ঘরেই থাকতে হবে, রাখতে হবে

ইমতিয়ার শামীম
Published : 20 April 2020, 02:17 PM
Updated : 20 April 2020, 02:17 PM

'বোম্বাইসে আদমী আনেসে থানামে খবর দেনে হোগা'।

ঢেঁড়া পিটিয়ে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ১৮৯৮ সালের কলকাতাতে। ১৮৯৬ সাল থেকে বোম্বেকে জনশূন্য করে ফেলা প্লেগ তখন কলকাতাতেও দেখা দিতে শুরু করেছে। কর্তৃপক্ষের চোখ পড়েছিল তাই বিশেষ করে বোম্বে থেকে আসা মানুষজনের দিকে। করপোরেশনের এমন ঢেঁড়াপেটানিতে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র আতঙ্ক। অজানা এক আশঙ্কায় দুইদিনের মধ্যেই নাকি এই মহানগর ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।

কর্তৃপক্ষ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল প্লেগের টিকা নিতে। বলেছিল কারও প্লেগ হলেই তাকে ঘরান্তরীণ বা কোয়ারেন্টিনে নেয়া হবে। সেজন্যে প্লেগের হাসপাতালও তৈরি করা হয়েছিল মেছোবাজারের মার্কাস স্কোয়ারে। কিন্তু মানুষজন রাজি ছিল না টিকা নিতে, ঘরান্তরীণ হতে। কারও কারও ধারণা হয়েছিল, টিকা নেয়ার ১০ ঘন্টার মধ্যেই মানুষ কাবাব হয়ে যাবে। কেউ কেউ বলেছিলেন, আসলে টিকা দেয়ার সময় পেট থেকে একপয়সা মাপের মাংসের বড়া তুলে নিয়ে তার মধ্যে প্লেগের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধিরা অবশ্য এই টিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কী, মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়নি। বরং প্লেগের টিকা নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ধর্মঘট শুরু হয় কলকাতাতে। অচল হয়ে পড়ে এই মহানগর। করপোরেশনের স্বাস্থ্যরক্ষকদের প্রধান ডা. কুককে হত্যা করার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে মানুষ। শৈশবকালের এসব ঘটনার খণ্ডস্মৃতি প্রেমাঙ্কুর আতর্থী লিখে গেছেন তার 'মহাজাতক স্থবির' নামের বইয়ে। কী আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল তখন, তা অনুমান করা যায় ১৮৯৮ সালের ৪ মে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকেও, ''আতঙ্কের রূপ অদৃষ্টপূর্ব। আর কখনো কলকাতার বিপুল জনসংখ্যা এইরকম প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়নি। যেসব জেনানার মুখ 'সূর্যও দেখেনি', তারাও শহরের পথের উপর দিয়ে দৌড়েছেন, বা ট্রামে-চড়ে পালাতে চেয়েছেন।''

ঘরান্তরীণ আতঙ্কের কথা আছে কালজয়ী জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও। 'শ্রীকান্তের' দ্বিতীয় খণ্ডে দেখি, বেলা ১১টা-১২ টার দিকে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু ভোর থেকেই সব যাত্রীদের চোখেমুখে ভয় আর চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। আশপাশ থেকে একটা শব্দ অস্ফুট স্বরে শ্রীকান্তের কানে এসে বাজল, কেরেন্টিন… কেরেন্টিন। শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ''খবর লইয়া জানিলাম, শব্দটা quarantine; তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বসবাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।'' শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত দেখেছিলেন, সদ্য বহিরাগতদের জন্যে প্রযোজ্য সাম্রাজ্যবাদী শাসক ব্রিটিশদের এই কোয়ারান্টিন নীতির যন্ত্রণা আসলে পোহাতে হতো 'ছোটলোকদের'। প্লেগরোগীদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়, শরৎচন্দ্র তা জানতেন, তারপরও দুঃখজনক ঘটনা হলো এই ভয়ানক রোগটাতেই তার স্ত্রী আর সন্তানেরও মৃত্যু ঘটেছিল।

উনবিংশ শতাব্দীর সেই কোয়ারেন্টিনের সঙ্গে অবশ্য এই একবিংশ শতাব্দীতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ঘোষিত ঘরান্তরীণের পার্থক্য অনেক। পুঁজিশক্তির মতোই দাপুটে করোনাভাইরাস রাষ্ট্রের সীমানা মানছে না, সমাজ বা সংস্কৃতিও মানছে না, মানছে না কোনো নৈতিকতা। যদিও তাকে নিয়ে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্বরাজনীতি। একে ঘিরে পশ্চাৎপদ সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ ছড়িয়ে পড়ছে মহামারীর মতোই। নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের প্রকাশও ঘটছে এ রোগকে ঘিরে। অতীতের আরও অনেক ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগের মতো কোভিড-১৯-ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেক মানুষকে তা আতঙ্কিত করছে, অনেককে করে তুলছে বড় বেশি পরলৌকিক, কিন্তু অনেকের মধ্যে তা আবার জাগিয়ে তুলেছে মানবজাতির বিপর্যয় থেকে মুনাফা ও লুটপাটের দুর্বিনীত ক্রূঢ়তা।

শতবর্ষ আগে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর, স্প্যানিশ ফ্লু যখন সারাবিশ্বের মানুষকে তাড়িয়ে ফিরছে, তখন ভারতের মানুষজন দেখেছিল আতশবাজির খেলা। যুদ্ধজয়ের আনন্দে অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত লোকজন মেতে উঠেছিল আতশবাজিতে। তবে শুধু আতশবাজি তো নয়, আতশবাজির নামে নগদ অর্থ লোপাট করার উদ্দেশ্যও ছিল তাতে। নৃতাত্ত্বিক অতুল সুর এরই খানিকটা বিবরণ লিখে গেছেন গেছেন তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'শতাব্দীর প্রতিধ্বনি'তে (প্রকাশক : মুক্তধারা, ডিসেম্বর ১৯৭১)। ভয়াবহ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা স্প্যানিশ ফ্লুতে তার এ বইয়ে দেওয়া তথ্যানুযায়ী ভারতবর্ষে মৃত্যু ঘটেছিল ৮০ লাখ মানুষের। রোগটি তখন লোকমুখে পরিচিত ছিল 'ডেংগু' নামে। অতুল সুর জানাচ্ছেন, ওই সময় শ্মশানঘাটে মরা পোড়ানো ছিল এক কঠিন ব্যাপার। গঙ্গার ধারে তখন আধামাইল দীর্ঘ মড়ার খাটের লাইন পড়ত। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর মহামারীর মধ্যেও মহাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার আনন্দে মেতে উঠেছিল ব্রিটিশরাজের সরকারি কর্মকর্তারা। সরকারি খরচে করা হয়েছিল আতশবাজি। তার ভাষায়, 'আমাদের শ্যামবাজারেও বাজি পোড়ানোর জন্য এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু যাদের হাতে এর ভার দেওয়া হয়েছিল, তারা কৌশল করে দু-চার মিনিট বাজি পোড়াবার পর বাজির গাদায় আগুন লাগিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কেউ জানতে পারল না যে দগ্ধবাজি এক হাজার টাকার কি এক লক্ষ টাকার।'

সংক্ষেপে বলা ভাল, ১৯১৮ সালের সেই ভয়াবহ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর অন্তত ৫০ কোটি মানুষ। পৃথিবীর জনসংখ্যা তখন ছিল ১৮০ কোটি থেকে ১৯০ কোটির মতো। স্প্যানিশ ফ্লু'র কারণে তখন মারা যায় সারাবিশ্বে এককোটি থেকে ১০ কোটি মানুষ। তাহিতি দীপপুঞ্জে মারা গিয়েছিল সে দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ, সামোয়াতে মারা গিয়েছিল ২০ শতাংশ। অতুল সুর ভারতবর্ষে ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা লিখলেও কারও কারও লেখায় বলা হয়েছে, 'স্প্যানিশ ফ্লু'র কারণে এখানে মৃত্যু ঘটেছিল দেড় কোটিরও বেশি মানুষের! অবশ্য পূর্ববঙ্গে এই রোগের তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি, যার কারণ অনেকটাই যোগাযোগহীনতা এবং মহাযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে ইংরেজ সৈনিকদের অনুপস্থিতি।

এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের কালে আতশবাজি বাংলাদেশেও ঘটেছে– যদিও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সেই কর্মসূচি অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে; 'সব ধরনের প্রস্তুতি আছে' বলে যে সান্ত্বনা দেশের মানুষকে দেয়া হয়েছিল, আটই মার্চে প্রথম করোনারোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে যতদিন গেছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এখানকার স্বাস্থ্যসেবায় যেমন প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে, তেমনি রয়েছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রস্তুতিতেও– এ ধরনের রোগে ঘনবসতিপূর্ণ, দারিদ্রআক্রান্ত সর্বোপরি নিপীড়ণ ও সুশাসনের সংকটে পূর্ণ এই দেশে মানুষকে কী করে ঘরে রাখা যাবে, সেটাই চিন্তা করে দেখেননি আমাদের নীতিনির্ধারকররা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যগত জরুরি ব্যবস্থা ঘোষণা করে ৩০ জানুয়ারি, আর বাংলাদেশ সরকার সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে ১৬ এপ্রিল। মাঝখানের দীর্ঘ সময় অবশ্য আমরা বার বার শুনেছি, করোনাভাইরাস নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

মারী, মড়ক– এসবের সঙ্গে মানুষের পরিচয় আর বসবাস হয়তো মানুষের শুরু থেকেই; তাই ঘরান্তরীণের সঙ্গেও তার পরিচয় আদ্যিকালের। পৃথিবীতে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন থেকে অনেক শব্দ বা প্রত্যয়েরই বার বার মৃত্যু ঘটে, কিন্তু উপযুক্ত প্রতিবেশ-পরিস্থিতিতে সেটি ফের ফিরে আসে। যেমন এই ঘরান্তরীণ বা কোয়ারেন্টিন শব্দও ফিরে এসেছে নভেল কোভিড-১৯ আবির্ভূত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। মানুষকেই মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে– জীবনযাপনের এমন শর্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগেও অনেকবার গণহারে পূরণ করেছে মানুষ; কিন্তু এমন শর্তের কথা মাথায় রাখার পরও তেমন ভয়াবহ দুর্দিনেও মানুষকেই দাঁড়াতে দেখা গেলে অসুস্থ ব্যক্তির পাশে। এমন পরিস্থিতিতে যে ধরনের ঘটনা ঘটে, যা এবারও ঘটছে– যেমন, রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকার পরও প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে বৈতরণী পাড়ি দেয়ার চেষ্টা কিংবা এর বিপরীতের প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও ভীতির কারণে প্রিয়জনকে রাস্তায় কিংবা বনে ফেলে আসা, ক্ষুধার্ত মানুষকেই পুঁজি করে পুঁজি সঞ্চয়নের চেষ্টা করা– এ ধরনের সব ঘটনারই কোনো না কোনো সামাজিক কার্যকারণ ছিল, আছে। মানুষকে এরকম সর্বগ্রাসী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন সব পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যে, তার নিজেরই মনে হয়, ভবিষ্যতের দিনগুলোয় মানুষের সম্পর্ক অনেক মানবিক হবে; কিন্তু বাস্তবে সে দেখে, তোলপাড় করা সব পরিবর্তন ঘটলেও মানবিক সম্পর্ক বিকাশের দিক থেকে 'যাহা লাউ, তাহাই কদু' থেকে যায়। কোয়ারেন্টিন কিংবা যে প্রক্রিয়ায়ই হোক না কেন, মানুষ রক্ষা পায় বটে, কিন্তু মানবিক ক্ষতও থেকে যায়।

পিছু ফিরে তাকালে দেখা যায়, কোয়ারেন্টিন শব্দের মূল উৎস প্রাচীন ভেনিস প্রজাতন্ত্রের ভেনেসিয়ান ভাষার 'কোয়ারান্তিনা'– যার অর্থ ৪০ দিন। প্লেগ বা প্লেগজাতীয় রোগকে প্রতিরোধ করতে দূর অতীত থেকেই মানুষজন বিশেষত বিভিন্ন জাহাজযাত্রীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে অনুশীলন শুরু হয়েছিল, মধ্যযুগ পেরিয়ে এই আধুনিককালে এসে তা আন্তর্জাতিক নতুন আদল পেয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিকতার সেই ইতিহাস থাক– এককথায়, আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের চোখের সামনে করোনাভাইরাসের কারণে মানবজাতির ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা থেকে রক্ষা পেতে হলে এই ঘরান্তরীণ হওয়ার যে কোনো বিকল্প নেই, তা বোঝার জন্যে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

