দক্ষিণ এশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করতে মমতা-মোদীর প্রচেষ্টা

গৌতম রায়
Published : 22 July 2020, 04:25 PM
Updated : 22 July 2020, 04:25 PM

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ভিতর পারষ্পারিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারত ১৯৪৭ সালের পর থেকে বরাবরই একটি বড় ভূমিকা নিয়ে এসেছে। পণ্ডিত নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি ভারতীয় উপমহাদেশকে একটা বিশিষ্ট স্থানে নিয়েছিল। এর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ভেতরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধুত্বের দৃঢ়তার প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা একটা বড় রকমের সদর্থক দিকও উন্মোচিত করেছিল।

সে ইতিবাচক দিকগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভারতকে একটা বিশেষ রকমের গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নেহেরুর জোট নিরপেক্ষ নীতির ক্ষেত্রে তার তিব্বত সংক্রান্ত অবস্থান ঘিরে কিছু বিতর্ক ছিল। চীনের আভ্যন্তরীণ বিষয় 'তিব্বত'- এ প্রশ্নে ভারতের অতি উৎসাহী মানসিকতার উদাহরণ টেনে, ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় 'কাশ্মীর' ঘিরে ভারতকে কূটনৈতিক চাপে ফেলতে অনেক দেশ চেষ্টা করেছে। তা সত্ত্বেও নেহরুর বিদেশনীতির প্রশ্নে ভারতের অভ্যন্তরেও একটা সহমত ছিল। নেহেরুর সরকারের কঠোর সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থিরা প্রকাশ্যেই নেহেরুর জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতির সমর্থক ছিলেন। আরএসএস এ সে সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন, চরম দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনসঙ্ঘ, সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সখ্যতাকে ভালো চোখে দেখতো না। তবুও তারা প্রকাশ্যে ভারতের বিদেশ নীতির কঠোর সমালোচক ছিল না।

জনসঙ্ঘ জনতা পার্টিতে মিশে যাওয়ার পর সেই দলের নেতা মোরারজি দেশাই এর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। স্বল্পস্থায়ী সেই সরকারে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে একটা মার্কিনমুখী ঝোঁক আনার চেষ্টা করেছিলেন বাজপেয়ী। তবে তিনি সফল হননি। প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আরএসএস এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ দেশাই মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ী বিশেষ একটা করে উঠতে পারেন নি।

পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর আমলে ভারতের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে পণ্ডিত নেহেরুর আমলের ধারাবাহিকতা মোটের উপরে বজায় থাকে। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, ইত্যাদি পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুইদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে চাপানউতোর দেখা গেলেও, সাংস্কৃতিক পর্যায়ে একটা পারষ্পারিক সম্পর্কের আদানপ্রদান ছিল। ফলে এই সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য, রাজনৈতিক সম্পর্ককে একদম বিষিয়ে যেতে দেয়নি। সম্পর্কটা অম্লমধুরই ছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার জলের উপর একতরফা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কাতে বাঁধ তৈরি করে। এ ঘটনাটি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষের প্রাথমিক উপাদান তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আত্মবলিদানের অব্যবহিত পরে হানাদার পাকবাহিনীর সমর্থক জিয়াউর রহমানের প্রশ্রয়ে মাওলানা ভাসানী একটি ফারাক্কা লংমার্চ করেন। এই ঘটনা বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষকে সম্বল করে মুসলিম মৌলবাদীদের নিজেদের সংহত করতে দারুণভাবে সাহায্য করেছিল।

জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর যত প্রগাঢ় শ্রদ্ধাই থাকুক না কেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি যতখানি আন্তরিকতা নিয়েই তিনি চলুন না কেন, আন্তর্জাতিক নদী ফারাক্কার উপর বাঁধ তৈরি করে রক্তস্নাত বাংলাদেশে তিনি বেশ কিছুটা ক্ষোভের সঞ্চার করেছিলেন। যেটি ১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মানসিকতা শক্তিশালী হওয়ার পিছনে অন্যতম দায়ী। আর এ পরিস্থিতির সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিল পাকিস্তান।

