উপাচার্য যখন প্রশাসক: সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কিছু আলাপ

হাবিবুর রহমান
Published : 16 Nov 2019, 09:11 AM
Updated : 16 Nov 2019, 09:11 AM

সম্প্রতি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বিরোধী যে আন্দোলন হয়ে গেল, তা অনেক স্বস্তি, সম্ভাবনা ও একই সাথে অশনি সংকেতের জানান দিয়ে গেল। স্বস্তির কথা হল দুর্বৃত্তায়ন, অশিক্ষা, অন্যায় ও শিক্ষা বিরোধী একটা ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়টির ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জেঁকে বসেছিল, সেখান থেকে আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়টি ন্যায্যতাভিত্তিক এক নতুন শুরুর আশা দেখছে। গত পাঁচ বছরে এখানকার শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়ন ও বঞ্চনার স্বল্প একটা চিত্র দেয়া যাক প্রথমেই। শিক্ষার্থীদের অধিকার পূরণ তো দূরে থাক, তাদের সামান্যতম বাক-স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরেছিল এত দিনকার উপাচার্য-প্রধান প্রশাসন। শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে জারি ছিল ভয়ার্ত এক নিষ্পেষণমূলক সংস্কৃতি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের ন্যুনতম সুবিধা এখনো তৈরি করা হয়নি। নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব, নিরাপদ পানি, পরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত শৌচাগার, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, চিকিৎসা সেবাসহ নানান অপরিহার্য অনুষঙ্গ। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো গল্প করতে পারে না। ওদের হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। ক্লাস করতে হয় জীর্ণ টিনশেডে। তবু বিভাগ ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধি থেমে ছিল না। ভর্তি ফি, সেমিস্টার ফি ও আরো নানা ধরনের ফি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অনেক বেশি। ল্যাব ছাড়াই চলছে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও জীব বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিভাগের পাঠদান, যা শিক্ষার্থীদেরকে অসম্পূর্ণ একাডেমিক অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতসব বঞ্চনার ভেতরেও ওদের উপর জেঁকে বসেছিল দমন ও লাঞ্চিত করার এক সংস্কৃতি যা হল বহিস্কার সংস্কৃতি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের উপর অযাচিত নৈতিক পুলিশিং বা নিয়ন্ত্রণ এতটাই প্রবল ছিল যে সকাল কিংবা সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ প্রাঙ্গণে স্বাভাবিক আড্ডা, সংস্কৃতিচর্চা ও চলাফেরাই করতে পারত না। শিক্ষকরাও মুক্ত ছিলেন না এই অনৈতিক শোষণযন্ত্রের নানামুখী নিষ্পেষণ থেকে। কিছু শ্রেণি কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল, বিভাগের বাইরে নানান জায়গায় ছিল এই ক্যামেরা, শ্রেণি কক্ষে কি পড়ানো হচ্ছে তারও খবরাখবর চলে যেত উপাচার্যের কানে। তা নিয়ে দিনভর উত্তপ্ত হত তার টেবিল। স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রগতিশীলতা ও চেতনাদায়ী সহশিক্ষামূলক চিন্তা-বিনিময় ও বই নিয়েও ছিল সার্বক্ষণিক নোংরা নজর ও নিয়ন্ত্রণ। যেসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের এসব চিন্তা-চর্চায় আগ্রহী করতে কাজ করেছেন, তাদেরকে নানা আলোচনা সভা ও অনুষ্ঠানে আপত্তিকর ভাষায় বানোয়াট সব অভিযোগে হেয় করা হয়েছে। এই সব অনাচার সরে যায়নি কিন্তু উপাচার্য-বিরোধী সফল আন্দোলনের মাধ্যমে এসব থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ খুঁজে পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষকরা।