আলিফ লাইলা-১৬: র‌্যাংকিং-এর মরীচিকা

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 Dec 2019, 09:01 AM
Updated : 8 Dec 2019, 09:01 AM

[পূর্বকথা: তথাকথিত চরিত্রহীনা স্ত্রীর পরকীয়ার যারপরনাই নারাজ হয়ে হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতলের আদেশ দেবেন। কয়েক বৎসরে শত শত যুবতী বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি করুণাপরবশ হয়ে বোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে নিজে থেকেই বাদশা শাহরিয়ারকে নিকাহ করেন। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় সুর্দশনা শ্যালিকা দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দিনারজাদি শেহরেজাদিকে এক সওয়াল পুছেন: 'দিদি, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান কেন হয় না?' শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না করে একের পর এক, র‌্যাংকিং থেকে ঢাবির ছিঁটকে পড়ার কারণগুলো বাৎলাতে শুরু করে দেন। কিন্তু ভোরের আজান হওয়া মাত্র জওয়াব বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। বাদশাহ যেহেতু বাকি কারণগুলো জানতে আগ্রহী, সেহেতু দিনের পর দিন মৃত্যুদণ্ড বাতিল হতে থাকে শেহেরজাদির। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের ষোড়শ রাত্রি]

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু যখন থেকে সেই মধ্যযুগেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অন্যতম ভূমিকা পালন করতো সিনেট আর সিন্ডিকেট– এই দুটি সংগঠন। সিনেট হচ্ছে সর্বোচ্চ সংগঠন যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ বলা যেতে পারে। দিদি শেহেরজাদি, এই সংসদ যদি ঠিকঠাকমতো কার্যকর হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ারতো কোনো কারণ নেই।

হ্যাঁ দিনারজাদি! পৃথিবীর অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের কমবেশি ১০০ জন সদস্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি: ৫ জন সরকারি কর্মকর্তা, ৫ জন সংসদ সদস্য, আচার্য বা রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি ৫ জন শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেটের ৫ জন প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত কলেজের ৫ জন অধ্যক্ষ, ১০ জন কলেজ শিক্ষক, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি, ৩৫ জন রেজিষ্টার্ড স্নাতক, ২৫ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের র‌্যাংকভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিচিত্র পেশার লোকজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেটে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করে থাকেন, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই বিকাশ ও উন্নয়ন হয়।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের সিংহভাগ সদস্যই যেহেতু একই মত ও পথের পথিক অর্থাৎ সরকারি দলের হয়ে থাকেন, সেহেতু তারা সবাই এক সুরেই কথা বলেন। 'একতাই বল!' কথাটা ভুল উচ্চারণে 'এ কথাই বলো!' শোনা যেতেই পারে। 'সব শিয়ালের এক রা' শিবাজাতির মতৈক্যের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে, কিন্তু মানুষ শিয়াল নয় এবং ভিন্নমত চর্চা না হওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো বিচারেই মঙ্গলজনক নয়, সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের জন্যে সুবিধাজনক হলেও হতে পারে।

সিনেটের অধিবেশনে স্থির হয়, ভিসি পদে মনোনয়নের জন্যে কোন তিনজন ব্যক্তির নাম যাবে। পদস্থ ভিসি বছরে একবার সিনেট অধিবেশন আহ্বান করবেন, কিন্তু না করলেও তাঁকে বাধ্য করা যাবে না, কারণ যে ইংরেজি ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়েছে অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারায়, সেটি shall, খেয়াল করুন, will বা must নয়: The Senate shall, on a date to be fixed by the Vice-Chancellor, meet once in a year at a meeting to be called the annual meeting of the Senate। আইনের ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে এর মানে দাঁড়াতে পারে, অধিবেশন আহ্বান করা 'উচিত', কিন্তু 'ঔচিত্য'-কে কোনো বিচারেই 'বাধ্যবাধকতা' বলা যাবে না। কয়েক শ বছর আগের সমাজে হয়তো 'উচিত' শব্দের অর্থ ছিল 'অবশ্য করণীয়', কিন্তু সেই সমাজও নেই, শব্দের সেই অর্থও অটুট নেই। কথার ইদৃশ মারপ্যাঁচের সুযোগ নিয়ে উপাচার্য নিজের সুবিধামতো অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন, খোয়ায়েশ হলে নাও করতে পারেন।

