বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ভিন্নতা কতটুকু দরকার?

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 17 Sept 2019, 07:47 AM
Updated : 17 Sept 2019, 07:47 AM

সম্প্রতি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির অভিন্ন নীতিমালার খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে পাশ হয় বলে গণমাধ্যমে বেশ চাউর হচ্ছে। নতুন নীতিমালায় শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন ৮ ঘন্টা করে সপ্তাহে ৫ দিন, অর্থাৎ সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা করে কাজ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ফাঁকিবাজ ও কাজপাগলা দুই ধরনের শিক্ষকই ক্ষেপেছেন! ফাঁকিবাজ শিক্ষক ক্ষেপেছেন, কারণ তাঁরা চিন্তা করছেন, এত কষ্ট করে পড়াশুনা করে বড় সাধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলাম বাকী জীবনটুকু একটু আরাম-আয়েশ করে কাটিয়ে দেব বলে! সপ্তাহে যেদিন ক্লাস থাকে ওইদিন বাসা থেকে আড়মোড়া ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো, আর বাকী দিনগুলো পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে নেব! কিন্তু বেরসিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সুখে এবার ভাগ বসাতে চাচ্ছে! বলুন এটা কি মেনে নেয়া যায়? আর কাজপাগলা শিক্ষকরা ক্ষেপেছেন, কারণ তাঁরা চিন্তা করছেন, সপ্তাহে না হয় খুব বেশি ক্লাস থাকে না (অধিকাংশ ক্ষেত্রে), কিন্তু গবেষণাসহ আর্টিকেল লেখা, ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা তত্ত্বাবধান করা ইত্যাদি করতে গিয়ে তাঁরা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে ফেলছেন। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিনা তাঁদেরকে ঘড়ির ফ্রেমে বেঁধে রাখতে চাইছেন! এটা সেইসব শিক্ষকদের জন্য রীতিমত অপমানজনক।

যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের জন্য একটি প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে এসেছেন। সেটা হলো গবেষণা করুক ছাই নাই করুক, সাপ্তাহিক কর্মঘন্টার কোটা পূরণ করলেই নির্দিষ্ট সময় পর পর পদোন্নতি! কিন্তু তাতে ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের বয়েই গেছে! তাঁরা তো নতুন নীতিমালা ছাড়াই এমনিতে পদোন্নতি পাচ্ছিলেন। কারণ, বাংলাদেশে এখনও চাকরির বয়স বিবেচনায় অটো প্রোমোশন দেয়া হয় (নামকাওয়াস্তে অন্যান্য সহজ শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে)। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই প্রণোদনা প্যাকেজ তাঁদেরকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।

চলুন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের পরিসীমা দিয়ে বিচার না করে বরং বিশ্বের দরবারে নিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করি। এই তুলনা করতে চাওয়ায় যদি কেউ আপত্তি করেন, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, যদি অন্য কেউ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের সাথে আত্তীকরণের দাবি তোলেন, সেই দাবির সাথে তিনিও একাত্মতা ঘোষণা করবেন।

যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে কিছু তথ্য আজ পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। উল্লেখ্য যে, অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সর্বমোট ৪৩টি যার মধ্যে ৩৮টি পাবলিক, ৩টি প্রাইভেট ও ২টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ প্রকাশিত টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ৬টি, ২০০টির মধ্যে ১১টি, ৩০০টির মধ্যে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ৫০০টির মধ্যে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভূক্ত। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষকতার ক্রম হলোঃ

  • Level A— Associate Lecturer; equivalent to Lecturer or Graduate Instructor at a US university
  • Level B— Lecturer; equivalent to Assistant Professor at a US university or Lecturer at a UK university
  • Level C— Senior Lecturer; equivalent to Associate Professor at a US university or Senior/Principal Lecturer at a UK university
  • Level D— Associate Professor; equivalent to Professor with tenure at US university or Reader/Associate Professor at UK university
  • Level E— Professor; equivalent to Distinguished/Endowed Professor at a US university or Professor at a UK university

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সাধারণত লেকচারার (Level B) থেকে নিয়োগ শুরু হয়। এখানকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় বাংলাদেশের মত স্বাধীন হলেও কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া মোটামুটি অভিন্ন নীতি মেনে চলে। নিয়োগের শুরুতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় একটা সিলেকশন কমিটি করে। এই কমিটি সর্বপ্রথম একগুচ্ছ সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া (Selection Criteria) নির্ধারণ করে দেয় যার মধ্যে কিছু অত্যাবশ্যক (Essential) যা থাকতেই হবে, আর তার সাথে কিছু আকাঙ্খিত (Desirable) যা থাকলে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আসুন একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা একটু ব্যখ্যা করা যাক।

ক'দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন-এ লেকচারার পদে একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। বিজ্ঞপ্তি অনু্যায়ী আবেদনকারীকে প্রথমে নিম্মোক্ত সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী নিজের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বর্ণনা দিতে হবে।

SELECTION CRITERIA (ESSENTIAL)

