প্রতিবন্ধী মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন

Published : 25 Nov 2019, 11:11 AM
Updated : 25 Nov 2019, 11:11 AM

২০১১ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে বিভিন্ন কারণে। তার মধ্যে দারিদ্র, দুর্ঘটনা, বয়স, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং যুদ্ধ অন্যতম। প্রতিবন্ধী মানুষের একটা বড় অংশ আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এবং বিশেষ করে বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রতিবন্ধী মানুষ প্রতিনিয়ত নানারকম বৈষম্যের শিকার হয়, সামাজিক কুসংস্কারের কারণে 'সত্যিকারের মানুষ' হিসেবে বিবেচিত হয় না। সামাজিক অনেক কাজেই অংশ নিতে পারে না। এমনকি শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধার মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যার কারণে তাদের জীবনমান অনেক অনুন্নত।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এ কাউকে পিছনে ফেলে না দেয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিশেষ করে শিক্ষা, সমতা, কর্মসংস্থান, প্রবেশাধিকারের মত বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নারী প্রতিবন্ধীরা পুরুষ প্রতিবন্ধীদের চেয়ে অনেক বেশি অসহায়। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের কনভেনশন যা ইউএনসিআরপিডি নামে পরিচিত, সেখানে আর্টিকেল ৮ এ স্পষ্ট করে বলা আছে যে পুরুষ প্রতিবন্ধীদের চেয়ে নারী প্রতিবন্ধীদের বহুমুখী বৈষম্যের শিকার হতে হয়। আর এসব কারণেই তাদের ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১০ এর তথ্যমতে বাংলাদেশে ৯ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী।  অন্যদিকে ২০১১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যাচ্ছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আবার ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা নিয়ে এই বড় ধরনের পার্থক্যের একটা কারণ হতে পারে প্রতিবন্ধী মানুষ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন সময় ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা। তবে সঠিক তথ্যের অভাবের কারণে প্রতিবন্ধী মানুষ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের সুবিধা খুব কম পাচ্ছে। যদিও সরকারিভাবে প্রতিবন্ধীদের ভাতা আর ঋণ দেয়া হয় কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য অধিকার ও সুরক্ষা আইন করা হয়েছে। আশা করা হয় এই আইনের মাধ্যমে যেমন তাদের অধিকার রক্ষা করা হবে তেমনি সমাজের সর্বস্তরে কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এই আইনে বিভিন্ন কমিটি আর তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা আছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত  প্রত্যাশিত পর্যাপ্ত ফলাফল চোখে পড়ে  না। তবে অনেক সীমাবন্ধতার মধ্যেও প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মানুষের মধ্যে এক ধরণের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তবে এখনো তা পর্যাপ্ত না।

বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করলেও আমরা যদি প্রতিবন্ধী মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই এখনো তারা অনগ্রসর এবং পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানুষের সামাজিক ক্ষমতায়ণ  নিয়ে কাজ করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে যেমন এখনো সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ বাংলাদেশে সামাজিকভাবে সম্ভাব্য সকল কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না, আবার নিজেকে মূল্যায়ন করার আত্মবিশ্বাসও অর্জন করতে পারেনি। এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরী, খেলাধুলার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। যাতায়াতের জন্য প্রতিবন্ধীবান্ধব তেমন পরিবেশ পাচ্ছে না যাতে করে কিছু করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তারা অনেক পিছিয়ে আছে তাই আরো যাতে পিছিয়ে না থাকে এই জন্য সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা খুব জরুরি। তাছাড়া তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকটি সার্বিক অর্থে বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সামাজিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউএনসিআরপিডির ১২.৫.৫ আর্টিকেল অনুযায়ী ব্যাংকের ঋণ পাবার ক্ষেত্রে অন্যদের মত প্রতিবন্ধী মানুষের সমান সুযোগ থাকতে হবে। আর্টিকেল ২৭ (এফ) এ প্রতিবন্ধী মানুষের নিজেদের কর্মসংস্থানের কথা, নিজস্ব ব্যবসা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষের যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে প্রতিবন্ধী মানুষ আয়বর্ধক কোনো কাজ বা ব্যবসার সাথে যুক্ত হতে চাইলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থের অভাবে কিছুই করতে পারে না। যার কারণে তারা স্বাভাবিকভাবেই পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে।

