সাধু সাবধান! স্মার্টফোন বিক্রি করতে চান?

শেখ আনোয়ার
Published : 1 Jan 2012, 02:07 PM
Updated : 20 Nov 2019, 07:18 AM

বিবাহিত এক ব্যক্তি তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে স্মার্টফোনে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ধরা পড়েন তার স্ত্রীর কাছে। এ নিয়ে মানোমালিন্য। শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি। বিরক্ত হয়ে সব নষ্টের গোড়া স্মার্টফোনটি অনলাইনে বিক্রি করে দেন সেই লোক। জ্বী না। অনেক চেষ্টা করেও তিনি গোপন অভিসারের কথা গোপন রাখতে পারেননি। ফোনটা বিক্রির আগে যদিও মেমরি কার্ডসহ সব ডেটাই ফরম্যাট দিয়ে মুছে ফেলেছিলেন। এমনকি সকল অ্যাপসও ডিলেট করে দিয়েছিলেন। তারপরও যিনি কেনেন তিনি জেনে গেলেন আগের মালিকের গোপন প্রেমের খবরাখবর! এতো সাবধানতার পরও এমন ঘটনা কিভাবে ঘটলো? এজন্য দায়ী উচ্চ প্রযুক্তির ডেটা রিকভারিং 'অ্যাপস' বা সফটওয়্যার।

জ্বী হ্যাঁ। ডিজিটাল যুগের কল্যাণে কম্পিউটার যন্ত্রের 'সফটওয়্যার' আর স্মার্টফোনের 'অ্যাপস' এখন চাহিবা মাত্র হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। এজন্যে টাকা-পয়সা, খরচপত্র তেমন একটা লাগে না। স্মার্টফোনের 'প্লেস্টোর' থেকে ডাউনলোড করে নিলেই হলো। একেবারে নাগালের মধ্যেই এসে উপস্থিত হচ্ছে নানান ডিজিটাল ইঞ্জিন। অথচ কী ভয়ংকর! এসব অ্যাপস ধ্বসিয়ে দিতে পারে কারও ব্যক্তিগত জীবন। তাছাড়া নতুন বা দৃষ্টিনন্দন স্মার্টফোনের জন্য পুরনো ফোনসেট বিক্রি করা অনেকের কাছে নেশার মতো। এই বিক্রি অনেকটা নিজের ব্যক্তিগত ডায়রিটা হস্তান্তরের মতো। আপনি কি তা খেয়াল করেছেন? কারণ স্বাভাবিকভাবেই স্মার্টফোনে ব্যবহারকারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষণ করে রাখেন। স্মার্টফোন বিক্রির কথাটা মাথায় এলেই সবাই যে কথাটা সবার আগে ভাবেন তা হলো, সব ডেটা মুছে ফেলা। এসব মুছে ফেলা কিন্তু অতো সোজা কাজ না। যা ভাবছেন তার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন কাজ। প্লেস্টোরের ডাউনলোড করা মামুলি 'অ্যাপস' দিয়ে এসব মুছে ফেলা তথ্য পুরোটাই উদ্ধার করা এখন পান্তা ভাত।

ভার্জিনিয়ার কথাই ধরা যাক। সেদেশের একটা নিরাপত্তা সেবাদানকারী সংস্থা (ট্রাস্ট ডিজিটাল) সম্প্রতি অনলাইন কেনাবেচার মাধ্যমে দশটা বিভিন্ন মডেলের স্মার্টফোন কেনে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, এসব স্মার্টফোনের নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যায় কী না? তাদের কেনা পুরনো স্মার্টফোনগুলোর প্রতিটাই কর্পোরেট ব্যবহারের জন্য এবং খুবই উচ্চ প্রযুক্তি মানের। অবাক হলেও সত্যি, ট্রাস্ট ডিজিটালের উৎসুক অ্যাপস ইঞ্জিনিয়াররা প্রতিটা স্মার্টফোন থেকে প্রায় সব তথ্যই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে একটাতে ছিলো অবরুদ্ধ দুই প্রেমিক-প্রেমিকার তীব্র আবেগী কথোপকথন। অন্যগুলোতে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে বহু কোটি ডলারের ফেডারেল পরিবহন কন্ট্রাক্ট প্রাপ্তির লক্ষ্যে একটা কোম্পানির পরিকল্পনা। পাওয়া গেছে আরেকটা কোম্পানীর পঞ্চাশ হাজার ডলারের সফটওয়্যার কেনার প্রদেয় বিল সংক্রান্ত ই-মেইল। ছিলো অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গোপন পাসওয়ার্ড ইত্যাদি। এভাবে নিলামে কেনা পুরনো স্মার্টফোন থেকে সাতাশ হাজার পৃষ্ঠা পর্যন্ত ডেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। প্রিন্ট নিয়ে দেখা যায় স্তুপ হওয়া কাগজের উচ্চতা আট ফুট। দেখা গেছে, বিক্রি হওয়া অধিকাংশ স্মার্টফোনের ব্যবহার ব্যক্তিগত। অথবা বহু গুরুত্বপূর্ণ গোপন কর্পোরেট তথ্যে সেগুলো ঠাসা। অনেকেই হয়তো সময় বাঁচাতে এসব তথ্য ব্যক্তিগত স্মার্টফোনে সেভ করে রাখেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাস! স্মার্টফোন বিক্রির সঙ্গে এসব তথ্য যে পাচার হয়ে যায় সে খবর কেউ আর রাখে না।

