অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম: সেমিস্টার এগোচ্ছে, শিক্ষা নয়

মরিয়ম সুলতানা
Published : 19 May 2020, 08:07 AM
Updated : 19 May 2020, 08:07 AM

আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম প্রসঙ্গে যা-ই বলি না কেন, পরিশেষে তা শোনাবে ঐ অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করার মতন। কারণ এ তল্লাটে কেউ নেই যে এসব শিক্ষার্থীর করুণ আর্তচিৎকারকে যথাযথভাবে শুনবে, বুঝবে এবং উপলব্ধি করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে বরাবর-ই প্রলেতারিয়েত।

আমি বারবার করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি কারণ এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। তারা না পারছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মতো ক্লাস বর্জন করার মতো কোনো দুঃসাহসিক আন্দোলনে শামিল হতে, না পারছে মেরুদণ্ড সোজা করে উন্নত মস্তকে দৃঢ়ভাবে নিজেদের যথার্থ দাবির কথা জানাতে। কারণ চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার কাছে তাদের হাত পা বাঁধা, সিস্টেমের কাছে তারা আষ্টেপৃষ্টে বন্দী।

তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে মনোজগতে ঘুরেফিরে নিম্নোক্ত প্রশ্নসমূহ এসেই যায়।

বাংলাদেশ কি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বান্ধব?

একেবারে শুরুর দিন থেকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বৃহৎ সংখ্যক অংশ দেশীয় বাস্তবতার নিরিখে এই অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা বন্ধের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করে আসছে। যারা সুযোগ পেয়েছে, তারা গণমাধ্যম মারফৎ তাদের বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। যারা আরও বেশি সোচ্চার, তারা সকলের পক্ষ হতে রাজপথে নেমে এসে তাদের দাবির কথা জানিয়েছে এবং অগণিত শিক্ষার্থী তাতে সংহতিও জানিয়েছে। তবুও আমাদের হর্তাকর্তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যতবার এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম প্রসঙ্গ এসেছে, ততবার তারা মুখস্থ স্ত্রোতবাক্যের ন্যায় বলেছেন যে এই করোনাভাইরাস মহামারীতে তারা উন্নত দেশগুলিকে অনুসরণ করছেন। দীর্ঘমেয়াদী সেশনজট এড়ানোর জন্য শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে তারা ঐসব দেশগুলির মতো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। খুবই ভালো কথা, বিশ্বায়নের যুগে এমনটাই হওয়া উচিৎ। নিঃসন্দেহে এটা বাহবা দেয়ার মতো যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়ার আগে কি তাদের এটাও পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে ভেবে দেখা উচিত ছিল না যে, আমার বাংলাদেশ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ঠিক কতটা প্রস্তুত?

প্রথমত, শুধু ঢাকা শহর দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে বিচার করলে হবে না। যারা ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, তারা অধিকাংশই এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট-বড় শহর কিংবা গ্রাম থেকে এবং এই করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য এই মুহূর্তে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। আর এটা তো আমাদের অজানা না যে, ঢাকার বাইরে ব্রডব্যান্ড কানেকশন সেভাবে নেই। বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ের শহরগুলিতে তাও যা একটু আছে, কিন্তু উপজেলা বা গ্রামগুলিতে এসবের ছিঁটেফোঁটাও নেই। আর মোবাইল নেটওয়ার্কের কথা ধরলে, ফোরজি'র যুগে গ্রামে টুজি পাওয়াই ভার।

দ্বিতীয়ত, এবার আসি ইন্টারনেট প্যাকেজের গলাকাটা দামের আলাপে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামীণফোন ব্যবহার করে। অথচ এই মহামারীর মাঝে সবাই যখন ঘরে, তখনও তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের জন্য আকাশচুম্বী দাম দাবি করে বসে আছে। এরকম আরও কিছুকাল চলতে থাকলে গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে কিনতে কোনো একদিন রাজার কোষাগারও ফুরোবে। এদিকে ঢাকার বাইরে গিয়ে যে অন্য অপারেটর ব্যবহার করবে মানুষ, তারও উপায় নাই। কারণ ঢাকার বাইরে যেখানে জিপি'র নেটওয়ার্কের অবস্থাই করুণ, সেখানে অন্যগুলির নেটওয়ার্কের নাগাল পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।

তৃতীয়ত, বৈদ্যুতিক সমস্যা। ব্যক্তিগত আলাপে গেলে, আমার কাছে এই মুহূর্তে এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা। বর্ষামৌসুমের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদুৎ সরবরাহ পাওয়া রীতিমতো আকাশ কুসুম কল্পনা। আর কারোর বাড়ি যদি হয় উপকূলীয় অঞ্চলে, তাহলে তো কথাই নেই। বলা নেই, কওয়া নেই, যখন তখন কালবৈশাখীর তাণ্ডব। গাছপালা ভেঙ্গেচুরে একাকার এবং এর ফলাফল, ৪৮ মিনিট থেকে ৪৮ ঘণ্টা অবধি বিদ্যুতের মুখ দেখার পথ বন্ধ। কখনো সখনো সময়সীমাটা বেড়ে হয় দ্বিগুণ। এই যেমন, গত ১৬ মে প্রায় ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিভ্রাটের কবলে পড়ায় পরদিন সকালে আমি আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কারণ আমার কোনো ডিভাইসে ন্যূনতম চার্জ ছিল না। এখন এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার দায়ভার কি আমার?