এইচ ডি দেবগৌড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়কালে বামপন্থিরা দেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আগের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির একটা মোড় ঘোরে। তার জেরে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সদর্থক ভূমিকাতেই গঙ্গার জল নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি কুড়ি বছরের চুক্তি হয়। দক্ষিণ এশিয়াতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিমণ্ডল শক্তিশালী করতে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জ্যোতি বসু সেদিন যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন , তা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল।

পণ্ডিত নেহেরুর জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতির সুশৃঙ্খল অনুসরণ পরবর্তীতে কংগ্রেস বা মোরারজি দেশাইয়ের জনতা দলের সরকার সুশৃঙ্খলভাবে অনুসরণ না করলেও মূল সুরটি কখনো সেভাবে কাটেনি। যদিও নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন উদার অর্থনীতির ঝোঁকে ভারতের বিদেশ নীতিতে একটা মার্কিনমুখী ঝোঁক এসেছিল। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তখন অনেকটা কমজোর। সোভিয়েত ইউনিয়নের সদ্য পতন ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতেও বিপর্যয় ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখলের নামে যে নয়া উদ্যোগের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সেটির প্রতি ভারত সরকারও খুব বেশি রকমের অনুরক্ত হয়ে পড়ে।

তিন দফায় মোট সাড়ে ছয় বছর ক্ষমতায় থাকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। এ সময়ে ভারতের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গে খানিকটা পায়ে পা বাঁধিয়ে সমস্যা তৈরির একটা প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। 

অটলবিহারী পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান পারভেজ মোশাররফের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। তিনি আগ্রাতে আসেন। ওয়াঘা দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। অনেকেরই ধারণা হয়, দীর্ঘকালের টানাপড়েনের সম্পর্ক একটা সুস্থ অবস্থানে আসবে।

আবার এ অবস্থাতেই ভারত একতরফাভাবে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় পোখরানে। প্রায় সাথে সাথেই পাকিস্তান জবাব দেয়। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠতে থাকে। বাজপেয়ী তার সরকারের নড়বড়ে অবস্থানকে শক্ত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ককে ব্যবহার করেন পুরোমাত্রায়। উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের অনমনীয় মানসিকতা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতায় কার্গিল সীমান্ত শুরু হয় রক্তক্ষয়ী লড়াই।

বাজপেয়ীর তেরমাসের সরকার তখন সংসদে আস্থা ভোটে হেরে গেছে। অন্তর্বর্তী লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। এ অবস্থায় কার্গিল সমস্যাকে ঘিরে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে একটা চরম পর্যায়ে নামিয়ে আনেন বাজপেয়ী, আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। এই কার্গিল সংঘর্ষ ঘিরে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে বেশ কিছু চাপানউতোর চলে। কার্গিলে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বাজপেয়ী সরকার সব জেনেও বিষয়টি নিয়ে চুপ করে ছিল। বাজপেয়ীর সরকার সংসদে আস্থাভোটে পরাজিত হওয়ার পর মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিততে কেয়ারটেকার সরকার হিসেবে কার্গিলের বিষয়টিকে ঘিরে দেশপ্রেমের নামে একটা ভয়ঙ্কর উগ্রতার আমদানি করেছিল আরএসএস-বিজেপি।

বাজপেয়ী জামানাতে গুজরাটের ভূমিকম্পের পর ত্রাণ পাঠিয়েছিল পাকিস্তান। ২০০১ সালে গুজরাট ভূমিকম্পের পর পাকিস্তান বিশেষ বিমানে করে গুজরাটে ২০০ তাঁবু, ২০০০ কম্বলসহ বেশ কিছু ত্রাণসামগ্রী পাঠায়। কার্গিল ঘিরে পাকিস্তানের সঙ্গে চূড়ান্ত সম্পর্কের অবনতি সত্ত্বেও ড. মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কযুক্ত বিদেশনীতিতে ফেরার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ দেন বামপন্থিরা। মূলত বামপন্থী সাংসদের চাপেই প্রথম ইউপিএ সরকার পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ২০০৫ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ত্রাণ পাঠায়।

