গরিব বাঁচাতে প্রয়োজনে ধনীদের উপর করারোপ করা হোক

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 18 May 2020, 02:30 PM
Updated : 18 May 2020, 02:30 PM

করোনাভাইরাসের রমরমা বাজারে নানা ধরনের বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় একটা বার্তা হচ্ছে, 'ঘরে থাকুন। সতর্ক থাকুন। সুস্থ থাকুন। মনে রাখবেন করোনাভাইরাস কিন্তু ধনী-গরিব বাছবিচার করে না।'

এই বার্তাটার মধ্যে বেশ একটা সাম্যবাদী ফ্লেভার আছে। সমাজে ধনী-গরিবের সম্পদের ব্যাপক অসম বণ্টনের মাঝে এই ভাইরাস সংক্রমণে প্রথম দিকে তেমন কোনও শ্রেণিবৈষম্যের লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু আস্তে আস্তে এই ভাইরাস সংক্রমণে শ্রেণিবৈষম্যের অভিযোগ উঠছে। যথারীতি দরিদ্ররাই অধিক আক্রান্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণা তথ্যে দেখা যাচ্ছে।

দারিদ্র্র্য আসলেই এক অভিশাপ। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাসও বেশি আক্রান্ত করেছে দরিদ্রদের। গবেষকরা দেখেছেন, দরিদ্র, বেশি বয়সী মানুষ আর দীর্ঘমেয়াদে লিভার রোগীরাই করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ব্রিটেনের ৩ হাজার ৬০০ করোনাভাইরাস রোগীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করে এমনটিই নিশ্চিত হয়েছেন।

গবেষকরা বলছেন, ব্রিটেনের কিছুটা দরিদ্র এলাকার বাসিন্দারা আশপাশের ধনী এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দাদের চেয়ে চারগুণ বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছে। ৩৬০০ জন রোগীর নমুনা ও ইতিহাস বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, এদের মধ্যে ৬৬০ জন অতি দরিদ্র-বঞ্চিত এলাকার বাসিন্দা। এসব বাসিন্দার ২৯.৫ শতাংশ করোনাভাইরাস পজিটিভ। অন্যদিকে ধনী এলাকার মাত্র ৭.৭ শতাংশ করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছেন। ব্রিটেনে করোনাভাইরাস কিছুটা বর্ণ বৈষম্যও করেছে। কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা কিছুটা বাদামী ত্বকের মানুষ ৬২ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে, সে তুলনায় সাদা চামড়ার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে মাত্র সাড়ে ১৫ শতাংশ। গবেষকরা একথাও বলেছেন যে, করোনাভাইরাসের আসল ঝুঁকিই হচ্ছে দারিদ্র্য-বঞ্চনা।

আমাদের দেশে যদিও এ ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি, তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এখানেও নিম্নবিত্তরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, গার্মেন্টসকর্মী, দিনমজুরেরা রয়েছে। তবে সংক্রমণ বাদ দিয়ে যদি অভিঘাত বা 'এফেক্ট' ধরা হয়, সেক্ষেত্রে ধনী-গরিবের ওপর তা কিন্তু মোটেও সমান নয়। করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় এফেক্ট হচ্ছে, 'লকডাউন'। লকডাইনের কারণে দেশের উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তদের তেমন কোনো উনিশ-বিশ হয়নি। তারা ঘরে বসে ঠিকই নানা পদের রান্না খেয়েছেন। প্রাণ ভরে ঘুমিয়েছেন। মুভি দেখেছেন। সারাদিন ভিডিও কলে সংযুক্ত থেকেছেন। বড়লোকদের জন্য হোম ডেলিভারিরও কোনো কমতি ছিল না। তাদের জীবনটা আসলেই যেন সিনেমা। একেবারেই রঙ্গিন। গাড়ির বিজ্ঞাপনের মতো স্মুথ ও গতিশীল। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। দুঃখের বিষয় হলো, দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনটা সিনেমা বা গাড়ির বিজ্ঞাপনের মতো রঙিন নয়, বরং সাদা-কালো।

