‘লকডাউন’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বনাম করোনাভাইরাসের সাথে বসবাস

মো. ফয়েজ উদ্দিন হাসান
Published : 29 June 2020, 04:43 PM
Updated : 29 June 2020, 04:43 PM

বাংলার গরীব মেহনতী মানুষসহ সব শ্রেণিপেশা তথা বাংলার আপামর জনসাধারণকে করোনাভাইরাস সংকট থেকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী সারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, দিয়ে যাচ্ছেন নানা নির্দেশনা এবং সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি সরাসরি মনিটরিং করছেন। তিনি ত্রাণ বিতরণসহ স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরুসহ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও জীবিকার তাগিদে সাধারণ মানুষকে তাদের নূন্যতম কার্যক্রম পরিচালনা করতে ও সরকারি বেসরকারি অফিসিয়াল কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে চালু রাখতে প্রায় ৬৩ দিন সাধারণ ছুটি অব্যাহত থাকার পর গত ৩১ মে থেকে সকল সরকারি বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়া হয়।

গত কয়েক সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে রেড জোন, ইয়েলো জোন, গ্রিন জোন কনসেপ্ট ও রেড জোনে এলাকাভিত্তিক 'লকডাউন' পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যদিও সবগুলো রেড জোনে কবে নাগাদ 'লকডাউন' কার্যক্রম শুরু করা হবে তার কাগজে কলমে পরিকল্পনা করা হলেও, বাস্তবে কার্যক্রম দেখা যায়নি। 

সম্প্রতি লকডাউন এর পক্ষে-বিপক্ষে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি চলছে। এটাই স্বাভাবিক যারা সরকারি চাকরি করেন ও মাস শেষে নিশ্চিত বেতন পান, তাদের জন্য লকডাউনে থাকা সহজ হলেও যারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জন্য লকডাউন বর্তমানে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গত তিন মাস ধরে লকডাউন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ও পাল্লা দিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় লকডাউন নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে। এ অবস্থায় কেউ লকডাউনের পক্ষে, কেউ লকডাউনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। 

করোনাভাইরাসের এ মহাসংকট আমাদের দেশে এখন আর লকডাউন দিয়ে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। গত কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা তাদের সংবাদে একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে। যেখানে বলা হয়েছে,, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংকট তীব্র হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তার মানে এখন জুনের  শেষ সপ্তাহ চলমান সেপ্টেম্বর আসতে আরও দুই মাস বাকি। আদৌ সেপ্টেম্বর অক্টোবরেও পিক হয় কিনা তা যেমন নিশ্চিত নয়, তেমনি করোনাভাইরাস সংকট তীব্র হওয়ার সময়টায় পরিস্থিতি কেমন হবে তাও অনিশ্চিত। তেমনি তীব্রতা কতোদিন চলমান থাকবে বা তীব্রতার ক্রিয়াকাল শেষ হওয়ার পর কোন গতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াবে তাও অনিশ্চিত। অর্থাৎ আগামীর সময় অনিশ্চয়তায় ভরা। তাই আমাদের এখন মনে হয় 'How to live with Corona' পন্থা বেছে নিতে হবে কেননা সরকারি, বেসরকারি চাকুরীজীবী, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ছিন্নমূল, ভাসমান অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ মানুষকে করোনাভাইরাসকে মাথার উপরে নিয়েই এর বিরুদ্ধে লড়াই করার নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে হবে। 

'How to live with Corona' বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সংকট মোকাবেলায় নিজেরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে কিছু উদ্যোগ ও নিয়ম কানুন মেনে চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। 

সেগুলো হলো-

১. পরিবারের যেসব সদস্যকে জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘরের বাইরে যেতেই হবে তাদের হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরিহিত থাকা, কর্মস্থলে থাকাকালীন অন্তত দুই  ঘণ্টা পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও প্রতিটি কাজ শেষে হাত স্যানিটাইজ করা এবং কাজ শেষে বাসায় ফেরার সাথে সাথে জুতা ঘরের বাইরে রেখে পোশাকসহ ওয়াশরুমে সাবান দিয়ে গোসল করার পাশাপাশি পরিহিত পোশাক ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ধুয়ে ফেলা। 

যাদের আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে তারা পরিবারের খুব প্রিয় মানুষগুলোর সুস্বাস্থ্য পুরোপুরি নিশ্চিত না হোক কিছুটা নিশ্চিত করার স্বার্থে আলাদা ঘরে থাকা,খাওয়া ও সম্ভব হলে আলাদা ওয়াশরুমও ব্যবহারের বিষয়টি মেনে চলতে পারি। আর যাদের আলাদা কক্ষে থাকার মতো ব্যবস্থা নেই তারা যতোটা সম্ভব একে অপর থেকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেশি দূরত্বে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। 

২. পরিবারের বয়স্ক এবং শিশুদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কেননা বয়স্কদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিস, প্রেসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনিসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত অবস্থায় আছেন তাদের ক্ষেত্রে একেবারেই বাধ্য না হলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। শিশুরা ঘরে থাকতে থাকতে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাই শিশুদের মন প্রফুল্ল রাখতে বাসার বড়রা ঘরে তাদেরকে নিয়ে লুডো খেলা, ক্যারাম খেলা, চোর-পুলিশ-ডাকাত খেলাসহ বিভিন্ন বোর্ড ও ইনডোর গেইমের ব্যবস্থা করতে হবে। বড়দেরও তাতে অংশ নিতে হবে। এতে শিশুদের মন যেমন বিষণ্ণতামুক্ত থাকবে তেমনি পরিবারের বড়দেরও তাদের সাথে আন্তরিকতা ও পারষ্পারিক বন্ধন দৃঢ় হবে যা শিশুদের জীবনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। 

অন্তত নিয়ম করে সারা দিন-রাতে চারবেলা হাত ধোয়া, প্রতিবেলা টয়লেট ব্যবহারের পর হাত সাবান দিয়ে ধোয়া এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার পর এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করার বিষয়টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে করোনাভাইরাস থেকে যেমন শিশু ও ঘরের সবাই মুক্ত থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে তেমনি শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাসগুলোও গড়ে উঠবে। 

এছাড়াও শিশুদের সাথে নিয়ে পরিবারের বড়রা চার বার গরম পানি লবণ দিয়ে গড়গড়া করানো, কালো জিরা, মধু, লেবুসহ ভিটামিন জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলা যায়। পরিবারের সকল সদস্যই হালকা গরম পানি মিশিয়ে গোসল এবং ফ্রিজের ঠান্ডা পানি বা যে কোন ঠাণ্ডা কোমল পানীয় পরিহার করার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে। পরিবারের সবাই নাকে-মুখে হাত যথাসম্ভব কম দেওয়ার বিষয়টি পরিহার করার অভ্যাস নিশ্চিত করতে পারি।

৩. ঘরে অবশ্যই প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বয়স্ক যাদের শ্বাসকষ্ট আছে এবং ইনহেলার ব্যবহারের নির্দেশনা চিকিৎসক দিয়েছেন তাদের জন্য ইনহেলার, ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট বা সিরাপ চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক সংগ্রহ করে রাখা যেতে পারে। আর যাদের জন্য এগুলো সংগ্রহে রাখাও সম্ভব নয় তারা অন্তত নিয়ম করে লেবুর সরবত, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার, pH মাত্রা যে সকল ফলে বেশি তা বেশি বেশি খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন। পরিবারের কেউ যদি জ্বর, ঠাণ্ডা বা ডায়রিয়াজনিত সমস্যায় পড়েন তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক ওষুধ খেতে হবে। 

যদি কোনও কারণে অস্বাভাবিক শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সেক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করতে হবে। যদিও শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, কিডনিসহ নানা জটিলতায় আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি এখন সবচেয়ে দুষ্কর কাজ। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে চেষ্টা করে যেতে হবে।

৪. করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী কারও বাড়ি যাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখা। তাদেরও নিজের বাড়িতে আসতে না দেওয়া নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেখানে ভিড় বেশি, কুড়ি জনের বেশি লোক জমায়েত হয়েছে সে জায়গা এড়িয়ে চলুন, সে শপিং মল হোক কিংবা ধর্মীয় স্থান।

৫. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। আর আমাদের পরিবার ও পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে তার প্রতি মানবিক আচরণ করা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। আমরা পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ মানসিক ও আনুসঙ্গিক সব সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পাড়া বা মহল্লার  কেউ আক্রান্ত হলে তাদেরকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সার্বক্ষণিক অডিও কল বা ভিডিও কলের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া, মাঝে মাঝে খাবার পাঠানো, ওষুধ বা প্রয়োজনীয় কোন কিছু লাগলে ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং হাসপাতালে নিতে হলে অ্যাম্বুলেন্সে ব্যবস্থা করে দেওয়াসহ সার্বিক সহযোগিতা করা উচিত। দেখেন আজকে হয়তো অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ায় আমি-আপনি তাকে বর্জন করলাম। এই বিষয়টা কিন্তু আমার বা আপনার সাথেও হতে পারে। তাই করোনাভাইরাসের সাথে এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হলে নৈতিক, মানবিক, সামাজিক দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হওয়া ও স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলা অত্যাবশ্যক।

যেহেতু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, তাই যাদের ঘরের বাইরে যেতেই হবে জীবিকার তাগিদে তাদের সুরক্ষিত থাকার নিয়মগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। যাদের ঘরের বাইরে যাওয়া জরুরি নয় তাদের ধৈর্যের সাথে নিজের ও পরিবারের এবং আশেপাশের মানুষগুলোর বেঁচে থাকতে সহায়তা করার লক্ষ্যে নিজের বাড়িতে অবস্থান করে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। 

এভাবে হয়তো মৃত্যুর হার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং আক্রান্তের হারও তুলনামূলক কম হতে পারে। তাই আসুন নিজে যেমন পরিবারের সবাইকে নিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সুরক্ষিত থাকার নিয়মগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মেনে চলার চেষ্টা করি এবং অন্যদেরও তা অনুসরণের পরামর্শ দেই