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমাট বাঁধা মোসাহেবি ও দুর্বৃত্তায়নের ফলে সৃষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক পচনের সামান্য একটা নমুনাকে তুলে এনেছে। সামগ্রিক ও বলিষ্ঠ না হলেও শাণিত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। নিভুনিভু করে হলেও তা চলমান রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এই চর্চায় শামিল হওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিতান্তই কম। নানামুখী কারণের মধ্যে অন্যতম হল এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পৃষ্ঠপোষকতাতো নেই-ই, বরং যারা এসবে যুক্ত থাকেন তাদেরকে নানান তকমা লাগিয়ে নিয়ন্ত্রণের হীন সব পায়তারা চলমান থাকে। কারণটা খুব স্পষ্ট; এই চর্চায় লিপ্ত থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চলমান কাঠামো ও তার নানাবিধ অচলায়তনকে প্রশ্ন করে। উপাচার্য ও তার প্রশাসন বলয়ের শিক্ষকরা যেহেতু জ্ঞানতাত্বিক চর্চার মৌলিক জায়গা থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূরে থাকেন, তাদের কাছে মুক্ত জ্ঞান-বুদ্ধি চর্চাকে বিরুদ্ধ শক্তি কিংবা ভয়ের কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। শ্রেণি কক্ষ ও এর বাইরে শিক্ষকরা যদি জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রিক ব্যস্ততার মাধ্যমে শিক্ষার্থীমুখী না হতে পারেন কিংবা অযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্রেফ একজন চাকুরিজীবী হিসেবে অন্যায়পন্থায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জ্ঞানচর্চায় আস্থা হারিয়ে ফেলে কেবল প্রশাসক মুরুব্বির তাবেদারি করে অর্থকরী পদ ও ক্ষমতা চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা মুক্ত জ্ঞান চর্চা, প্রশ্ন করার সংস্কৃতি ও রীতিবিরুদ্ধ ন্যায় অনুশীলন যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে প্রতিহত করা খুবই কাম্য। এমন শিক্ষকরা জ্ঞানপিতা হতে পারেন না, বরং প্রতিবাদ ও প্রশ্ন বিনির্মাণের সবকিছুকেই সন্দেহবাতিকতায় নিয়ে মোটাদাগে প্রশাসনবিরোধী কুচক্রের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেন। আর তাতে অন্ধ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যান উপাচার্য মহোদয়।

উপাচার্য মহোদয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসেন কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে যান। তারচেয়েও ক্ষতিকর জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার্থীবিমুখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, যারা অতি সহজে দলদাস হয়ে মতাদর্শ বদলে হয়ে যান পুরোদস্তুর অনৈতিক পেশাজীবী শ্রেণি। পড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সাথে অসততা করতে করতে মোসাহেব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নানা স্বেচ্ছাচারী কাজ করতে পিছপা হন না। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির মোহ এমন শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শ্রেণিকক্ষে সিলাবাসকে সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার কৌশল শুনে হতবাক হই না বরং মাঝেমধ্যে তাজ্জব বনে যাই। পুরো সিলেবাস কয়েক টুকরো করে শিক্ষার্থীদের কচি কাঁধে কত অনায়াসে তুলে দেন যারা, তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠবিদ্যাপিঠের শ্রেষ্ঠ দাবি করা পাপীষ্ঠ কিছু শিক্ষক। ওদের টিউশন আর ৯-৫টার ক্লাস করার অমানসিক ঝক্কির উপরে এই ধরণের বোঝা বইতে হয় অনৈতিক শিক্ষকদের হুকুমে। উনারা না পড়িয়েই প্রেজেন্টেশন নিয়েই কোর্স শেষ করিয়ে দেন। শ্রেণিকক্ষে তো শিক্ষকই সর্বেসর্বা। ব্রাজিলিয়ান শিক্ষা-দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরে যাকে "Banking theory of education" বলেছেন, তার পুরোটাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানে উপস্থিত। শিক্ষক নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটাই শিক্ষার্থীদের একমাত্র ও প্রধান জ্ঞানার্জনের ইনপুট বা উৎস। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন তো কেমন যেন নিষিদ্ধ সেখানে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন দমিয়ে রাখাটা কতটা জ্ঞানবিরোধী চর্চা তা ভাবেন না অধিকাংশ শিক্ষকেরা। ফ্রেইরির "problem posing theory of education" দ্বান্দ্বিকতা বা প্রশ্নমূলক বা পাল্টা জ্ঞান সৃষ্টির শিক্ষার পরিবেশ তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউটোপিয়ার মত মনে হয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র মনে করা তো দূরে থাক ভয় জারি করে ওদের নিজেদের জগৎ তথা ওদের শ্রেণিকক্ষকে রুদ্ধ করে রাখেন। কেউ আবার ৫-১০টা ক্লাস নিয়েই সব খতম করে দেন। ৫০ মিনিটের ক্লাস করাতে আসেন ২০-২৫ মিনিট দেরি করে। শিক্ষার্থীরা না খেয়ে অপেক্ষা করে থাকে। উনাদের আসার সময় হয় না অনেক সময় আবার। ব্যস, এভাবেই মিডটার্ম আর সেমিস্টার ফাইনাল চলে আসে। কেউ কেউ প্রশ্ন দিয়ে দেন। আবার উদার হস্তে নম্বর দিয়ে পাঠদানে নিজের অসততার পাপ মোচন করেন। এতে করে শিক্ষার্থীদেরই চতুর্মুখী ক্ষতি হচ্ছে। এত টাকা দিয়ে পড়তে এসে শুভঙ্করের ফাঁকিতে নিমজ্জিত হতে হচ্ছে। টাকাগুলো যে কি উপায়ে আসে তা মানবিক হৃদয় দিয়ে শুনতে গেলে অশ্রু ঝরাবেই। এই টাকাতেই শিক্ষকদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সুবিধাদি মিলছে। তবু কেন শিক্ষার্থীরাই পিষ্ট হয়?! বেতন-ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে ওরা নির্যাতিত হবে, স্বেচ্ছাচারী শিক্ষকদের জ্ঞানদানের অনিয়ম নিয়ে কথা বললে নম্বর কমিয়ে দেওয়া অথবা বিভাগীয় শাস্তি পেতে হবে। এভাবেই টিকে যাচ্ছে অন্যায় চর্চা। শ্রেণিকক্ষের মহান মানুষদের সাথে অসততাই শিক্ষককে দুর্নীতিপ্রবণ করে তোলার প্রণোদনা দেয়। শিক্ষার্থীদের পড়ানো, নতুন কিছু শেখানো ও ওদের মনের কথা শুনে সময় কাটালে কিন্তু বড় চেয়ারের তাবেদারিতে দিন-রাতগুলো কেটে যেত না। কর্তারা আবার এমন শিক্ষকদের কাঁধে করে রাখে, এরাই পদোন্নতি পেয়ে যায় অনায়াসে। কয়দিন পরেই শিক্ষক হয়ে খুব মুখ লুকিয়ে চলতে হবে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনে পঙ্গু করে দিয়েই শিক্ষকরা আজ ক্ষান্ত নয়, স্বার্থে আঘাত আসলে শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চারণ অযোগ্য ভাষায় গালমন্দ করতেও দ্বিধাবোধ করেন না, পেটুয়া বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের শায়েস্তাও করেন। ফেসবুকে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করায় অভিভাবক ডেকে এনে উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের উপস্থিতি ও সহযোগিতায় কিভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়, তা সম্প্রতি আমরা দেখেছি। তবু শিক্ষার্থীরা ভুলে যায়, তাদের ক্লাস করে, সম্মান দেখিয়ে তাদের আগে হেঁটে যায় না, ছায়াটাও মাড়ায় না শিক্ষকদের শরীরের অবয়ব বলে, ফেসবুকে শিক্ষকদের অনুসরণ করে, কত আনন্দ নিয়ে শিক্ষকের সাথে ছবি তোলে, শিক্ষকদের ভাল-মন্দে নিজেদের আবেগ ঝরায়।

