নিহত “বিশ্ব-খলিফা”: আমেরিকা! আমেরিকা?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 29 Oct 2019, 09:33 AM
Updated : 29 Oct 2019, 09:33 AM

"সিরিয়ায় মার্কিন অভিযানে আইএস নেতা বাগদাদি নিহত"- আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ২৭ অক্টোবর ২০১৯।

তা বেশ। প্রায় বিশ বছর ধরে "ইসলামিক স্টেট" যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে, অসংখ্য মানুষের ওপর বর্ণনাতীত অত্যাচার করেছে মানুষ খুন করেছে, অসংখ্য নারীদের বন্দী করে যৌনদাসী বানিয়ে কেনাবেচা করেছে সেই দানবের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। এ দানব হঠাৎ করে কোত্থেকে উঠে এসে বিশাল এলাকা দখল করে কেয়ামত সৃষ্টি করল, একে কে বানালো তা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা। তবে আমরা খেয়াল করেছি সুদূর ইউরোপ এমনকি বাংলাদেশেও তার ঘাতক হাত ছুটে গেছে কিন্তু বাড়ির পাশে প্যালেস্টাইনের ওপর গণহত্যাকারী ইসরাইলের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। দুনিয়া জুড়ে আলেমরা চিৎকার করেছেন ওরা মুসলিম নয়, ওটা ইসলামী রাষ্ট্র নয়। কিন্তু অমন চিৎকার করলেই ওরা অমুসলিম হয়ে যায় কিনা, ওদের প্রতিটি হিংস্রতার সমর্থন ইসলামী কেতাব থেকে পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে পরে ভদ্রভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

আমেরিকা! এই সেই দেশ যে চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে মানবজাতিকে দিয়েছে অসামান্য উপহার। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির মতো দানব দুনিয়ায় দ্বিতীয় নেই। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সে নিজেকে সারা দুনিয়ার পুলিশ ও বিচারক দুই-ই নিযুক্ত করেছে। একাত্তরে আমাদের জীবনমরণ যুদ্ধে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারী পাকিস্তানকে সে শুধু রাজনৈতিক সমর্থনই করেনি বরং সামরিক মারণাস্ত্র জুগিয়েছিল। ভিয়েতনামে অসংখ্য নিরপরাধকে বিষাক্ত নাপাম বোমা ফেলে খুন করেছিল এই সরকার। আরো দুটো মর্মান্তিক প্রমাণ দিচ্ছি কিন্তু তার আগে বলে নিই, যে বাহানায় সে সিরিয়া-ইরাক ধ্বংস করেছে সেখানে কোনোই "উইপন অফ মাস ডেকস্ট্রাকশন" ছিল না।

১. পারমাণবিক বোমার প্রেক্ষাপট:

১৯৪৫ সাল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির মুসোলিনিতো আগেই গেছে, জার্মানিও শেষ। এখন ইউরোপ, রাশিয়া, কানাডা ও আমেরিকার সমস্ত সামরিক শক্তি ছুটেছে জাপানের বিরুদ্ধে। আক্রমণের পর আক্রমণে ছোট্ট জাপান দিশেহারা।

(ক) প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজোর সরকার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালো টোকিওতে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত জ্যাকব মালিকের কাছে। সেটা পাত্তাই দিল না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আর রাশিয়ার নেতা স্ট্যালিন, চলতেই থাকল নিরপরাধ জনগণের ওপরে হত্যালীলা।

(খ) দিশেহারা জাপান সরকার দ্বিতীয়বার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালো টোকিওতে সুইস প্রতিনিধির মাধ্যমে, সেটাও পাত্তা দিল না তারা, চলতেই থাকল নিরপরাধ জনগণের ওপরে হত্যালীলা।

(গ) ২৮ জুলাই-০১ আগস্ট ১৯৪৫, রাশিয়ার পটাসড্যাম-এ ট্রুম্যান, চার্চিল আর স্ট্যালিনের মিটিং। জনগণের ওপরে ক্রমাগত গণহত্যায় আতংকিত জাপানসম্রাট হিরোহিতো তাঁর ব্যক্তিগত সচিব প্রিন্স কনওয়ের মাধ্যমে তিন নেতার কাছে আবার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালেন। ভাবতে পারেন, কতটা বর্বর হলে তৃতীয়বারের মতো ১ অগাস্টে পাঠানো আত্মসমর্পনের প্রস্তাব গৃহীত হলো ৬ অগাস্ট হিরোশিমা ও ৯ অগাস্ট নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলার পরেই, আগে নয়?

উদ্ধৃতি দিচ্ছি ওই আমেরিকারই সমর দপ্তরের রিপোর্ট থেকে-

"হিরোশিমার ২,৫৫,০০০ লোকের মধ্যে ১৩,৫০০ (তাৎক্ষণিকভাবে- আমার কথা) হতাহত হয়। নাগাসাকির ১,৯৫,০০০ লোকের মধ্যে (তাৎক্ষণিকভাবে- আমার কথা) হতাহত হয় ৬৫,০০০। হিরোশিমার ৯০,০০০ পাকা বাড়ির মধ্যে ৬০,০০০ বাড়ি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। নাগাসাকি থেকে ১২ মাইল দূরের ঘরবাড়ির জানালা দরজাও উড়ে গিয়েছিলো"।

বৃটিশ মিশনের অফিসিয়াল রিপোর্ট-

"বোমা পড়বার এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অগ্নিজ্যোতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে বহুদূর পর্যন্ত সবকিছু ঝলসে যায়। এ অঞ্চলে যেসব নর-নারী ছিল তাদের গায়ের চামড়া পুড়ে অঙ্গারের মতো কালো হয়ে যায়"।