প্রতিবন্ধী মানুষ যেমন দারিদ্র্যের মাঝে বাস করে তেমনি দারিদ্র্যও প্রতিবন্ধীদের অসহায়ত্বের সীমানা বাড়ায়। আর এর জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মিত বৈষম্যের শিকার হওয়া। প্রতিবন্ধী মানুষ সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও নানা ধরণের বৈষম্যের শিকার হয়। তাদেরকে আর্থিকভাবে ক্ষমতায়ন করতে পারলে সামাজিকভাবেও তারা অনেক সুফল লাভ করবে। ক্ষমতায়নের বিষয়টি একটু জটিল হলেও পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী মানুষদের তাদের অধিকারভিত্তিক সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষ হওয়ার কারণে তারা যেকোনো কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ খুব কম পায়। কিন্তু তাই বলে তারা বসে থাকে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। পরিবার ও সমাজে তাদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে চায়। কোনো না কোনো কাজের সাথে যুক্ত হতে চায়। নিজের মত করে আত্মকর্মসংস্থানের দিকে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় বাধা মূলধন।

প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন এনজিও থেকে ঋণ পাওয়ার অধিকার আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রতিবন্ধীদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে বলছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন বিষয়। তাছাড়া খুব স্বল্প পরিমানে যা ঋণ দেয়া হচ্ছে সেটা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংককে খুশি করার জন্যই। ব্যাংকগুলো হয়তো বলতে পারে যে তারা তো ঋণ দিতেই চায় কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষ তা নিতে চায় না। ঋণ না নেওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে তার মধ্যে একটা হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব। অন্যদিকে ঋণ নেয়ার জন্য তথ্য উম্মুক্ত করে দিতে না পারার দায়টাও ব্যাংকগুলোরই। অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ জানে না যে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় অথবা কিছু প্রতিবন্ধী মানুষ জানলেও জটিলতার কারণে নিতে চায় না।

অন্যদিকে প্রতিবন্ধী মানুষদের ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে ক্ষুদ্রঋনদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারাও ঋণ দিতে ভয় পায়। কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ধরে নেয় যে প্রতিবন্ধীদের ঋণ নিলে তা আর ফেরত আসবে না। কর্মীরাও এক ধরণের ভ্রান্ত ধারণার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। বীমা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যদের তুলনায় প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি মনে করে বীমা করার সুযোগ দিতে চায় না। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিশেষ করে উগান্ডা, আফগানিস্তান, ভারত এমনকি বাংলাদেশেও কিছু কিছু ক্ষুদ্রঋনদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের ঋণ দিয়ে আবার ঋণের টাকা ফেরতও পেয়েছে। দেখা যায় তাদের গড় সঞ্চয়ের পরিমান অন্যদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়, অনেক ক্ষেত্রেই বেশি।

তবে যে কয়জন প্রতিবন্ধী মানুষ ঋণ পাচ্ছে তারা হয়তো ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভাষায় কেউ 'কর্মক্ষম' কিংবা কিছু উৎপাদনশীল কাজের সাথে যুক্ত। দেখা যায় বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ ঋণ নিতে চায় কিন্তু আয়বর্ধক কিছু কাজের প্রমাণ দেখাতে না পারার কারণে ঋণ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রদানের শর্তগুলো জটিল হওয়াতে তারা সাহস করে উঠতে পারে না। অন্যদিকে ঋণ নেয়ার প্রায় কিছুদিন পর থেকেই তাদেরকে কিস্তি দেয়া শুরু করতে হয় যার ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে অনেক কঠিন। তবে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে ঋণ পাওয়ার জন্য কারো রেফারেন্সের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে তাদের প্রতি যে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে সেটার জন্যই কেউ এগিয়ে আসতে চায় না। এমনিতেই তারা গরীব তার মধ্যে যদি অনবরত বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে তো বেঁচে থাকাই দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে কি ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষদেরকে ঋণ দেয়া হচ্ছে? অনেক্ষেত্রেই দেখা যায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরকে বেছে বেছে ঋণ দেওয়া হয়। তাহলে যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিংবা শ্রবণ প্রতিবন্ধী তাদের কি আর্থিক সেবার প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। এক্ষেত্রে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানকে আরো নমনীয় হতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

তাই ভ্রান্ত ধারণার বাইরে এসে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি তাদের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসতে পারে, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতায়ন করতে পারে, সর্বোপরি নিজেদের কর্মক্ষমতার উপর যে বিশ্বাস সেটা আরো পাকাপোক্ত করবে। তাহলেই আমরা যেমন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব তেমনি প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জন্য সুন্দর ভবিষৎ বিনির্মাণে এগিয়ে আসতে পারব। জয় হোক প্রতিবন্ধী মানুষের।