বাংলাদেশে উপাচার্য বিরোধী অনেক আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলনের আদর্শিক লক্ষ্যগুলো পূরণ হয়নি। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নতুন উপাচার্যের অধীনে গড়ে ওঠা প্রশাসনের কাছে আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুবিধা ভোগ করতে থাকে নতুন প্রশাসনের সুবিধাবাদী একটা গোষ্ঠী। শিক্ষার্থীপন্থী ন্যায়পরায়ণ শিক্ষকরা সব উপাচার্য ও তাদের প্রশাসনের কাছে সব সময়েই ব্রাত্য হয়েই থাকেন। এক্ষেত্রে নাইজেরীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবির ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস "Anthills of the Savannah" এর কাহিনী বেশ প্রাসঙ্গিক। স্যাম, ইকেম ও ক্রিস বাল্য কালের বন্ধু। কঙ্গনের স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যূত করে স্যাম ক্ষমতা গ্রহণ করেন, ক্রিস হন তথ্য কমিশনার আর ইকেম হন রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্রের সম্পাদক। স্যাম জনগণের ন্যায্য অধিকারকে পাশ কাটিয়ে দানবীয় শাসকে রূপান্তরিত হন। ইকেম শিল্প ও সাহিত্য অনুরাগী একজন ন্যায্যতাপন্থী বুদ্ধিজীবী। তিনি দ্রুতই স্যামের অন্যায় শোষণের ঘোরতর সমালোচক হয়ে উঠেন। স্যামের বিরুদ্ধে আবাজন অঞ্চলে বিদ্রোহের সূচনা হওয়ায় তিনি এই অঞ্চলের যাবতীয় সেবাসমূহ বন্ধ করে দেন। ক্রিস, স্যাম আর একেমের ভেতরে ঠাণ্ডা মাথায় মধ্যস্ততায় এতদিন নিয়োজিত থাকলেও স্যামের বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকেন। স্যাম ইকেমকে তার পদ থেকে সরিয়ে দাবার জন্য ক্রিসকে চাপ দিতে থাকেন। ক্রিস তাতে অসম্মতি জানালেও স্যাম ইকেমকে বরখাস্ত করেন। এক গুপ্তহত্যায় প্রাণ হারান ইকেম। এক পর্যায়ে ক্রিসও স্যামের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। স্যাম আজীবন রাষ্ট্রপ্রধান হবার নেশায় যতসব নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এক সময় তার বিরোধীরা তাকে হটিয়ে ও হত্যা করে ক্ষমতায় আসে। ক্রিসকেও হত্যা করা হয়। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যায় ক্ষমতার পালা বদল হলেও সত্যিকারের মুক্তির পথ নিশ্চিত হয় না। অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে নির্মোহ বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হলেও তাদেরকে দমনের সব পন্থা অবলম্বন করে রাষ্ট্রযন্ত্র। মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক লুইস আলথুসার এই পন্থা বা ব্যবস্থাকে Repressive State Apparatus বা শারিরীক নিষ্পেষণমূলক যন্ত্র ও Ideological State Apparatus বা আদর্শিক নিষ্পেষণমূলক যন্ত্র নামে অভিহিত করেছেন। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও এমন শোষণ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে এই দুই ধরণের নিষ্পেষণ চলতে থাকে শিক্ষা ও মানবসম্পদ গঠন-উন্নয়নের নামে। উপন্যাসটি এটাও স্মরণ করিয়ে দেয় প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর বিকাশ ঘটে গণ-সংকটের সময়েই। এডওয়ার্ড সাঈদ ১৯৯৩ সালে তার রিথ লেকচারে, যা "The Role of Intellectuals" নামে প্রকাশিত, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এমনটাই বলেছেন। তার মতে আসল বুদ্ধিজীবীরা নির্মোহ বিচার-বিবেচনাবোধ থেকে জাতীয় ও গোষ্ঠীগত সংকটে সমাজের অংশীভূত হন এবং লড়াই জারি রাখেন। এই বুদ্ধিজীবীদের ছাড়া কোনো বিপ্লব হয়নি, হওয়া সম্ভবও না। বুদ্ধিজীবীরাই বিপ্লবের মা-বাবা, ভাইবোন কিংবা পরম্পরাগত সকল শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব। উপনিবেশ-উত্তর পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্ব দেখা গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত জনঘনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভেতর থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত ঔপনিবেশিকতা থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে বুদ্ধিজীবীদের সংশ্লিষ্টতা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার নানান জনবিরোধী চর্চার বিরুদ্ধে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সেই পাকিস্তান আমল থেকেই বেশ বলিষ্ঠ ও সফল ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেতনাদায়ী ও শিক্ষার্থীমুখী রাজনীতিকে নষ্ট করে দেয়। পুরনো ও বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তবু অল্প হলেও কিছু নির্মোহ বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত এতটা চাক্ষুষ ও জঘন্য দমন-পীড়ন দেখা যায় না। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে দমন ও ধ্বংসের নমুনাগুলো গোচরে আসার পরে সর্বমহল জানতে পেরেছে উপাচার্য হয়ে একজন শিক্ষক তার কায়েমি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে কিভাবে একদল অনুগত দমনবান্ধব সিপাহসালার তৈরি করে প্রতিবাদের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন। এই ধরণের নিষ্পেষণ ব্যবস্থা ফ্রাংকেস্টেইনের চেয়েও ভয়ংকর কারণ মুক্তচিন্তক প্রতিটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মস্তিস্কের জগতেও এরা হানা দেয়। এই দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি শিক্ষার্থী ও জ্ঞানচর্চায় অঙ্গীকারবদ্ধ সৎ শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিবাদের প্রতি এক ধরণের আড়ষ্টতা বা অনীহা তৈরি করে যা মুক্তির পথে বড় অন্তরায়। ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরি তার "Pedagogy of the Opressed" বইয়ে এমন অবস্থাকে নির্যাতিতদের বিমানবিকীকরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন নির্যাতিত পক্ষ যখন নির্যাতক শ্রেণির কবলে পিষ্ট হয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তিকে ভয় পায়, তখনই সত্যিকারের বিমানবিকীকরণ তার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় ফ্রেইরির এই তত্ত্ব কিন্তু অখণ্ডনীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক। নৈঃশব্দ্য নিয়ে বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকাংশ চুপসে থাকেন কিন্তু বাকিরা ফায়দা তোলার খেলায় মাতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখি সেই ফায়দা তোলার ধরণ ও রূপগুলো কতটা কদর্য ও শিক্ষার সংস্কৃতির জন্য কতটা সুদূরপ্রসারী ক্ষতি সাধন করে দেয়। ভুয়া ভর্তি, দলভারী করার জন্য অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের দানবীয় চরিত্র নিয়ে হাজির হওয়া, আর্থিক, নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলনে জড়িয়ে পড়া ও সবচেয়ে ভয়াবহ হল এসবের পরেও উপাচার্য-প্রধান প্রশাসনের বিচারহীনতার ও প্রশ্রয়দানের সংস্কৃতি আমাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

আন্দোলন পরবর্তী অশনি সংকেতের অবতারণা করতে গিয়ে ফরাসি উত্তর-উপনিবেশবাদী চিন্তক ফ্রান্তস ফ্যানোর বই "Wretched of the Earth"-এর "Pitfalls of Nationalism" শীর্ষক অধ্যায়ে উপনিবেশ উত্তর স্বাধীন দেশে হঠাৎ পাওয়া মুক্তি কিভাবে একটা জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয় এবং তা কিভাবে একটা অপরিণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয় যা মুক্তির পথ ও নিরন্তর সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে ব্যক্তিপূজোয় বা স্বীয়-স্বার্থ পূরণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিকতার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে চলমান শাসনব্যবস্থা তার দীর্ঘদিনের খারাপ চর্চাগুলো ধরে রাখে। এতে করে উপাচার্যের বদল হলেও, পূর্বেকার ব্যবস্থার মতই শিক্ষার্থী ও উচিত শিক্ষার উপর নিষ্পেষণ বন্ধ হয় না। সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা ও চর্চা অন্ততঃ নিরাশাবাদের এমন কথাই বলে। তবু অধিকারের প্রশ্নে আসল আদর্শবাদী শিক্ষার্থী ও মুষ্টিমেয় কিছু বিবেকী শিক্ষক তাদের জ্ঞানচর্চায় এখনো অহিংস ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আস্থা হারায়নি।