সুতরাং, এই যদি হয় দেশের সংক্ষিপ্ত আকারের সামগ্রিক চিত্র, তাহলে কোন ভরসায় আমরা লাঙ্গল-জোয়াল না নিয়ে আনাড়ি হাতে হালচাষ করার মতো কঠিন কাজে অগ্রসর হই? মোদ্দাকথা হলো, বিষয়গুলি "ও তো রোজ মাছ-ভাত খাচ্ছে, আমি কেন তবে ডাল-ভাত খাব?" এর মতো হয়ে গেলে সমস্যা। উন্নত দেশগুলি অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, পরীক্ষা নিচ্ছে; কারণ তাদের আপামর জনগোষ্ঠীর সেই সক্ষমতা আছে। আমরা আগে সেই সক্ষমতা অর্জন করি, তারপর না হয় অনলাইন ক্লাস প্রসঙ্গে তাদের সাথে নিজেদেরকে তুলনা করি!

বাকী ৪০% এর কি অপরাধ?

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। তারপর, গত ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাময়িক ভাবে পূরণ করার লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে অনলাইন ক্লাস নিতে বলা হয়। তবে গত ৬ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানায় ইউজিসি। কিন্তু প্রায় এক মাস পর গত ৩০ এপ্রিল ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফের অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করে।

আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চলমান অনলাইন ক্লাসে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেই তারা অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, বাকী ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর অপরাধটা আসলে কোথায়? এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যে অধিকাংশের কাছে পৌঁছালো, আর হয়ে গেল?

প্রসঙ্গত একটা বিষয় না বললেই নয়, আমাদের এখানকার মানুষ ঢাকঢোল পিটিয়ে কিংবা মনে মনে গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যারা পড়ছে, তাদের মা-বাবারা অঢেল টাকা পয়সার মালিক। অথচ, বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থীই কি উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে? একদমই না। সত্যি বলতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই আসে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাছাড়া এমনও অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। অনেকেই আছে যারা নিজের টিউশন ফি নিজের উপার্জনকৃত অর্থ থেকে প্রদান করে। এদের কেউ কেউ ছোটখাটো চাকুরি করে, কেউ ব্যবসা করে, কেউ ফ্রিল্যান্সিং করে। কেউ কেউ আবার সারাদিন একটানা ক্লাস করার পর হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায় রাজধানীর এ বাসা থেকে ও বাসায়, টিউশানির জন্য। তারপর রাত বাড়লে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে নিজের এক চিলতে কামরায় ফিরে আসে, বইপত্র খুলে বসে এবং পরদিন থেকে আবার সেই একই চক্রব্যুহ।

সুতরাং, বিত্তবান শব্দের ঝাঁ চকচকে মোড়কের আড়ালে থাকা ঐসব মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর কাছে এই উচ্চমূল্যের নিম্ন গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট পরিসেবা গ্রহণ করাটা রীতিমতো বিলাসিতা ছাড়া অন্য কিছু না। আমি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না যেসব শিক্ষার্থীর শতভাগ অংশগ্রহণ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে, একটা বৃহদাংশকে বঞ্চিত করে ইউজিসি কিভাবে অমন একটা একপাক্ষিক রায় দিতে পারে। ওপরে আলোচিত কোনো একটা কারণে কেউ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে ঐ ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য তবে একটা পথই খোলা থাকবে, সেমিস্টার ড্রপ করা। জীবনের কি নিদারুণ অপচয়, না?

আদতে কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে, নাকি মালিকপক্ষের?

পৃথিবী কবে সুস্থ হবে, আকাশে বাতাসে কবে প্রাণ ফিরে আসবে, আমরা কেউ তা জানি না। কিন্তু এই কঠিন সময়ে হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ চলমান সেমিস্টারের জন্য গত ১৭ মার্চের বেশ আগেই তারা হাজার হাজার টাকা তাদের সেমিস্টার ফি জমা দিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করা মানে পরবর্তীতে ঐ একই পরিমাণ টাকা গোনা।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, চলতি সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী সেমিস্টারের কোর্স রেজিস্ট্রেশন ও ক্লাস করার সুযোগ পাবেন। এছাড়া সেখানে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কাছে সেমিস্টার ফি আদায়ের জন্য কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু ইউজিসির এই নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কতটুকু স্বচ্ছতার সাথে মেনে চলছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এছাড়া অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ প্রসঙ্গ এলে এরকম যুক্তি শোনা যায় যেহেতু বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো সরকারি অনুদান বা সহায়তা পায় না, সেহেতু শিক্ষার্থীদের প্রদেয় অর্থ দিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাই এই মুহূর্তে যদি পরীক্ষা না নেয়া হয় কিংবা নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু না হয়, তবে তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকে চাকরিচ্যুতও হবেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এই শঙ্কাটাই বা কেন তৈরি হচ্ছে? সাদা চোখে বিচার করলেও এতটুকু স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে বিগত বছরগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কম আয় করেনি! তা দিয়ে এক বছরের না হোক, অন্তত আগামী ছ'মাসের বেতন তো অনায়াসে পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকার কথা তাদের। তাহলে ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে অনলাইন ক্লাস করানোর জন্য কেন এত তাড়াহুড়ো?

সর্বোপরি, যা হচ্ছে তাতে করে সবাই নাক চোখ বন্ধ করে ক্লাস করবে ঠিকই, নামমাত্র ওয়েভার কিংবা ইন্সটলমেন্টের আড়ালে শিক্ষার্থীরা নিজের এবং নিজের পরিবারের রক্ত বেচে হলেও সেমিস্টার ফি জোগাড় করবে ঠিকই, ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন সবাই গোটা সেমিস্টারটাও শেষ করে ফেলবে; কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন, সেই শিক্ষাগ্রহণ কতটুকু সম্পন্ন হবে তা কেবল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানে।