রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি: প্রসঙ্গ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা

মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান
Published : 10 Feb 2020, 10:10 AM
Updated : 10 Feb 2020, 10:10 AM

২০১২ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় চতুর্ভাগে, পিএইচডি শেষে দেশে ফিরেছি মাত্র। সুদূর ইউরোপ থেকে পিএইচডি করে আসা এবং বায়োলজি পড়ান এমন এক সহকারী অধ্যাপকের সাথে এক জঙ্গলের পাশে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। জঙ্গলের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আচমকা তিনি আমাকে এক প্রশ্ন করে বসলেন– এখানকার ফুড ওয়েভ (Food wave) সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? ভদ্রলোকের উচ্চারণ শুনে জিজ্ঞেস করলাম– ফুড ওয়েভ নাকি ফুড ওয়েব (food web)? তিনি এবার কিছুটা চটস্বরে বললেন– W-A-V-E- ওয়েভ। বললাম– ভাই, মাফ করবেন; বায়োলজি অনেক আগে পড়েছিলাম–তেমন একটা মনে নাই; এখন আমার পড়াশুনা পুরোটাই পরিবেশ অর্থনীতি নিয়ে। নিজেকে যারপরনাই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। তাঁর তাচ্ছিল্যের যন্ত্রণা কোনো রকমে চেপে রেখে প্রফেসর ড. গুগলের শরণাপন্ন হলাম। এই প্রফেসরও ফেইল মারলেন ; বললেন– "এমন কিছু তো খুঁজে পেলাম না"। তারপর আর এটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করিনি মানে, করার সাহস পাইনি। অর্থনীতিবিদের বায়োলজি অধ্যয়ন আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেবার চেয়েও গুরুতর অপরাধ! পরে জেনেছি এই ভদ্রলোকের স্পেশাল রেকমেন্ডেশন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি জোটে না–তাতে প্রার্থীর আর যত যোগ্যতাই থাকুক না কেন। প্রথমে এটা বিশ্বাস হয়নি–ভেবেছি নিন্দুকেরা মানির মান হরণে কত গল্পই তো ফাঁদে। এই বিস্ময় কাটতে অবশ্য বেশিদিন লাগেনি যখন দেখলাম তৎকালসন্ন প্রভাষক পদপ্রার্থীরা এই মহা-সহকারি অধ্যাপকের দরোজার সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তদবিরের জন্য– "স্যার, মাননীয় ভিসি স্যারকে যদি একবার একটু বলেন তাহলে আমার বেকার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর জন্য আমি বা আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর সবাই আপনার রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকব"। বলাবাহুল্য, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদপ্রার্থী হয়েছিলাম তখন একই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। পার্থক্য কেবল একটাই ছিল–যাদের তদবির চেয়েছিলাম তাঁরা সকলেই WAVE আর WEB এর পার্থক্য বুঝতেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

প্রভাষকগণ নিজের সকল মৌলিকত্ব রাজনৈতিক গঙ্গায় ধুয়েমুছে ছাফ করে, নাকে খৎ দিয়ে, তদবিরকারী শিক্ষকের রাজনৈতিক দলের সদস্য হন। একটু বলা নেয়া ভালো–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতি করতে পারেন না। তাতে কী! তারা নতুন গোত্রভুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ ও জয়বাংলায় বিশ্বাসী দল–নীল; আর জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দল–সাদা। নীলের সাথে যেমন ধর্মবিশ্বাসহীন ও সমাজতন্ত্রী একখানা অপভ্ৰংশ যুক্ত, ঠিক তেমনি সাদার সাথের অপভ্ৰংশ হলো অতিধার্মিক জামাতি গোষ্ঠী। মোদ্দাকথায়, তাঁরা বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন না, কিন্তু উক্ত দলগুলোর রাজনৈতিক ব্যক্তির চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। লেখাপড়া করুন বা না করুন, ক্লাস-পরীক্ষা নিন বা না নিন, গবেষণা করুন বা না করুন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তিতে তাঁরা একজন থেকে আর একজন এগিয়ে। ইনাদের লেজুড়সেবনের মাত্রা এমন একটা উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, ইনারা ট্রাকে চড়ে হাত-পা ছুড়ে "আমার ভাই-তোমার ভাই-অমুক ভাই-অমুক ভাই" বলে শহর প্রদক্ষিণ করেন অনেকটা নিয়ম করেই। একটা সময় ছিল দুই-একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে লোকজন বলতো– অমুক প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলও শিবির করে। এখন সেটার আরো উন্নত সংস্করণ বেরিয়েছে–শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাটি-পানি-বাতাস সবই এখন রাজনীতি বোঝে, রাজনীতি করে, রাজনীতি করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এই একটা কাজ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে করেছেন। সবখানে রাজনীতির এক সর্বনাশী মন্ত্রে সবাই মগ্ন। সরকারি চাকুরিজীবীর সকল স্তর অরাজনৈতিক রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত। অরাজনৈতিক এই জন্য বলছি যে কাগজপত্রে এদের রাজনীতি করা নিষেধ! আর রাজনৈতিক এজন্য বলছি যে বাস্তবিকতায় এদের সবাইকেই ক্ষমতাসীন রাজনীতির তাবেদার প্রমাণ করতে হয়। অন্যথায়, নিচের দিকে যারা আছেন তাদের পদোন্নতি বা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আটকে যায়, আর যারা পদ-শৃঙ্খলের মগডালে অবস্থান করছেন তাদেরকে ওএসডি নামক কর্মহীন কিন্তু বেতনভুক্ত প্রাণীতে পরিণত হতে হয়। কোনো কাজকর্ম ছাড়া বেতন–এমন আরাম পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নাই। আগে স্থানীয় সরকারগুলো এমন ছিল–অরাজনৈতিক রাজনৈতিক। কিন্তু চেয়াম্যান-মেম্বার-মেয়র সাবদের রাজনৈতিক তাবেদারী এতটাই নগ্ন ছিল যে নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নৌকা আর ধানের শীষ মার্কায় চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়েছে। আমার মতে এটা চমৎকার একটা কাজ হয়েছে। চুরি-চামারি বা ছলচাতুরি করা মোটেও সজ্জনের কাজ নয়। সেই নিরিখে অন্যান্য সরকারি বেতনভুক্ত লোকজনকেও এই মার্কা প্রকাশ্যে দেয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক তোষণের যে মাত্রা তাতে এই মার্কা তাঁদের জন্য আরো বেশি দরকার। তাহলে তাঁরা রাজনীতিদুষ্ট বলে নিন্দুকেরা যে বদনাম ছড়ায় সেটা থেকে তাঁদের নিস্তার মিলত।

যেহেতু আমি বিশ্বিদ্যালয়ে চাকরি করি (অধ্যাপনার যে ভারিত্ব তা আমি কখনোই অর্জন করতে পারিনি, তাই নিজেকে কখনোই তা মনে করতে পারিনি; এখনো করি না), সেহেতু স্বজাতির গুণকীর্তন কিছুটা না করলে মানসিক অশান্তি হয়। ফিরে আসি প্রভাষক প্রসঙ্গে–তাঁদের রাজনৈতিক দীক্ষা বিষয়ে। অল্প কিছু লোম-খাড়া হওয়া ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা প্রার্থীরাই প্রভাষক হন। অনেকেই আমার এই দাবিকে খাপছাড়া বলতে পারেন এই বলে যে একটু আগেই আমি বলেছি রাজনৈতিক তল্পিবাহকতা ছাড়া প্রভাষক পদ পাওয়া সম্ভব নয়। যারা এদুটো মেলাতো হিমশিম খাবেন তাদের জন্য বলছি–এই প্রভাষক প্রার্থীগণের কমপক্ষে ৯০ শতাংশেরই প্রভাষক হবার পূর্বে কোনো ধরণের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তারা রাজনৈতিক তল্পিবাহক হবার এবং নেতা বানাবার জন্য ভোট দেবার অঙ্গীকার করার পরেই তাদেরকে প্রভাষক পদে জয়যুক্ত করা হয়। প্রভাষক পদের জন্য ভিসি মহোদয়ের খাস কামরায় উপস্থিত হবার আগেই এই রাজনৈতিক শপথ সম্পন্ন হয়। এই শপথ নেয়া সদ্যপ্রসূত প্রভাষকদের মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়– (১) সবচেয়ে বড় ভাগটি মনে করে, চাকরি পেয়ে গেলেই হলো, কি আসে যায় কোন দলকে আমি সমর্থন দিলাম, (২) দ্বিতীয়-বৃহত্তম ভাগটি মনে করে, অমুক স্যারের কৃপায় আমার বেকারজীবনের সমাপ্তি হলো, সুতরাং তাঁর কথাই রামায়ণ, (৩) আর সর্বকনিষ্ঠ ভাগটি এক্কেবারে সাঁচ্চাদিলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক আদর্শের ধারকবাহক। তৃতীয় জাতের এই দলটি পরবর্তীতে প্রক্টর-প্রভোস্ট-ডিন-ভিসি ইত্যাদি হন।

যাইহোক, এই নিরীহ ও এযাবৎ-জীবনে অরাজনৈতিক যুবা তখনও জানে না সে হাত-পা বাঁধা এক মুক জীবনের অপেক্ষায়। হতে হবে সহকারী অধ্যাপক, তারপর সহযোগী অধ্যাপক, তারও পর আস্ত অধ্যাপক। এতগুলো ধাপ পেরোনো যে কতখানি মৌলিকত্ব-ত্যাগের ব্যাপার তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির চমৎকার নিয়ম রয়েছে–কাজের অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা, দেশি-বিদেশী ডিগ্রি। কিন্তু কোথাও লেখা নাই মুক্তিযুদ্ধের অক্ষশক্তি বা জাতীয়তাবাদী প্রেম বা জামাতি বদান্যতা পদোন্নতির জন্য আদৌ দরকার। বাস্তবতা হলো, কাগজে লেখা নিয়মাবলী হচ্ছে প্রয়োজনীয় শর্ত (Necessary Conditions) আর আর রাজনৈতিক তল্পিবহন হচ্ছে পর্যাপ্ত শর্ত (Sufficient Conditions)। প্রভাষকগণ আবার ছোটা শুরু করেন এই রাজপ্রেমিকদের দরজায়-দরজায়। তাঁদের গ্রিন সিগন্যাল না পেলে ভিসি মহোদয় প্রোমোশনের দিন-তারিখ ঠিক করতে পারেন না। সম্পন্ন হয় আর একদফা রাজনৈতিক তল্পিবাহকতার শপথ আর যোগ্যতা প্রমাণে ভিসির খাসকামরায় পরীক্ষার প্রহসন। সব ঠিকঠাক থাকলে প্রভাষকগণ এক বছরের মাথায় (কারো কারো ক্ষেত্রে তিন বছর বা তারও বেশি) বনে যান সহকারী অধ্যাপক। চাকরির এই সময়টাতে এই নতুন সহকারী অধ্যাপকের লেখাপড়ার কী উন্নতি হয় জানি না, তবে রাজনৈতিক উন্নতি অবধারিত; আমরটা বলতে পারি–কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া আমার ইন্টেলেক্চুয়াল কোনো উন্নতি হয়নি। ২০০৬ সালের কথা,  একবার এক সহকারী অধ্যাপকের সাথে শিক্ষক বাসে বসে কথা হচ্ছিলো–আমার বন্ধু মানুষ। তিনি ভিজিটিং কার্ড বানাবেন। আমাকে বললেন– দোস্ত, দেখ তো, কার্ডের ভাষা ঠিক আছে কিনা। দেখলাম তিনি নামের পরেই পদবি লিখছেন Ass Professor, মানে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। মন্তব্য করার দুঃসাহস না দেখিয়ে বললাম– দোস্ত, আমি ইংরেজিতে কাঁচা, তুমি ইংরেজি বিভাগের কাউকে দেখাও। তখন অবশ্য আমি Ass মানে জানতাম গাধা, পরে পশ্চিমা দুনিয়ায় পিএইচডি করতে এসে জানলাম এটার আরো বিশেষ অর্থ আছে–সেটা আজ নাইবা বললাম। একটা বিষয় বলার লোভ সামলাতে পারছি না–শিক্ষক বাস হলো আমার শিক্ষকজীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এটাতে চড়ে একঘুমে অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে যাওয়া যেত। ট্রাফিক-জ্যামের যে কত উপকারিতা সেটা শিক্ষকবাসে ঘুম দেবার সময়ে সবচেয়ে ভালো বুঝতাম–২০ কি.মি. এর মতো রাস্তা–নিদেনপক্ষে ২ ঘন্টা। অবশ্য কোনো কোনোদিন আমার কাঙ্খিত জ্যাম না থাকলে বিপদ হতো–শেষ স্টেশনে গাড়ির হেল্পার ডাক দিতেন– স্যার, গাড়ি তো আর যাবে না। তখন পকেটের বারোটা বাজিয়ে সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে উল্টোদিকে বাসায় রওনা হতাম।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাজীবনে সবচেয়ে কষ্টকর ধাপ সহকারী অধ্যাপকের। কাজের লম্বা অভিজ্ঞতা, পিএইচডি ডিগ্রি বা বিদেশি মাস্টার্স ডিগ্রি, গোটাকয়েক প্রকাশনা ছাড়া এই ধাপ পেরিয়ে সহযোগী অধ্যাপক হওয়া অত্যন্ত দুরূহ। সহকারী অধ্যাপকদের একটা বড় অংশ বিদেশে থেকে ৪-৫ বছর পড়াশুনা করে একখানা পিএইচডি নিয়ে দেশে ফেরেন। কত যে তপস্যার এই ৪-৫ বছর ! ঘুম-যম-পরিবার কোনো কিছুরই খবর থাকে না–শুধু পড়াশুনা আর গবেষণা। অবশ্য দেশে যারা পিএইচডি করেন তাদের কথা আমার খুব একটা জানা নাই। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপক একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরে একখানা পিএইচডি সম্পন্ন করে এখন প্রক্টরগিরি করছেন। ওনার মতো লোকের ট্যালেন্ট নিয়ে মন্তব্য করার দুঃসাহস আমার নাই। ফিরে যাই ২০১২-তে। আমিও বিদেশ থেকে ফিরে এই ধাপ পেরোনোর চেষ্টা করছিলাম। পদোন্নতির দরখাস্ত জমা দিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করলাম–আর তো কয়েকটা দিন তারপরই সহযোগী অধ্যাপক। একমাস-দুমাস-একবছর গেল, পদোন্নতি দেখি না। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম আমার মতো অনেকেরই একই অবস্থা। মনকে বুঝলাম–এটাই মনে হয় নিয়ম। কিন্তু যেটা জেনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লাম তা হলো–আমার অনেক পরে দরখাস্ত করা লোকজনের অনেকেরই পদোন্নতি হয়েছে। আমারটা কেন আটকে গেল? কারণ, আমি যাদের তোষামোদি করে প্রভাষক-সহকারী অধ্যাপক হয়েছিলাম তাদের রাজনৈতিক পীরেরা এখন আর রাষ্ট্রযন্ত্র চালান না; অন্যদল এসেছে সেখানে। একটা রাজনৈতিক গড়ানি দিতে পারলে অবশ্য কাজ হয়ে যেত। যাইহোক, কি এক রহম হলো প্রশাসনের–দরখাস্তের ১৮ মাস পর আমার ডাক পড়লো; ভাইবা নামক এক প্রহসন। পেরোলামও। হয়ে গেলাম সহযোগী অধ্যাপক। একটু না বলে পারছি না–রাজনৈতিক ধামাধরা অনেক সহকারী অধ্যাপক দরখাস্ত জমা করার ৬-৭ দিনের মাথায় সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন এমন নজির ডজন ডজন। যারা এই ১৮ মাসের ধকল নিতে পারেন না তাঁদের মধ্যে কয়েকটা উপসর্গ পরিষ্কার হয়। কেউ কেউ রাজনৈতিক গড়ানি দেন, কেউ কেউ কাজকর্মের উৎসাহ হারান, আর কেউ কেউ অন্যদেশে পাড়ি জমান। খুব সহজেই অনুমেয়, তৃতীয় এই দলটি সবচেয়ে মেধাবী। সবাই চাইলেই বিদেশে গিয়ে রুটিরুজি জোগাড় করতে পারেন না; এঁরা পারেন। এভাবেই রাজনীতি একটা জাতিকে ক্রমাগত মেধাশূন্য করে দিচ্ছে। অবশ্য, এটা যে রাজনীতিকরা জানে না তা নয়। তারা জেনেই এটা করছেন। এই দেশত্যাগী দলটিকে দিয়ে ধামাধরানো মুশকিল; তাঁদের প্রস্থানই কাম্য।

এত ছাকুনির পর যারা আস্ত-অধ্যাপক হবার জন্য রেডি হন, তারা এতদিনে পুরোদোস্তুর রাজনীতিক। কেউ এ দলের কেউ সে দলের; সবাই দলের। ডিগ্রির বালাই তো আর নাই; কয়েকটা প্রকাশনা হলেই অধ্যাপক। হাতেগোনা কয়েকজন লোক ছাড়া সব্বাই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ভুলে ভরা জার্নালে তাঁদের লেখা ছাপান। ফলে অধ্যাপক হতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। অধ্যাপক হবার পর কি? আমার বিভাগের এক সিনিয়র অধ্যাপককে বলতে শুনেছি–আর তো প্রমোশন নাই। সুতরাং গবেষণা নামক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে ঘোরার মানে হয় না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, শিক্ষক লাউঞ্জে বসে চা-টা খান, তারপর গপসপ করে বিকালে বাসায় ফেরেন। বলাবাহুল্য,সবাই এমন না, কিন্তু অনেকেই এমন। পাঠকগণ হয়তো ভাবছেন–আমি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বলতে কিছুই দেখিনি? হ্যাঁ, দেখেছি, ভালোটাই বেশি দেখেছি। আর সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক দৃশ্য হওয়া উচিত বলেই সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করার মানে খুঁজি না। অস্বাভাবিকতাটাই তাই আলোচ্য। এমন অনেক শিক্ষকে দেখেছি, যাঁদেরকে জীবনভরে দেখতে ইচ্ছে করে, যাঁদের জন্য সম্মানটা ভিতর থেকে আসে, যাঁদের জন্য গর্ববোধ করি যে আমিও তাদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যাঁরা তাঁদের সবারই তো এমন হবার কথা ছিল। এঁদের সভ্যতা, জ্ঞান, গবেষণা নিয়ে আলাদা করে কেন লিখতে হবে? অধ্যাপক মানেই তো এইসব গুণের সম্মিলন। বিশ্ববিদ্যালয় নামক মহাস্থানে এসকল মাহাত্বের ব্যত্যয় তৈরি করে এমন একজনও কাম্য নয়। অথচ এই ব্যত্যয়ী রাজনৈতিক ধামাধরাদের সংখ্যা বাড়ছেই, আর কমে যাচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানতাপসদের সংখ্যা। এটা নিয়ে আমাদের সবারই শংকিত হওয়া উচিত, তাই নয় কি?