কিন্ত ঘরান্তরীণ হতে চাইলেই কি হওয়া সম্ভব, করতে চাইলেই কি করা সম্ভব–বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি জনবসতিপূর্ণ, একটি দরিদ্র দেশে? করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রস্তুতি কেমন ছিল, বাগাড়ম্বরতা কেমন ছিল, এখনই বা তা কেমন চলছে, সেসব প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, প্রথম করোনাআক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করার পর, এমনকি করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর ঘটনার পরও এমন সব ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গেছে, যেগুলো এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভয়ানক অদূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে। একদিকে অজ্ঞানতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতেও মুনাফার তীব্র লোভ বাংলাদেশের করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে খাদের কিনারে।

অজ্ঞানতা আছে, বিজ্ঞানমনস্কতা নেই– আমরা তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোবায়ের আহমেদ আনসারীর দাফনে এত জনসমাগম দেখি; কিন্তু এটাও তো চিন্তা করার ব্যাপার, জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার দিকে গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে রাষ্ট্র ও সরকার কী চেষ্টা চালিয়েছে। অগণতান্ত্রিক এমনকি বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশের সরকারেরও দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রবণতা হলো বিজ্ঞান, গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সেবাখাতগুলোর ওপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা– যাতে জনগণকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার চিন্তা দূরে থাক, বিজ্ঞানবিমুখ করে তোলার যে কি প্রাতিষ্ঠানিক কি অপ্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন বাংলাদেশ নামের এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বলতে গেলে শুরু থেকেই ছিল, তাতে মানুষ যে এখনও এ দেশে কখনও সংঘবদ্ধভাবে, কখনও সংঘবদ্ধতার তোয়াক্কা না করে মৌলবাদিতার বিরোধিতা করে– তাই তো অনেক। সেই যে একটা কথা আছে তলস্তয়ের, 'অশিক্ষিত জনগণ শাসকের শক্তি'– নিজেকে শক্তিশালী করে রাখতে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি দল আর প্রধান প্রধান বিরোধী দল বার বার পাল্লা দিয়েছে। তাই যে বিজ্ঞানমনস্কতা আমরা ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকেও দেখেছি, নব্বই থেকে তা যেন ফুরাতে শুরু করেছে। রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ এখন শুধু বিজ্ঞানমনস্কতার ওপরেই আস্থা হারায়নি, সরকারের ওপরেও আস্থা হারাচ্ছে– যদিও তা প্রকাশ করতে পারছে না ভয়ে। তার সমস্ত আস্থার স্থান এখন নিরেট পারলৌকিকতায় ঠাঁসা। স্বামী, সন্তান সবাই মিলে বয়সী এক নারীকে বনের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছে করোনাভাইরাসের ভয়ে– এ কি কেবলই মানুষ হিসেবে মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতা? যদিও ওই স্বামী, সন্তানের এই রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর, স্থানীয় সরকারের ওপর, পাড়াপ্রতিবেশির ওপর এই বিশ্বাস ও আস্থা থাকত যে, অসুস্থতার কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে, মানুষটিকে ঘরান্তরীণে রাখতে কোনো সমস্যা হবে না তাদের, তাহলে কি তারা পা বাড়াত বনের পথে? বিশ্বাসের ভাইরাস অনেককে ঠেলে দিয়েছে জনসমাবেশের দিকে–আবার এমনও তো দেখেছি আমরা, মুনাফার ভাইরাসে আক্রান্ত কারখানা মালিকরা অসহায় শ্রমিকদের বাধ্য করেছেন রাজধানীর দিকে ছুটে আসতে। ঘরান্তরীণ থাকা কি এতই সহজ এমন পরিস্থিতিতে?

