থা। সেখানে পুলিশ যেতে বাধ্য হয়েছিল। খবরে পড়লাম বেচার পুলিশ বলছে, তেমন কিছু না সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। খুব সহজেই বোঝা যায় কলকাঠি কোথায় হলে পুলিশ এমন কথা বলতে বাধ্য হয়।

চারদিকে এক ঘোর অন্ধকার। আওয়ামী লীগের আমলে শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি মানুষকে মুগ্ধ করলেও আজ তা দলের বেশকিছু নেতাকর্মীর জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সহসা যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কঠিন না হন তো পরিবেশ আরো মন্দ ও খারাপ হয়ে পড়বে। যেখানে আসলেই কোনো গণতন্ত্রের চর্চা নেই বা বহুদলের নাম থাকলেও কাজে নেই সেখানে তিনি বরং তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে দেশ ও সমাজকে ভালো রাখুন সেটাই মানুষের চাওয়া। এতে আওয়ামী লীগের ভেতর ঢুকে পড়া বা দলে গজিয়ে ওঠা দানবের দল পরাস্ত হবে।

তা না হলে এমন ঘটনা আরো আসবে, আরো বের হবে। আর একসময় তা হয়ে উঠবে বেসামাল। মানুষ সব খেয়াল করে আর মনে রাখে। এটাই মানুষের স্বভাব।