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দিনারজাদি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য চার বছর অধিবেশন আহ্বান না করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন, চার বছর নির্বাচিত ছিলেন, আরও চার বছর থাকার ফন্দি করেছিলেন। আগের হাল যেভাবে যায়, পিছের হালও হয়তো সেভাবেই যাচ্ছে, সরকারের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনেই হয়তো বা। মজলিশে সুরার সদস্যরা মামলা করে প্রাক্তন উপাচার্যকে অ-পদস্থ করেছিলেন। এখন তেনারা চুপ, কারণ তেনারা এখন নিজেদের ক্ষমতাসীন ভাবছেন। ক্ষমতার মধু খেতে মশগুল মৌমাছি কেন খামাখা গুঞ্জন করবে? এভাবে মনুষ্যসৃষ্ট, স্বার্থদুষ্ট এবং অবশ্যই সরকারের সমর্থনপুষ্ট বহু বিচিত্র কারণে সিনেট-সিন্ডিকেট-একাডেমিক কাউন্সিল… বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে যায়, যাচ্ছে। বিশেষ করে সিনেট যখন অকার্যকর, তখন বিশ্ববিদালয় পরিচালনা হয়ে যায় অনেকটা 'নিজেরা করি' কিংবা 'কাবিখা' (কাজের বিনিময়ে খাদ্য)-এর মতো কোনো কাটিং-মারিং প্রকল্প। নিজেরা কিছুই করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকৃতপক্ষে 'খাবি খায়'। খাবি খাওয়া লোক জল থেকে পুকুর বা নদীর পাড়েই উঠতে পারে না, র‌্যাংকে কীভাবে উঠবে? অকার্যকর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ র‌্যাংকিং-এ স্থান না হবার ঊনত্রিশতম কারণ।

যে সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার কথা, সেই সিনেট, সিন্ডিকেটে যদি শুধু এক দল, এক মতের লোক থাকে তবে সেই সব সংগঠন কার্যকর থাকে না, আগেই বলেছি তোমাকে দিনারজাদি। কিন্তু এটাই একমাত্র খারাপ খবর নয়। স্ট্যাটিউট-সম্মত এই সংগঠনগুলোকে অকার্যকর করে এমন আর দুইটি সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউটে যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। এর একটি হলো ডিনস কমিটি এবং অন্যটি প্রভোস্ট কমিটি। প্রায় এক দশক যাবৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই দুই ভুঁইফোর কমিটিতে। ইনস্টিটিউটগুলো অনুষদের অধীনে নয়, কিন্তু সেই ইনস্টিটিউটের ব্যাপারেও বিবিধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ডিনস কমিটিতে। বিনীত প্রশ্ন হচ্ছে, বেআইনী কোনো কমিটিতে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত কি আইনসম্মত হতে পারে? জেনেশুনে আর কত বিষ পান করে যাবো আমরা? গায়ের জোরে স্বেচ্ছাচারিতা ও আইনকে বৃদ্ধাগুলি দেখানো র‌্যাংকিং থেকে বাদ পড়ার ত্রিংশতিতম কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ স্থান না পাবার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও অনেকটা দায় আছে বৈকি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কি হচ্ছে না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকঠাকমতো চলছে কিনা এগুলো দেখা কি এই সংস্থাটির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? কতজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কতজন শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারি প্রয়োজন এবং সেই সংখ্যক কর্মকর্তা শিক্ষক আছে কিনা, এসব দেখাও কমিশনের দায়িত্ব। মঞ্জুরি কমিশনের কোনো সভাপতি কি কখনও ভেবেছেন, কেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বর‌্যাংকিং-এ স্থান পায় না এবং এই সমস্যা সমাধানে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। শুধু 'কাট এন্ড পেস্ট' করে (প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মান্নান এই দাবি করেছেন তার একটি বক্তৃতায়) একের পর এক সমাবর্তন বক্তৃতা দিয়ে গেলেই কি যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায়? মঞ্জুরি কমিশনে অদক্ষতা ও অমনোযোগ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিং-এ স্থান না পাবার একত্রিংশতম কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা-গ্রহণ ও ফল প্রদান প্রক্রিয়ার মতো জটিল প্রক্রিয়া এশিয়া, ইওরোপ ও আমেরিকা- এই তিন মহাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। পরীক্ষাগ্রহণ থেকে শুরু করে ফলপ্রদান পর্যন্ত যতগুলো পর্যায় আছে, ধানচাষেও সম্ভবত অতগুলো পর্যায় নেই। এই পদ্ধতি অনর্থক জটিল এবং একে সরলতর করার চিন্তাও কেউ করে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে (এবং নিজেকেও) আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে পারে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা র‌্যাংকিং থেকে বাদ পড়ার দ্বাত্রিংশতিতম কারণ।

নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে দিনারজাদি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত প্রভাষকদের প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টিছাড়া নিয়োগরীতির কারণে। অনেক প্রভাষকই জানেন না, কীভাবে খাতা দেখতে হয় কিংবা নম্বর দিতে হয়। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ব্যক্তি এসব কাজ আগে শিখে তারপর শিক্ষক হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব কর্মকতা নিয়োগ পান তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এদের মধ্যে অনেকে জানেন না, কীভাবে মাউস ঘোরাতে হয়, কীভাবে একটা ফাইল বা ফোল্ডার খুলতে হয় কমপিউটারে। কুড়ি বছর সার্ভিস দিয়েও এদের অনেকে কার্যত 'ক্যাডার' হয়ে উঠতে পারেন না। '৭৩-এর অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারা-উপধারা কর্মকর্তাদের নখদর্পণে থাকা দরকার, যাতে শিক্ষক নেতারা সেগুলোর ব্যত্যয় ঘটাতে গেলে তারা অন্ততপক্ষে পূজ্যপাদ শিক্ষককে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন: 'ষাঁড়! স্ট্যাটিউটে কিন্তু অন্যরকম লেখা আছে!' অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিলেই বা কী! ক্ষমতান্ধ ষাঁড় কি পারতপক্ষে আইন বা সাবধানবাণীর তোয়াক্কা করে?

গাড়িকে সঠিক পথে চালাতে পারেন যে চালক, তার যদি স্বাধীনতা না থাকে, দূরে কোথাও যাবার স্বপ্ন যদি না থাকে, তবে গাড়ি এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাবে। বাংলাদেশ শুধু নয়, উপমহাদেশের সর্বত্র যোগ্যতা নয়, আনুগত্যের অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়ার অপপ্রথা চালু হয়ে গেছে। বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী থাকে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিপুল সংখ্যক তরুণ জনতা চাইলে কী অঘটন না ঘটাতে পারে। সরকার কেন চাইবে, নতজানু নয় এমন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভয়ঙ্কর একটি যন্ত্রের চালকের আসনে বসুক? যদি সেই ব্যক্তিটি কথা না শুনে, যদি বিগড়ে যায়, তাহলেতো সমূহ বিপদ। চট্টগ্রামের ভাষায় যেমন বলে, 'হাতে ধরে সরকার কেন বাতের বড়ি খেতে' যাবে।

যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে বদলানোর ক্ষমতা রাখেন, তাদের হয়তো উপাচার্য হওয়ার রূচি বা আগ্রহ নেই, কিংবা আগ্রহ থাকলেও তারা হয়তো ক্ষমতার পছন্দের লোক নন। ক্ষমতার পছন্দের লোক যারা, তাদের হয়তো ভিশন নেই। ভিশন থাক বা না থাক, উপাচার্য হওয়াটা একজন শিক্ষকের জন্যে সারা জীবনের ভীষণ এক মিশন। কত শত নির্বাচনের বৈতরণী কত কষ্টে পার হয়ে, কত কত সহকর্মীকে কঠিন ল্যাং মেরে কাত করে ফেলে, জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে এই বহু প্রত্যাশিত পদটি পেয়ে নিজের বউয়ের সামনে এসে তারা বড় মুখ করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান বউয়ের আদরভরা মুচকিয়া হাসিটি কিংবা (ভাগ্য-শরীর-মন ভালো থাকলে) থোবরিয়া গালে শুষ্ক চুম্বনটির আশায়। লেখাপড়া, গবেষণা করা আর নির্বাচন করে জিতে আসার যোগ্যতা ভিন্ন। মহাপণ্ডিত হলেই মহান নেতা হওয়া যায় না। যাদের ভিশন আছে, যারা ভালো লেখাপড়া জানেন, তাদের যদি নেতা কিংবা উপাচার্য হবার মিশন না থাকে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ভোটার হ্যান্ডেল করার মতো বিরক্তিকর কাজ করার ধৈর্য-স্থৈর্য যদি তাদের না থাকে, তবে তাদের সেই ঘাটতির দায়তো সরকারের নয়।

সুতরাং অমুক ভিসির নিয়োগ সঠিক হয় নাই, তমুক ভিসি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারে না, ফলনা ভিসি কোনো গবেষণা করে নাই, তলনা ভিসি লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে… এসব নাই দুনিয়ার বাহুল্য প্যাঁচাল পেড়ে কোনো লাভ নাই। সরকার ফলনাকে নিয়োগ দিয়েছে, ফলনার চেয়ে যোগ্যতর কাউকে পায়নি বলে বাধ্য হয়েই দিয়েছে, বাধ্য না হলে কখনও দিত না, নিশ্চিত জানবেন। দয়া করে কেউ কাউকে পদ দেয় না, বাধ্য হয়ে দেয়। জীবনানন্দ জীবিত থাকলে বলতেন: 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে ভুল চাল দিতে ভালোবাসে!'

চির নতজানু দাসানুদাস যে নয়, সরকার তেমন ব্যক্তিকে কেন উপাচার্য নিয়োগ দেবে? না দিক, কিন্তু সেক্ষেত্রে র‌্যাংকিং-এর স্বপ্ন বাদ দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের 'বিদায় অভিশাপ' কবিতায় দেবগুরু বৃহস্পতিপুত্র কচের প্রতি দৈত্যগুরু শুক্রের কন্যা দেবযানীর অভিশাপ: (এই বিদ্যা) 'শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ!' একইভাবে, এই পরিবেশে পরীক্ষা হবে, ডিগ্রি হবে, কিন্তু লেখাপড়া হবে না। লেখাপড়া না হলে, গবেষণা হবে না, গবেষণা না হলে গড়ে তোলা যাবে না জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, সফল হবে না কোনোদিন সোনার বাংলার স্বপ্ন। দেশের কথা না ভেবে শুধু ক্ষমতায় থাকার চিন্তা একটি পাপ এবং সেই পাপের শাস্তিতো পেতেই হবে কাউকে না কাউকে, হয় সরকারকে, নয় জাতিকে। সরকারকে বেছে নিতে হবে, সে কি শুধু ক্ষমতাই আঁকড়ে থাকতে চায়, নাকি টেকসই উন্নয়নও তার লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কি আসলেই সরকারের লক্ষ্য, নাকি এগুলো নিছকই 'আয় আয় চাঁদমামা, টিপস দিয়ে যা!' জাতীয় ছেলেভুলানো ছড়া? যে উপাচার্য লেখাপড়া করে না, তার ভিশন থাকবে কী করে? লেখাপড়া যে করে, তার দলবাজি করার অবসর থাকার কথা নয়। যে দলবাজি করে না, তার পক্ষে উপাচার্য হওয়া অসম্ভব। হিসাব অতি সোজা। উপাচার্য ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে সঠিক ব্যক্তি আসীন না হওয়া র‌্যাংকিং থেকে বাদ পড়ার ত্রয়োত্রিংশতম কারণ।

দিনারজাদি! বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো সমস্যা উপাচার্য সমাধান করতে পারলেন, তার কোনো দাম না আছে সরকারের কাছে, না আছে শিক্ষক-ভোটারদের কাছে। তিনি কতটা লেখাপড়া জানেন, তাতে কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সরকার জানতে আগ্রহী, হবু উপাচার্য কোন জেলার লোক এবং সেই জেলার কতজন শিক্ষক তার পেছনে আছে। পেছন থেকে কতটা কলকাঠি তিনি নাড়তে পারেন, কত নিখুঁতভাবে তিনি প্রতিযোগীকে ল্যাং মেরে কাত করে ফেলে একবারও পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। তুমি উপাচার্য হতে গেলে কিংবা হয়ে গেলে, তোমার নিজের জেলার লোকেরা তোমাকে সমর্থন দেবে, কারণ তুমি পদস্থ হলে তোমাকে ব্যবহার করে কলাটা, মুলোটা অর্থাৎ শালার চাকরি, ভাইয়ের পদোন্নতি ইত্যাকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুযোগ-সুবিধা পাবার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের। 'নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়মিত প্রকাশনা, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা' মূলত কর্তাবার্তা। মধ্যযুগের ভক্তিসাহিত্যে কানু বিনা যেমন গীত নাই, তেমনি ঢাবিবার্তায় কর্তার ছবি ছাড়া একটিও বার্তা নাই। সরকার বা জনগণের টাকায় মুফতে আত্মপ্রচার। এটা ব্যক্তিবিশেষের দোষ নয়, নতুন কিছুও নয়, এভাবেই চলে আসছে কর্তা-পরম্পরায়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকে আসে তাদেরও বিশ্ববিদ্যালয়-বার্তা জাতীয় প্রকাশনা দেখেছি, কিন্তু সেই প্রকাশনায় কর্তার ছবি ছিল না বললেই চলে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তাকে কেউ চেনেই না। র‌্যাংকে আসার স্বপ্ন থাকলে স্বচিত্র-প্রদর্শনের নাদানপনা ও কর্তাভজার রাশ টানতে হবে, কারণ এগুলো সুরূচির লক্ষণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সুরুচির অভাব র‌্যাংকিং থেকে বাদ পড়ার চতুর্ত্রিংশতম কারণ।

প্রিয় দিনারজাদি! ঠিকঠাকমতো উপাচার্য নিয়োগ না হবার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকঠাকমতো চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও ঠিকঠাকমতো নিজের কর্তব্য পালন করতে না পারার কারণ সম্ভবত এর সভাপতির বয়স। একজন অবসরপ্রাপ্ত, বয়োবৃদ্ধ শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ ব্যক্তির কর্মস্পৃহা ও কর্মক্ষমতা একটা বিশেষ বয়সের পর থাকতে পারে না বিবেচনা করে যে রাষ্ট্র নিজেই কোনো ব্যক্তিকে অবসর দিয়েছেন, সেই একই রাষ্ট্র কীভাবে উচ্চতর এবং পূর্ণকালীন দায়িত্ব-সম্পন্ন একটি পদে সেই একই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়? এটা কি দৃশ্যত ও কার্যত স্ববিরোধীতা নয়? তুমিই বলো দিনারজাদি!

[বাদশা এবং দিনারজাদি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন। ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলো এবং ভোরের আযানও শোনা গেল। শেহেরজাদি পূর্বরাত্রির মতোই কথা থামিয়ে দিলেন। ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন দুই বোন। বাদশা শাহরিয়ারও ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেলেন। যেসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে র‌্যাংকিং 'তৃষ্ণার্ত মৃগের চোখে মরীচিকা'-র মতো হয়ে থাকবে, তার মধ্যে চৌত্রিশটি মাত্র জানা হয়েছে। বাকি সব কারণ জানার আগ্রহ ছিল বলে বাদশাহ শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড পরের দিন সকাল পর্যন্ত স্থগিত করলেন।]