এক বেসরকারি সংস্থা জরিপ করেছে কিছুদিন আগে, মানুষের কর্মসংস্থানগত আয় আর খাদ্য নিরাপত্তার ওপর এই মাত্র মার্চ মাসের মধ্যেই ভয়ানক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দারিদ্ররেখার নিচে এখন অবস্থান করছে ৮৯ শতাংশ মানুষ। আর ১৪ শতাংশ মানে দুই কোটি ৩৮ লাখ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই! বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র ৬০ শতাংশ বেড়েছে। করোনাভাইরাস বিস্তৃত হওয়ার পর এই জরিপে অংশগ্রহণকারী মানুষগুলোর পারিবারিক আয় কমে গেছে ৭৫ শতাংশের মতো। আগে যেখানে তাদের মাসিক গড় আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা, সেখানে মার্চ মাসে তাদের গড় আয় নেমে হয়েছে মাত্র তিন হাজার ৭৪২ টাকা। সরকারি ছুটি আর সামাজিক দূরত্বের কারণে হয় কাজ হারিয়েছেন না হয় খণ্ডকালীন কাজে কোনোমতে টিকে আছেন ৭২ শতাংশ মানুষ। রাজধানীর রাস্তা এখন একদমই জনহীন, কিন্তু জরুরি সার্ভিসে কর্মরত সবাই জানেন, রাস্তার ধারে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন দীনদরিদ্র অসহায় মানুষজন। খাবার যদি না থাকে, তাহলে কী করে ঘরে থাকবে ক্ষুধার্ত লোকজন? উশখুশ করা মধ্যবিত্তই যেখানে এটা-ওটা কেনার অজুহাতে ঘর থেকে বাইরে বেরুচ্ছেন সেখানে কর্মহীন, আয়হীন, সম্বলহীন মানুষজন পথে না নেমে থাকবেন কী করে?!

করোনাআক্রান্ত শহরাঞ্চলের পরিস্থিতি সকলেই দেখছেন, স্যাটেলাইট চ্যানেলের ক্যামেরা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে– কিন্তু অনেকটা নীরবেই ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে গ্রামাঞ্চলে। আর কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে বোরো ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে হাওরাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে একটু আগে বোরো ধান পাকে। কিন্তু শুধু হাওরাঞ্চলে নয়, সারাদেশেই সেচ দেওয়া ও তারপর ধানকাটাকে কেন্দ্র করে এ সময় মজুরদের চাহিদা বেড়ে যায়। একটু বাড়তি আয়ের আশায় প্রচুর দিনমজুর দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যান। কোয়ারেন্টিন কিংবা সামাজিক দূরত্বের প্রচার যতই চালানো হোক না কেন, কাজের প্রকৃতির কারণে ইতিমধ্যেই একজন মজুর আরেকজনের সামাজিক নৈকট্যে চলে আসতে শুরু করেছেন কোনো স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা ছাড়াই। উৎপাদক কৃষক তার পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না, অনাহারে থাকছেন– অজস্র ব্যক্তিগত মর্মান্তিক কাহিনী তৈরি হয়ে চলেছে খুব নীরবে।

মহামারীর সময় একটি এলাকা লকডাউন করার কিংবা মানুষজনকে ঘরান্তরীণে রাখার প্রধানতম লক্ষ্যই হলো, একজন নাগরিক নিজে সংক্রমিত হোন বা না হোন, অন্য কারও সংক্রমণের কারণ যেন না হন, সে জন্যে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। লেখাই বাহুল্য, এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকের ব্যক্তি অধিকারও অনেকাংশেই খর্ব হয়। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে তাকে তা মেনে নিতে হয়, তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো, রাষ্ট্র বা সরকার এ সময় তাকে সবরকম সেবা দিয়ে থাকেন, সর্বতোভাবে পাশে দাঁড়ান। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের জানাচ্ছে এ সময় তাকে খাদ্য পৌঁছে দেয়া হয়, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, ঘরের মধ্যেই তিনি কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবেন, তার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেসবের কিছু হচ্ছে না, বরং যা হয়েছে বা হচ্ছে তা অকল্পনীয় অমানবিকতা। সরকারি ছুটি দিয়ে অথচ লকডাউন ঘোষণা না করে এখানে নগরের অসংখ্য মানুষকে গ্রামের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই অসংখ্য মানুষদের বড় অংশটিই রাজধানীর সাধারণ দিন আনি দিন খাই গোত্রভুক্ত মানুষ। মোবাইল ফোন অপারেটরদের দেয়া তথ্যমতে, এই সময় ঢাকা ছেড়েছেন এক কোটি ১০ লাখ মোবাইল ব্যবহারকারী। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন চার লাখ ৮০ হাজার বিদেশফেরতা মানুষ। কিন্তু গার্মেন্টস কারখানা খোলার ঘোষণা দিয়ে গ্রাম ও মফস্বলে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে আবার রাজধানীমুখী করা হয়েছে। অনন্যোপায় মানুষ হাঁটতে হাঁটতে ঢাকামুখী হয়েছেন এবং তীব্র সমালোচনার মুখে যখন আবারও গার্মেন্টসগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে, তখন আবারও তারা গ্রামমুখী হয়েছেন কিংবা রাজধানীতে আটকা পড়ে আছেন কর্মহীন অবস্থাতে।