কিভাবে অসংখ্য জীবন্ত মানুষের "গায়ের চামড়া পুড়ে অঙ্গারের মতো কালো হয়ে" গিয়েছিল আর যন্ত্রনায় অধীর হয়ে তারা কিভাবে চিৎকার আর্তনাদ করতে করতে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য উন্মাদের মতো ছুটছিল তা কল্পনা করলে দেখলে মুখের ভাত আর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ওই পরমাণু-বিষক্রিয়ায় জাপানে বহুকাল পর্যন্ত হাজার হাজার পঙ্গু শিশুর জন্ম হয়েছে।

২. আমাদের স্বাধীনতার "আটলান্টিক চার্টার":

১৯৪১, ২য় বিশ্বযুদ্ধের ৩য় বছর। হিটলার, হিমলার, গোয়েবলস, রোমেল, রিবেনট্রপ, গুডেরিয়ান, রুনস্ট্যান্ড, গুটেনবার্গের অবিশ্বাস্য সামরিক বিস্ফোরণে থরহরি কম্পিত ইউরোপ। এক রাশিয়া ছাড়া প্রায় সারা ইউরোপ চলে গেছে জার্মানির দখলে, চলে গেছে বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, হল্যান্ড এমনকি ফ্রান্সও। থরথর হাটুকাঁপা ইংল্যান্ডের এই মহা দুর্দিনে একমাত্র ভরসা আমেরিকা, কানাডা আর বিশেষ করে ভারতবর্ষসহ উপনিবেশগুলোর সাহায্য। তড়িঘড়ি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সাথে আটলান্টিক সাগরে প্রিন্স অফ ওয়েলস জাহাজে ১৪ অগাস্ট ১৯৪১ মিটিংয়ে বসলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। উপনিবেশগুলোর নাকের ডগায় স্বাধীনতার একটা আবছা ঘোষণার মুলো ঝুলিয়ে দেয়া দরকার যাতে যুদ্ধে ওদের সাহায্যটা পাওয়া যায়।

জাহাজ থেকে রেডিওতে প্রচারিত হল সেই বিখ্যাত আটলান্টিক চার্টার যার আটটি ধারার তৃতীয়টিতে বলা হল যুদ্ধশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার থাকবে তার জায়গায় স্বাধীনভাবে সরকার গঠনের।

স্বাধীনতা! আনন্দে ফেটে পড়ল ভারতবর্ষ। সহস্র লেখক কবি দার্শনিকের স্বপ্ন, কত সন্তানহারা পিতামাতার, মাতৃহীন এতিমের অশ্রু! কত রশীদ আলী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, শাহনেওয়াজ, ভগৎ সিং, কত তিতুমীর, মঙ্গল পান্ডে, টিপু সুলতান, মাষ্টারদা, প্রীতিলতা, বীণা দাস, মাতঙ্গিনী হাজরার রক্তস্রোত। কত ফাঁসি, কত আন্দামান… সে অন্ধকারের অবসান ডাকছে ওই, স্বাধীনতার সূর্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওই!

একমাত্র ব্যতিক্রম নেতাজী। চার মাস আগে, ১৯৪১-এর এপ্রিলে তিনি জার্মানি পৌঁছে স্বাধীন ভারত পরিকল্পনায় ব্যস্ত। সেই সুদূর থেকে ইন্ডিয়ান রেডিওতে ভেসে এল তার মহা সতর্কবাণী- "বিশ্বাস কোরো না, বিশ্বাস কোরো না! পাখীর মধ্যে কাক, প্রাণীর মধ্যে শেয়াল ও জাতির মধ্যে ব্রিটিশ সবচেয়ে ধূর্ত, ওদের বিশ্বাস কোরো না"!!

শুনলেন না ভারতের নেতারা, যুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতবর্ষ। পরের বছর ১৪ অগাস্ট চার্টারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে রুজভেল্ট আবারো ঘোষণা করলেন এক বছর আগে চার্চিলের সাথে তার বৈঠকে আটলান্টিক চার্টার নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিন্তু তিন বছর পর রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি যখন বিধ্বস্ত, নির্লজ্জ পাল্টি মারলেন নেতাদ্বয়। রুজভেল্ট ঘোষণা করলেন- "এমন কোনো স্বাক্ষরিত দলিল কখনো ছিল না….. আটলান্টিক চার্টারের কপি বলতে কিছু নেই… আমার কাছে নেই। ব্রিটিশের কাছেও নেই। যা আছে তা হল (ওই জাহাজ থেকে পাঠানো) রেডিও অপারেটরের বার্তা মাত্র… এমন কোনো আনুষ্ঠানিক দলিল নেই"।

"No signed version ever existed… There isn't any copy of the Atlantic Charter… I haven't got one. The British haven't got one. The nearest thing you will get is the [message of the] radio operator on Augusta and Prince of Wales… There was no formal document"– President Roosevelt, 19 December, 1944.

ব্যাস, খেল খতম। আসলে এই দুই জিগরি দোস্ত সেই ১৯৪১ সালেই এটা গোপনে ঠিক করেছিলেন। প্রমাণ- চার্চিলের লেখা "বৃটিশ সাম্রাজ্য দেউলিয়া করার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী হইনি"। "I have not become the King's First Minister in order to preside over the liquidation of the British Empire" Sir Winston Churchill 09 September 1941.

এরই নাম রাজনীতি। মানবতার, নিরপরাধের রক্ত অশ্রু আর্তনাদের কোনো ঠাঁই এখানে কখনো ছিলোনা এখনো নেই।

(সূত্রসমৃদ্ধ বিখ্যাত বই- আমি সুভাষ বলছি, শৈলেশ দে, ৩য় খণ্ড, ৩৫৬, ৩৫৭ ও বিভিন্ন পৃষ্ঠা)।