— A doctoral degree by research (PhD degree) in a relevant discipline. (পিএইচডি ডিগ্রী ছাড়া শিক্ষক হিসেবে আবেদনের কোন সুযোগই নেই। আর পিএইচডি ডিগ্রী থাকলে অনার্স/মাস্টার্স বা অতীতের রেজাল্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার নূন্যতম প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। কারণ, অতীতের রেজাল্ট খারাপ থাকলেও পিএইচডি ডিগ্রী প্রাপ্তির জন্য যে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে তার মাধ্যমে অতীতের ব্যর্থতাটুকু ঢাকা পড়ে যায়।)

— Demonstrate experience in quality research with a publication record in recognised journals. (এখানে recognised journal বলতে মামা, চাচা, খালার জার্নাল বোঝানো হয় না, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নাল বোঝানো হয় যা সাধারণত Scopus, Web of Science ইত্যাদি database বিবেচনা করে থাকে।)

— A record of substantial achievement in independent research, an excellent record of peer reviewed publications. (এটা হতে পারে প্রথম অথর হিসেবে গুণগত মানের জার্নাল, সর্বমোট সাইটেশন সংখ্যা, h-index ইত্যাদি।)

— Excellent interpersonal and communication skills, including proven ability to proactively interact, collaborate with staff and students from diverse backgrounds.

— Demonstrate high level written communication and presentation skills, including the capacity to develop and deliver high quality seminars, workshops and lectures.

— Capacity to lead a research program in relevant areas. (এটা candidate এর বিষয়ভিত্তিক পাণ্ডিত্য প্রমাণ করে।)

— Demonstrate ability to work both independently and as part of a team in a professional manner, and to build effective communication skills to all levels of staff within a diverse work environment. (এটা সাহায্য ছাড়া এককভাবে ও দলগতভাবে গবেষণা করার ক্ষমতা প্রকাশ করে।)

— A 1-2 page research plan outlining projects that will be the focus of the first five years in this position, commenting on problem significance, general approach to be used and possible funding sources. (এটা দিয়ে দেখা হয় একজন আবেদনকারীর পরিষ্কার কোনো গবেষণা পরিকল্পনা আছে কিনা, থাকলে তার গভীরতা কত।)

SELECTION CRITERIA (DESIRABLE)

— A track record of engagement with industry and/or government.

— Ability to build networks with other researchers, both local and international.

— Ability in applying for, and securing, awards.

— Past experience of engagement with the community or media in the context of research or scholarship.

উপরোক্ত সিলেকশন ক্রাইটেরিয়াগুলো হলো একজন আবেদনকারীর শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রথম ধাপ। এক্ষেত্রে একজন আবেদনকারী প্রতিটি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার বিপরীতে ছোট একটি করে প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে থাকেন। তারপর গঠিত সিলেকশন কমিটি আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে সিলেকশন ক্রাইটেরিয়াসমূহ মূল্যায়নপূর্বক একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করে থাকেন সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে। এই সাক্ষাৎকার এক বা একাধিক ধাপে হতে পারে। হতে পারে ডেমো ক্লাস বা ওরাল প্রেজেন্টেশন নির্ভর সাক্ষাৎকার। তারপরই একজন আবেদনকারীকে লেকচারার হিসেবে নিয়োগের জন্য চুড়ান্ত সুপারিশ করা হয়।

পাঠকগণ, অতীতে না জেনে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয় জেনে গেছেন অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি এবং ভালো মানের পাব্লিকেশন না থাকলে কেউ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার স্বপ্নও দেখেন না। ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরাও পিএইচডি ডিগ্রী না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় না। শুধু আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রীকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা হয় না! অথচ '৭৩ এর অধ্যাদেশ দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এতদিন ধরে স্বায়ত্বশাসন পেয়ে আসছে। আর এই স্বায়ত্বশাসন ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষসমূহ শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রীকে গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো এসএসসি, এইচএসসির রেজাল্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে! এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন দেখবো, নিয়োগের ক্ষেত্রে জেএসসি, পিএসসি, এমনকি কি কিন্ডারগার্টেনের রেজাল্টও নিয়োগকর্তারা চেয়ে বসছেন!

আর এখন আমলারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের অভিন্ন নীতিমালা সুপারিশ করতে চাওয়ায় চারিদিকে হায় হায় রব পড়ে গেছে, সচিবালয় কেন স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় ছুরি-কাঁচি চালাবে!

গণমাধ্যমের খবর যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ সুপারিশকৃত অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করা হয়, তবে তার সাথে বিসিএস পরীক্ষার পার্থক্য কি থাকবে? তাহলে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়!

সবকিছু বিবেচনায় মনে হচ্ছে, সরকারি আমলা ও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কর্তাদের মধ্যে অনেক ভিন্ন মত থাকলেও (ধারণা করছি এটা ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে) একটা প্রশ্নে তারা সবাই অভিন্ন। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে নূন্যতম যোগ্যতা আর যা-ই হোক, সেখানে পিএইচডি ডিগ্রীর কোনো প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে নতুন-পুরাতন, ভিন্ন-অভিন্ন সকল নীতিমালাই আমার ধারণাকে সমর্থন করছে।