গ্রামাঞ্চলের এবং শহরাঞ্চলের এই মানুষদের যদি আমরা ঘরান্তরীণ রাখতে চাই, তাহলে তাদের নাগরিক সেবাগুলোও নিশ্চিত করতে হবে– বিশেষত ত্রাণের সুসমন্বিত, কার্যকর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এরকম ভয়ানক মৃত্যুমুখী সময়েও ত্রাণ নিয়ে লুটপাট থেমে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'আমি পেয়েছি চোরের খনি', ত্রাণচুরির যে চিত্র চারপাশে দেখা যাচ্ছে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও সেই একই কথা বলতে হবে।

ইতিমধ্যেই বহু ক্ষতি হয়ে গেছে, আরও অনেক ক্ষতি হওয়ার পথে; কিন্তু তারপরও এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণের একটি প্রধানতম পথই হলো মানুষকে ঘরান্তরীণ হওয়া। পেটে ভাত না থাকা মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারবে না, কিন্তু ঘরে যাতে থাকে সে ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সরকারকেই করতে হবে। রাষ্ট্র এবং সরকারও নিশ্চয়ই এ কাজটি একা-একা করতে পারবে না, কিন্তু সে জন্যে যে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন সেটিও তাকেই নিতে হবে। 'আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান, আমাদের সহযোগিতা করুন'– এমন আহ্বানের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার সময় সরকারের ফুরিয়ে গেছে। সরকার অবশ্য এর মধ্যে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, বিভিন্ন পরিসরে ত্রাণ দেয়াও শুরু হয়েছে– যদিও সেসবের সুফল কারা কতটুকু পাচ্ছেন বা পাবেন, তা চারপাশের চালচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চয়ই একটি বড় প্রশ্ন; এ-ও এক বড় প্রশ্নই বটে, যে দেশের জিডিপি প্রতি বছর হু হু করে বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে, সে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা এমন লেজেগোবরে কেন। কিন্তু এসব প্রশ্ন নিয়েও যেটি নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– সেটি হলো, মানুষকে ঘরান্তরীণ করা।