ট্রাস্ট ডিজিটালের কেনা একটা ফোনে পাওয়া যায় সিলিকন ভ্যালির এক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর যাবতীয় গোপন তথ্য। এসব তথ্যের মধ্যে আরেকটা কোম্পানির সঙ্গে ভবিষ্যৎ চুক্তির বিস্তারিত গোপন বিষয়াদি উল্লেখ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল সম্ভাব্য একজন জাপানি অংশীদারের সঙ্গে বিনিময় করা ই-মেইল। ট্রাস্ট ডিজিটালের ধারণা, প্রধান নির্বাহী তার পুরনো ফোনটা দিয়েছিলেন পরিচিত সাবেক রুমমেটকে। সে কিছুদিন ব্যবহারের পর চার শ' ডলারে বিক্রি করে দেয়। এক্সপার্টরা এ ফোন থেকে একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দু'পক্ষের চালাচালি করা আইডি মেইলগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

স্মার্টফোন এখন সস্তা। স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোতে মুক্ত বাজার অর্থনীতির দোলা লেগেছে। ৬-১৬ জিবি র‌্যামের স্মার্টফোন চলতি বাজারে এখন অতি সস্তায় মেলে। তাই দেখা যায়, পুরনো স্মার্টফোন বদলানো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। গড়ে প্রতি আঠার মাসে ব্যবহারকারী তার স্মার্টফোন বদলায়। উন্নত মডেলের, আপডেট ভার্সনের আরেকটা নতুন স্মার্টফোন কেনে। এরপর পুরনোটা অব্যবহৃত বস্তুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অথবা কাউকে দান করে দেয়। আবার নানান কারণে হারিয়েও ফেলে কেউ কেউ। একবারও কি ভেবে দেখেছেন? যে ফোনটা হাতছাড়া করেছেন, সেই ফোনে রয়ে গেছে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নাম্বার। এসব নাম্বারের কারণে প্রতারিত হতে পারেন যে কেউ। ট্রাস্ট ডিজিটালের কেনা সবগুলো ফোনই শীর্ষস্থানীয় প্রস্তুতকারকদের এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। দেখা গেছে, এসব ফোনে তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা ফ্লাশ মেমোরি চিপের মধ্যে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় পকেট কম্পিউটার, ডিজিটাল ক্যামেরা তথা সঙ্গীতের অডিও ভিডিও'র যাবতীয় ন্যানো যন্ত্রপাতিতে। আর ফ্লাশ মেমোরির কথা কে না জানে। রাস্তাঘাটে ফুটপাতের হকারের কাছেও আজকাল ফ্লাশ মেমোরি পানির দরে পাওয়া যায। দামে সস্তা হলেও সব ফ্লাশ মেমোরিই টেকসই হয়।

স্মার্টফোনের চিপ, মাদারবোর্ড, মেমরি কার্ড নস্ট হয়েছে? আপনার এমন ধারণা হলেও, মনে রাখা দরকার, স্মার্টফোনের স্থায়ী তথ্য মুছে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত মন্থর। স্মার্টফোন প্রস্তুকারকরা অবশ্য নিরাপদে তথ্য মুছে ফেলার নির্দেশনা স্মার্টফোনের প্যাকেটের সঙ্গে সরবরাহকৃত কাগজপত্রে উল্লেখ করে থাকে। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, এ নির্দেশনা অনুসরণ করা জটিল হওয়ায় কেউ আর এসব ঝামেলার পথ মাড়ায় না। অন্যদিকে দেখা গেছে, চীন, কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ইত্যাদি দেশের জনপ্রিয় স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো এসব নির্দেশনার সেবা দিতে তাদের ওয়েবসাইট, অ্যাপস ইত্যাদির কথা বলে। কিন্তু ক্রেতার পক্ষে তা খুঁজে বের করা কষ্টকর। সেখানে বলা থাকে, আপনার এই স্মার্টফোনটা একেবারে তথ্যমুক্ত করতে চাইলে ফোনের পেছনের একটা বাটনে চাপ রাখা অবস্থায় একই সঙ্গে আরো তিনটা বাটনে চাপ দিতে হবে ইত্যাদি। তার মানে কী! কাজটা করতে হবে একই সঙ্গে দু'জন মানুষকে। তাই ট্রাস্ট ডিজিটালের প্রধান টেকনিক্যাল অফিসার নর্ম লডারমিলস পুরনো স্মার্টফোন বিক্রির ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এগুলো হ্যাকার বা চোরের হাতে পড়লে কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে কল্পনা করা যায়?

পুরনো স্মার্টফোন বিক্রির ব্যাপারটা নিয়ে তবুও কেউ কেউ হয়তো বলবেন: 'ধুত্তরি! স্মার্টফোনের সব ডেটা মুছে ফেলবো। তারপর বিক্রি করবো।' কিন্তু না। এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আপনার ব্যক্তিগত রেকর্ড বা অপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলা অতো সহজ নয়। তাই সাধু সাবধান! আপনার বিরুদ্ধে বড় সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আপনার স্মার্টফোনটা সদা প্রস্তুত।