ইতিহাসের সিরাজ না মীরজাফর?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 July 2020, 01:29 PM
Updated : 16 July 2020, 01:29 PM

বর্তমান প্রজন্ম শাহজাহান সিরাজকে চেনে বলে মনে হয় না। চেনার মতো কাজ করা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া এই মানুষটি আমাদের যৌবনে ছিলেন তুখোড় এক নেতা। তার মতো অনেকেই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রবাদপ্রতিম সেই বাক্যটি। তিনি বলেছিলেন, "বাঙালি জন্মায় কালকেউটে হয়ে আর সাধারণত মারা যায় বিষহীন ঢোঁড়া সাপ হয়ে"। কথাটা এদের বেলায় নির্মম সত্য। তিনি কে তার একটা ছোট পরিচয় তুলে ধরি। বলাবাহুল্য এগুলো এখন সব খবরেই পাওয়া যায়।

শাহজাহান সিরাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের 'চার খলিফা' বলা হতো, শাহজাহান সিরাজ ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ ছাত্রনেতার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। সেখান থেকেই পরবর্তী দিনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্র জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাহজাহান সিরাজ। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালে 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)' বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ। পরবর্তী সময়ে জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাসদের মনোনয়নে তিনবার তিনি জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহজাহান সিরাজ ১৯৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির মনোনয়নেও একবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়া সরকারের শেষ পর্যায়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শাহজাহান সিরাজ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এবার আমরা মনে করব আরো কিছু মানুষের কথা। বঙ্গবীর একমাত্র সিভিল বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকীর কথা এসে যায়। এই মানুষটি একাত্তরে তো বটেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরও অসম সাহসী ভূমিকা রেখে এখন প্রায় আস্তাকুঁড়ে। কাদের সিদ্দিকীর মতো লোক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলবে বা লিখবে এমন কথা আমরা কোনোকালে স্বপ্নেও ভাবিনি। শুধু কি তাই? তিনি সেই মুক্তিযোদ্ধা যিনি দেশ স্বাধীনের পরপর বেয়নেটের খোঁচায় রাজাকারের জান নিয়েছিলেন। আর আজ তিনি তাদের মুখপাত্র। যেমনটি আ স ম আবদুর রব ও নূরে আলম সিদ্দিকীর বেলায়ও সত্য।

শাহজাহান সিরাজের কথায় আসি। দেশ স্বাধীনের পর মাঠজুড়ে তারুণ্যের ভীড়ে মঞ্চে উঠতেন জাসদ নেতা এম এ জলিল, আ স ম রব আর শাহজাহান সিরাজ। এমনও বলা হতো মঞ্চে উঠেছেন বাংলাদেশের মার্কস, লেনিন, এঙ্গেলস। সেই নেতাদের সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত যুবকেরা টাকা লুট করে এনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার আশায় তাদের ভেট দিত। তাদের জন্য জান দিতে তৈরি ছিল। এদের অন্ধকারে রেখে নেতাদের কেউ হয়ে গেলেন লিবিয়ার দালাল। মূলত কর্নেল তাহেরের হটকারী রাজনীতি আর তার ফাঁসির পর জাসদ বুঝে নিয়েছিল তাদের দিন শেষ। অন্যদিকে ততদিনে জেনারেল জিয়া তার পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলেছেন। একে একে হত্যা করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জাসদ তখন টার্গেট তার। সে সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া জাসদের নেতারা আর কোনোদিন একত্রিত বা এক হতে পারেনি। তারপর শুরু হলো তাদের দল বদলের পালা।

একজন গেলেন সামরিক শাসক একনায়ক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। আর শাহজাহান সিরাজ গেলেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার দল বিএনপিতে। আজ তিনি নাই। কিন্তু সে ইতিহাস খোলা পাতার মতো পড়ে আছে। যে কেউ বুঝতে পারবে এই যাবার কারণ ছিল দুটি। একটি হলো আওয়ামী লীগ বিরোধিতা আর তাদের দলে ঢুকতে না পারা। আরেকটি মন্ত্রী তথা পদের লোভ। মন্ত্রী তিনি হয়েছিলেন তবে তা হলেও যা, না হলেও তাই থাকত। কারণ শাহজাহান সিরাজের মূল পরিচয় একাত্তর পর্যন্ত তার ভূমিকা। যে অর্জন তাকে বীর করে রাখতো সে অর্জন তিনি হারিয়ে ফেললেন সামান্য লোভ লালসায়। বিএনপি তাকে ব্যবহার করে পুরনো টিস্যুর মতো ফেলে রেখেছিল একপাশে। কারণ তারা ভালো জানত শাহজাহান সিরাজ বিএনপি নামের ট্রেনে উঠেছিলেন যে কারণে তা শেষ হয়ে গেছে এবং তিনি ট্রেন থেকে নেমে গেছেন।

আমি বলবো সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগের কথা। এখন বা আগামী কয়েক বছর হয়ত তাদের এসব ভাবার সময় নাই, দরকারও নাই। কিন্তু রাজনীতি যদি রাজনীতি হয় আর ইতিহাস যদি কথা বলে তবে তাদের ভাবতেই হবে কেন দেশ স্বাধীনের পরপরই মুক্তিযুদ্ধের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দল ও সরকার থেকে একা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে একাত্তরের দেশকাঁপানো মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর সাহসী ছাত্রনেতাদের একজনও কেন দলের সাথে থাকতে পারেনি?

শাহজাহান সিরাজ ইতিহাসে যেমন থাকবেন তেমনি সময় তার কীর্তি বা পথ বদলানোও ভুলবে না। সেখানেই নির্ধারিত হবে তিনি কি সিরাজ না মীরজাফর? তবে এটা মনে রাখতেই হবে রাজনীতি ও সমাজের পচন কাউকে ছাড় দেয়নি। যে কারণে ছাত্রলীগের নেতা, জাসদ নেতা, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজের মৃত্যুর পর লেখা হলো বিএনপি নেতার মৃত্যু।

শাহজাহান সিরাজের আত্মার শান্তি কামনা করেই বলি, হায় রাজনীতি।