যে পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ঘিরে পাকিস্থান আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে হেনস্থার নানা চেষ্টা করে, সেই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো সঙ্কীর্ণ আচরণ না করে, ভারতের ২৫ টন সামগ্রী, কম্বল, ওষুধসহ ভারতীয় ত্রাণ পাঠানো আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে ভারতের বিদেশনীতিতে যে ইতিবাচক অবস্থান দেখা দেয় তা উচ্চ প্রশংসিত হয়। বামপন্থিরা মানুষের বিপদে কোনো সঙ্কীর্ণতা না দেখাবার যে পরামর্শ তৎকালীন কেন্দ্রিয় সরকারকে দেয়, তাও আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে প্রবল প্রশংসিত হয়।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের ঔদার্যের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয় না পাকিস্তান। তাঁরা ত্রাণসামগ্রী ফেরত পাঠায়। পাকিস্তানের এ আচরণ আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকাকে যেমন তুলে ধরে, তেমনই নিন্দিত করে পাকিস্থানের সঙ্কীর্ণ মানসিকতাকে। আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা পাকিস্তানকে ভূমিকম্পজনিত পরিস্থিতিতে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার কথা উঠে আসে। ভারত ২০০৫ সালের ১৪ অক্টোবর ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে আবারও ত্রাণ পাঠায়। ৫ হাজার কম্বল, ৩৭০ টি তাঁবু, ৫ টন প্লাস্টিক শিট, ১২ টন ওষুধের সেই ত্রাণ পাকিস্তান সসম্মানে গ্রহণ করে। দ্বিতীয়বার এ ত্রাণ পাঠানোর কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণে প্রথম দফার মনমোহন সিং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থিদের একটি সদর্থক ভূমিকা ছিল।

প্রথম দফার ইউপিএ সরকারের আমলে প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে যে দৃঢ়তা দেখানো সম্ভব হয়েছিল, দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকার তা দেখাতে পারেনি। গঙ্গার জলের মতোই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার জল ঘিরেও। ড. মনমোহন সিং আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার জলের ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দেওয়ার পক্ষে অনেকখানি সদর্থক ভূমিকা নেওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চূড়ান্ত বাংলাদেশ বিরোধী এবং বাঙালি শ্যভিনিজমের বশবর্তী আচরণের জন্যে এই কাজে সফল হন না।

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেই ভারতের প্রবাহমান বিদেশ নীতির খোলনলচে বদলে দিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ভারতকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের আবরণে একটি 'দাস' রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসেই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। সেই লক্ষ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশকে অতিক্রম করে দক্ষিণ এশিয়াতেই ভারতকে একটা আধিপত্য বিস্তারকারী রাষ্ট্র হিসেবে মেলে ধরতে সচেষ্ট হন। এ দৃষ্টিতেই চীন, পাকিস্তান, মায়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা- সব প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গেই একটা বৈরিতামূলক আচরণের ভেতর দিয়ে ভারতের প্রবাহমান শান্তিপূর্ণ চরিত্রটিকে তছনছ করে দিতে উঠে পড়ে লাগেন।

আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তিস্তার জল ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঞ্চলিক জেদকেই প্রাধান্য দেন নরেন্দ্র মোদী। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে 'ইসলামী মৌলবাদী'রা যাতে অতীতে গঙ্গার জল ঘিরে যে কট্টর ভারতবিদ্বেষী অবস্থানে ছিল, তিস্তার জলের হিস্যা নিয়ে সেই অবস্থান আরও শক্ত করে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়। তিস্তার জল ঘিরেও তারা যাতে প্রবল ভারত-বিদ্বেষী অবস্থান নিতে পারে সেজন্য আপাত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী দেবেশ রায়ের মতো লোকেরা বাংলাদেশকে তিস্তার জল না দেওয়ার  পক্ষে মমতার অবস্থানের সমর্থনে নেমে পড়েন।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা মৌলবাদীদের হেনস্থার শিকার হন। আর এটাই তো চাইছিলেন নরেন্দ্র মোদী, তার দল বিজেপি এবং তাদের মস্তিষ্ক আরএসএস। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুকে সম্বল করে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানেদের উপর তারা নামিয়ে আনে অত্যাচারের স্টিম রোলার।

বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যে আন্তর্জাতিক সীমানা আছে সেখানে চোরাচালান ঘিরে সমস্যা দেশভাগের সময়কাল থেকে। গরু থেকে মসলা (রান্নার বিভিন্ন মশলা- জিরা থেকে গরম মসলা, বাংলাদেশে প্রায় উৎপাদন হয় না বললেই চলে। সোজা এবং বাঁকাপথে তা ভারত থেকে বাংলাদেশে যায়), ওষুধ, বেটনোভেট সি থেকে শুরু করে বোরোলিন, কাপড়, নেশাদ্রব্য- চোরাচালান দুই বাংলার সীমান্তের একটি বড় সমস্যা।

সরাসরি যারা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত তারা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে এই অসামাজিক কাজ করে। এদের মূল নিয়ন্ত্রকেরা দুই দেশেই প্রভাবশালী। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রশাসন চোরাচালানে প্রভাবশালীদের টিকিটিও স্পর্শ করে না। সরাসরি যারা চোরাচালান করে তাদের উপর নির্মম অত্যাচার করে ভারতের বিএসএফ। ২০১১ সালে বিএসএফ এর দ্বারা ফেলানি খাতুন নামক বাংলাদেশের একটি ছোট বাচ্চা মেয়ের উপর নির্মম অত্যাচার আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে ভারতের সম্মান মর্যাদা ধূলাতে লুটিয়ে দেয়। বিএসএফ এর গুলিতে ঝাঝরা হওয়া ছোট্ট ফেলানির দেহটি সারারাত সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলেছিল। সেদিন কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন মমতা। মানবতার খাতিরেও একটি শব্দ তিনি সেদিন উচ্চারণ করেন নি।

ফেলানির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দুই দেশের সচিব পর্যায়ের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ঠিক হয়েছিল- বিএসএফ বা বিডিআর কেউ-ই প্রথমে ধাতুর বুলেট ব্যবহার করবে না। প্ল্যাস্টিক বুলেট ব্যবহার করবে। 

চোরাকারবারি দেখলে তাদের উপর অহেতুক হামলা না করে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে তাদের তুলে দেওয়া হবে- এটাও দুই দেশেরই সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ঠিক হয়েছিল। ভারত এ প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যি যদি যত্নবান হতো তাহলে গত ছয় মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কমপক্ষে ২৫ জন বাংলাদেশের নাগরিকের জীবনাবসান ঘটতো না।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের বেপরোয়া হত্যালীলা, বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর সবধরনের অত্যাচার, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীদের অনেক বেশি পরিমাণে ভারতবিদ্বেষী করে তুলছে। মমতার ব্যক্তি আপত্তিতে তিস্তার জলের ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জেরে বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষ একটা বড় রকমের ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্কট ডেকে আনতে পারে।

অভিযোগ রয়েছে মমতার দলের প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য আহমদ ইমরান প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের বিরোধিদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলে। মমতার দলের  অপর প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমন যেভাবে ভাষাসৈনিক ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে নরপশু পাক হানাদারদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, সেই রাজাকারের সন্তানের হয়ে ওকালতি করছে। 

এসব বিষয় ঘিরে কি নরেন্দ্র মোদী, কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ভারতের বিদেশ নীতিতে প্রতিবেশির সঙ্গে সুসম্পর্ককে ভেস্তে দিতে এরা দুজনেই অত্যন্ত তৎপর। মার্কিন অর্থনেতিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থেই মোদী-মমতা যৌথভাবে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকেই ধর্মান্ধ এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে চান।