জেলহত্যার নির্মম প্রহর

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 3 Nov 2019, 04:00 AM
Updated : 3 Nov 2019, 04:00 AM

জেল হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চরম কলঙ্কজনক ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যাকারীরা ছিল মোশতাক-ফারুক-রশিদ-ডালিম চক্রের ঘাতক গ্রুপ রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং দফাদার মারফত আলী শাহ, এল ডি দফাদার আবুল হাশেম মৃধা গং।

৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ বিদ্রোহ করেন। মূলতঃ সময়টি ছিল ২ নভেম্বর মধ্যরাত। সেনা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ এবং ঘাতক চক্রকে বঙ্গভবন থেকে বহিস্কারের দাবি করেন তিনি। সক্রিয় ঘাতকচক্র এবং তাদের প্রধান মোশতাক বুঝতে পারে তাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে খালেদের এই বিদ্রোহ মুজিব হত্যার প্রতিবাদেই সংগঠিত হয়েছে। আর তখনই তারা জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াসে জেল হত্যা সংঘটিত করে। পাল্টা অভ্যুত্থান এর সম্ভাবনা মাথায় রেখে এই ধরনের হত্যা পরিকল্পনা মোশতাক নেতৃত্বাধীন খুনিচক্র আগেই করে রেখেছিল।

বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর জাতি অন্তত আশায় বুক বেঁধেছিল যে আরও চার নেতা রয়েছেন। তারা আবার জাতিকে আগের ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার সাহসী অপেক্ষায় থাকা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারা মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন।

জেল হত্যাকাণ্ড মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং তথাকথিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সরাসরি নির্দেশে ঘটে। হত্যাকাণ্ড ঘটায় জল্লাদ রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং তার সহযোগীরা।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রমও ১৫ অগাস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। যে কক্ষটিতে হত্যাকাণ্ড ঘটে তিনি তার উল্টোদিকের সেলে থাকতেন। প্রয়াত নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন যে- "একই ব্লকে থাকা সত্বেও আমরা পুরো ঘটনা ভালভাবে দেখিনি। শুধু গুলির শব্দ শুনেছি। তবে চার নেতাকে বিবিধ কক্ষ থেকে একটি কক্ষে নেয়ার ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছি"। উল্টোদিকের সেলে থাকার কারণে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ অন্য যে কারোর চেয়ে ভালভাবে ঘটনা দেখেছেন বলেই ধারণা করা যায়।

মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম এসপি মাহবুব হিসেবেই বেশি পরিচিত। তার টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের বিবরণ থেকে জানা যায় যে ডালিম ২ নভেম্বর দিনের বেলা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে আসেন।

ডালিম এবং মাহবুব বন্ধুস্থানীয়। গরাদের ওপার থেকে মাহবুব ডালিমকে ডাক দিলে ডালিম বিব্রত হয়ে পড়ে। মাহবুব ডালিমের এখানে আসার কারণ জানতে চান। ডালিম নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেন যে মাহবুব এবং অন্যরা এখানে থাকায় তিনি কারাগারের নিরাপত্তা এবং আলোকব্যবস্থা দেখতে এসেছেন। জেল হত্যাকাণ্ডের পর মাহবুব বুঝতে পারেন যে ডালিম আসলে রেকি করতে এসেছিল।

৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় রাতের শেষ প্রহরে। মূলতঃ ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৪টা থেকে ৪:৩৫ এর মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। স্থান কারাগারের নতুন বিল্ডিং এর ১নং কক্ষ।

তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২ নভেম্বর রাত ৩টায় বঙ্গভবন থেকে কারা মহাপরিদর্শক নুরুজ্জামানকে ফোন করে মেজর রশিদ ঘাতক রিসালদার মোসলেম উদ্দিন বাহিনীর আসার কথা আগাম জানায় এবং তাদেরকে কারাগারের অফিস কক্ষে নিয়ে যেতে বলে। একই সাথে রশিদ জানায় যে তাদেরকে যেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে চিনিয়ে দেওয়া হয়। আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান তখন রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলতে চান। রশিদ তথাকথিত রাষ্ট্রপতি মোশতাককে ফোন হস্তান্তর করলে মোশতাক শুধু বলেন যে, তিনি রশিদ এর কথা বুঝতে পেরেছেন কি না! নুরুজ্জামান হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে মোশতাক তাকে তা পালন করার জন্য বলেন।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান, ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আউয়াল এবং জেলার আমিনুর রহমান কারা ভবনের অফিস এলাকায় হাজির হন। কিছু সময়ের মধ্যেই রিসালদার মোসলেম উদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে সেখানে হাজির হয়। ঘাতকদের আচরণ ছিল ভীতিকর এবং অসহিষ্ণু। তাদেরকে কারা অফিস ভবনে ডিআইজি এর কক্ষে বসানো হয় এবং তাদেরকে দর্শনার্থী রেজিস্ট্রারে সই করার কথা বলা বলা হয়। রিসালদার মোসলেম উদ্দিন তাচ্ছিল্য ভরে সই করে। কিন্তু অন্যরা কেউ-ই সই করেনি।

রিসালদার মোসলেম উদ্দিন কারা মহাপরিদর্শককে চার নেতা যেখানে আছেন তাদেরকে সেখানে নিয়ে যেতে বলে। কারা মহাপরিদর্শক নুরুজ্জামান বলেন যে বঙ্গভবন থেকে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে কিছু বলবেন। মোসলেম উদ্দিন বলে উঠেন, আমরা ওই চারজনকে গুলি করব।