আসলে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের বাইরে আরেকটা বাংলাদেশ আছে। সিটি করপোরেশনের যে পরিচ্ছন্নকর্মী প্রতিদিন সকালে এঁটোকাঁটা ভর্তি ব্যাগটা ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যে নারীটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্না করছে, বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যারা আমাদের বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করছে, যেসব রিক্সা-ভ্যান-অটো-উবার-পাঠাও চালক মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে, শহরের রাস্তাঘাট সারাই করছে, মধ্যবিত্তের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্নে যে রাজমিস্ত্রিটা একের পর এক ইট গাঁথছে, যাদের প্রতিদিনের রক্ত জল করা পরিশ্রমে সভ্যতার পিরামিড আকাশে পাড়ি দিচ্ছে, ঝাঁ চকচকে আধুনিক নগরীর ইমারতগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে, এটা সেই বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ শ্রমিকই আসলে 'আন-অরগানাইজড'; যাদের মাস গেলে ন্যূনতম বেতন নেই, চাকরির নিরাপত্তা নেই, ওভারটাইমে মজুরি নেই, সরকার ধার্য ছুটি নেই, শ্রম আইনে বোনাস নেই, ইনক্রিমেন্ট নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, প্রোমোশন নেই-সেই বাংলাদেশ। গত ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির নামে অলিখিত 'লকডাউন' ঘোষণা করার পর থেকেই এই শ্রেণিটি রাতারাতি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ না হয়েও তাদের জীবন এবং জীবিকা দুটোই আক্রান্ত। এদের জীবনে ডালগোনা কফির অস্তিত্ব নেই, সাতরঙা শাড়ির চ্যালেঞ্জ নেই, ধান-কাটার ছবি নিয়ে মাথা ঘামানো নেই, গণস্বাস্থ্যের কিটের খবর এরা রাখে না। তারা 'হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইন' উচ্চারণ করতে পারে না। তারা আইসোলেশান বোঝে না, কোয়ারেন্টিন বোঝে না, হার্ড ইমিউনিটি বোঝে না। তারা করোনাকে বলে করুণা! এদের জীবনে একটাই চ্যালেঞ্জ: ডাল-ভাত।

তাদের ডাল-ভাতের ব্যবস্থা কি হচ্ছে? সরকার ইতোমধ্যে অনেকগুলো স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ত্রাণসহ ১০ টাকার চাল বিতরণ কার্যক্রম চলছে। সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে রয়েছে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক, পোলট্রি খামারের শ্রমিক, বাস-ট্রাকের পরিবহন শ্রমিক ও হকারসহ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেওয়া লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। যদিও ত্রাণ, ওএমএসের চাল বিতরণের মতো এ ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য সরকার প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অধিকাংশ টাকার সংস্থানই হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে আরও বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান প্রয়োজন। সরকার এখন পর্যন্ত যা করেছে বা যতটুকু যা ঘোষণা দিয়েছে, তাতে নিচের তলার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার টাকার পরিমাণটি প্রয়োজনের তুলনায় নিদারুণ রকম অপ্রতুল। আইএলও-র এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত প্রায় দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে কোভিড-১৯-এর ফলে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষিত অঙ্কের অন্তত চার গুণ পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এই মানুষগুলিকে চরম দারিদ্র্য থেকে বাঁচাতে।

যেটুকু প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, আর যা ঘোষণা করা হবে, সে অর্থ আসবে কোথা থেকে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যথাসম্ভব অল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ধার নিতে হবে, আর কিছুটা আসবে অনুদান থেকে। এ ছাড়া অন্য বিকল্প বিশেষ নেই। তবে সরকার দেশের ধনীদের ব্যাপারে এখনও নিশ্চুপ আছে। তাদের ব্যাপারেও ভাবনাচিন্তা করা দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে 'অংশীদারি অর্থনীতি'র ধারণার প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। যেখানে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের অংশ সরকার নিয়ে গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেবে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কিছুটা বাগে আনতে এই মুহূর্তে এ ধরনের আর্থিক পুনর্বণ্টনের কথা ভাবা যেতে পারে।

অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোভিডের ধাক্কায় যখন অর্থনীতি টলোমলো, ব্যবসায় লাভও যখন অনিশ্চিত, তখন তো শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা প্রণোদনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন এ ধরনের উদ্যোগ কি আদৌ বাস্তবস্মত হবে? আপাতত সম্ভব না হলেও সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও তেমন প্রস্তাব দিয়েছেন। আর বিত্তবানদের লাভের ওপর কর বসানো যদি একেবারেই অসম্ভব হয়, তাহলে অন্তত তাদের সম্পদ বা 'ওয়েলথ'-এর ওপর কর বসানো যেতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স-এর ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৭৫% রয়েছে দেশের ধনীতম ১০% ব্যক্তির কাছে। এখন এই ধনীতম ১০% ব্যক্তির সম্পদের ওপর সরকার যদি এই আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় মাত্র ২% শতাংশ সম্পদ কর বহাল করে, তা হলেই সরকারের কোষাগারে অনেক টাকা আসতে পারে। অনেক মুশকিল আসান হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার সেটা করবে কি? ব্যয় সংকোচ নীতিতে ৯০% সাধারণ মানুষের, কারও বেতন কেটে, কারও বোনাস আটকে, কারও ফিক্সড ডিপোজিট কারও পিএফএ-র সুদের হার কমিয়ে, কারও পেনশন আটকে অর্থনীতি সামাল দেওয়া চেষ্টা করবে? নাকি, দেশের ধনীতম ১০% মানুষের সম্পদের উপর কর বহাল করে দেশের ৯০% মানুষের মুশকিল আসানের ব্যবস্থা করবে? বিকল্প দুটি। পছন্দ করতে হবে একটি!