ঘরান্তরীণ বা কোয়ারেন্টিন যে এমন মহামারীর কালে কত কার্যকর, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদেরই কাছের দেশ ভিয়েতনাম। ২৩ জানুয়ারি সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম কারও করোনাআক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ করা হয়। ৬৬ বছর বয়সী এক ভিয়েতনামী চীনের উহান থেকে দেশে ফিরলে তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই রোধ প্রতিরোধের নীতিতে বিশ্বাসী ভিয়েতনাম ওই সময়েই সারাদেশ লকডাউন করে দেয়। এর ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে ধস নামে, পর্যটনশিল্প নির্ভর ভিয়েতনামের আগামী তিন মাসে নতুন করে আরও ক্ষতি হবে পাঁচ দশমিক নয় থেকে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু তাতে কী? ভিয়েতনাম পেরেছে করোনাআক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা মাত্র ২৪৯-এ সীমিত রাখতে। আরও আশাব্যঞ্জক ঘটনা হলো, সেখানে এখনও কারও মৃত্যু ঘটেনি। কারণ করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যাপারটি উপেক্ষা করা দূরে থাক, ভিয়েতনাম বরং তন্ন তন্ন করে সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা চালিয়েছে, এখনও চালাচ্ছে। ২ মার্চ একজন প্রভাবশালী ভিয়েতনামী নারী ব্যবসায়ী ইউরোপ থেকে ফিরে হ্যানয় বিমানবন্দরে নেমে কর্মকর্তাদের চোখ এড়িয়ে দেশের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই ঘটনার আগে ভিয়েতনামে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। বিমানবন্দরকে ফাঁকি দিতে পারলেও পরে এই ব্যবসায়ী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং পরীক্ষা করে দেখা যায়, তিনি করোনাআক্রান্ত। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, এই নারী ব্যবসায়ী যদি আইন অমান্য না করতেন, তা হলে দেশে করোনাআক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এত বাড়ত না। এই ঘটনার পর ভিয়েতনাম ওই বিমানের সব যাত্রীকে কোয়ারেন্টিনে নেয়, ওই ব্যবসায়ী যে পথ দিয়ে চলাচল করেছিলেন, যেসব স্থানে অবস্থান করেছিলেন, সেসব স্থানের সবাইকেও খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে নেয়। কিন্তু এরপরও করোনাআক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সেখানে ১৭ থেকে বেড়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ২৪৯-এ দাঁড়ায়। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় যোবায়েদ আহমেদ আনসারীর জানাযায় উপস্থিত করোনামনস্ক হাজার হাজার গুণগ্রাহী যে ইতিমধ্যে আমাদের জন্যে কী মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভিয়েতনামের এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। ভিয়েতনাম যে দরিদ্র মানুষদের জন্যে এটিএম বুথের মাধ্যমে ত্রাণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে, তাও একটি অনুকরণীয় উদাহরণ। এটি ঠিক, ইতিমধ্যেই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, আমাদের অনেকের মৃত্যু ঘটেছে, অনেকে মৃত্যুমুখী, অনেকের শরীরে করোনাভাইরাস সুপ্তাবস্থায় রয়েছে। আমরা এখন প্রবাসীদের দোষ দিচ্ছি, কিন্তু স্বীকার করছি না, আমরাও নাচতে নাচতে গিয়ে তাদের সঙ্গে বিরিয়ানী খেয়েছি। আমরা এখন শহরবাসী গ্রামীণ মানুষজনকে দোষ দিচ্ছি, কিন্তু স্বীকার করছি না, কর্মহীন অবস্থায় গ্রামে চলে যেতে, আবার পা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে শহরে ফিরতে আমরাই বাধ্য করেছি তাদের। আমরা এখন নিরাকার অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাসী জনগণকে দোষ দিচ্ছি, কিন্তু স্বীকার করছি না, তাদের অজ্ঞানতার মধ্যে রাখার যাবতীয় আয়োজন করে অসহায়ের মতো দৈবশক্তির কাছে হাত পাতার শিক্ষা আমরাই দিয়েছে। এমনকি নিজেদের সঙ্গেও প্রতারণা করে চলেছি আমরা– এই মধ্যবিত্তরা; করোনার উপসর্গ নিয়ে পরিবারের কেউ মারা যাওয়ার পরও ধামাচাপা দিয়ে সপরিবারে তাকে দাফন করার পর নিজেরাও পরদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলেছি।

কিন্তু, তবুও বলব, যদি সবাইকে ঘরান্তরীণ করা যায়, সব স্থানে লকডাউন করা যায়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির দিকে না তাকিয়ে ব্যাপক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপযোগী প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়ে জনগণকে আস্থাশীল করার আয়োজন করা যায়, তা হলে আমরা এখনও অনেক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারি। আমাদের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন; আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন। একটি থানায় একজন কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হলে সে থানাকে লকডাউন করতে হচ্ছে, সব পুলিশ সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে নিতে হচ্ছে; হাসপাতালের কোনো বিভাগে একজন ডাক্তার বা নার্স আক্রান্ত হলে সে বিভাগ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সতর্ক না হলে, কঠোরতার সঙ্গে ঘরান্তরীণ হওয়ার পথ বেছে না নিলে বিভিন্ন জরুরি সেবা পাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের কোনো প্রিয়জন যদি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হন, তাহলে তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্যে কাউকে খুঁজে পাব না, তাকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাব না; যদি তার মৃত্যু ঘটে, তা হলে তার মুখ দেখতে পারব না, তার কবরে মাটি দিতে পারব না, তার আত্মীয়স্বজনকে সান্ত্বনা দিতে যেতে পারব না এবং নিজেকেও হয়তো মরতে হবে এমনই নিঃসঙ্গভাবে। ভয়াবহ ওই ভবিষ্যতকে সরিয়ে দিতে হলে সবার আগে আমাদের ঘরান্তরীণ হতে হবে। বেছে নিতে হবে কোয়ারেন্টিনকে– এর কোনো বিকল্প আগেও ছিল না, এখনও নেই।