হতভম্ব আইজি প্রিজনস! ডিআইজি এর ফোনে তিনি বঙ্গভবনে চেষ্টা করেন। কিন্তু লাইন পান না। এমন সময় জেলারের ফোন বেজে ওঠে এবং ফোনের ওপারে বঙ্গভবন থেকে রশিদ জানতে চান যে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং তার দল সেখানে পৌঁছেছে কি না। আইজি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন এবং বলেন যে তারা কি বলছে তিনি বুঝতে পারছেন না। রশিদ তখন ফোনটি মোশতাকের হাতে ধরিয়ে দেন। আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান মোশতাককে জানান যে সামরিক ব্যক্তিরা চার নেতাকে গুলি করতে চায়। মোশতাক বলেন যে- তারা যা করতে চায় তা করতে দাও। আইজি প্রিজনস এর মুখ শুকিয়ে যায়।

কারা কর্মকর্তারা যখন ঘাতকদের ঢুকতে না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এমন সময় কারাগারের অফিস কক্ষের টেলিফোনে তথাকথিত রাষ্ট্রপতি মোশতাক যখন আদেশ করেন যে ওরা যা করতে চায় করতে দাও, তখন কারা কর্মকর্তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।

বন্দীদের এলাকায় ঢুকে পড়ে ঘাতক দল এবং বন্দুকের মুখে আইজি প্রিজনস, ডিআইজি এবং জেলারকে তাদেরকে অনুসরণ করতে বাধ্য করে। তার আগে চার নেতাকে একই সেলে নিয়ে আসতে বাধ্য করে কারা আধিকারিকদের। প্রথম দফায় ৪টা থেকে ৪:৩০ এর মধ্যে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করে চলে যায় মোসলেম উদ্দিন বাহিনী। পরে ৫:২৫-এ বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি দল বেয়নেট চার্জ করে হত্যা নিশ্চিত করে জাতীয় চার নেতার। যদিও তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া সবাই গুলিতে তাৎক্ষণিক নিহত হয়েছিলেন।

তবে সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আউয়াল। তিনি ঘাতকদের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার করে করে বলতে থাকেন– "না আপনারা এভাবে অস্ত্র হাতে কারাগারে ঢুকতে পারেন না। বন্দীদের নিরাপত্তা নষ্ট করতে পারেন না"।

ঘাতকদের একজন তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। তাকে হত্যার ভয় দেখানো হয়। নির্যাতন করা হয়। তবুও তিনি প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। আব্দুল আউয়ালের এই প্রতিবাদের কথা কিছুটা জানা যায় তার লিখিত প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে তিনি তার উপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করলে সামরিক ব্যক্তিরা যে তাকে ভয় দেখায় তা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া আব্দুল আউয়ালের এই প্রতিবাদের কথা জানা যায় কারাগারের বৈদ্যুতিক কর্মী প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা বীরেন চন্দ্র পালের বর্ণনা থেকে।

বীরেন চন্দ্র পালের ভাষ্য মতে আব্দুল আউয়াল প্রতিবাদ করলে ঘাতকরা তাকে লাথি মেরে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেয়। পরে জেলের অন্য স্টাফরা তাকে ধরাধরি করে জেল অফিসে নিয়ে আসে। ততক্ষণে ঘাতকরা চলে গেছে।

আব্দুল আউয়াল তার অফিসিয়াল প্রতিবেদনে লেখেন- তাদেরকে অফিস কক্ষ থেকে বন্দুকের নলের মুখে নেতাদের সেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি হাঁটতে হাঁটতেই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখলে মোসলেম উদ্দিন তার দিকে আগুন চোখে তাকান এবং একজন সৈন্য তার ঘাড়ে হাত রেখে তাকে চলে যেতে বলেন। তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় তিনি রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানান এবং তার দীর্ঘ চাকরি জীবনে এই রকম ঘটনা তিনি দেখেননি বলে ঘাতকদের সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। প্রথমবার গুলি বর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি এবং আইজি প্রিজনস হত্যাকাণ্ডের স্থান থেকে চল্লিশ গজ দূরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার বেয়নেট চার্জ করার কথা তিনি আইজি এর কাছে শুনেছেন। আইজি প্রিজনস ভোর ৫:৪৫ এ অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন। ডিআইজি আব্দুল আউয়াল অফিস কক্ষে নামাজ পড়ে ৭:৪০ এ অফিস ত্যাগ করেন।

পরদিন আব্দুল আউয়াল এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লালবাগ থানায় একটি এফআইআর দাখিল করেন। জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার যখন দীর্ঘ বাইশ বছর পর শুরু হয় তখন এই এফআইআর'টি লালবাগ থানায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুজির পর পুলিশ সদর দপ্তরে হাতে লেখা এই এফআইআর'টি খুঁজে পাওয়া যায়।

আব্দুল আউয়ালের এই প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে করা এফআইআর এর কথা জাতি চিরকাল মনে রাখবে। প্রজাতন্ত্রের একজন স্বাধীন কর্মকর্তা আইনের প্রশ্নে, মানবাধিকারের প্রশ্নে, ন্যায়ের প্রশ্নে হত্যার হুমকির মুখেও আপস করেননি। তিনি হতে পারেন আমাদের সকলের আদর্শ। বিশেষভাবে হতে পারেন প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রতিটি ন্যায়বান মানুষের আদর্শ।

বঙ্গবন্ধুকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, ফিরে পাওয়া যাবে না জাতীয় চার নেতাকে। একজন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতারা একটি জাতির জন্য হয়তো একবারই জন্মান। তাদের নিষ্ঠুরভাবে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষতচিহ্ন বহন করে যাবো আমরা হাজার বছর।