দুপুরের খাবার জরুরি, তবে মানসম্মত শিক্ষা বেশি জরুরি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 26 August 2019, 12:32 PM
Updated : 26 August 2019, 12:32 PM

শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষাওপরিপূর্ণ পুষ্টিনিশ্চিত করতেদেশেরসবপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারসরবরাহের নীতিগ্রহণকরেছেসরকার।সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে'জাতীয়স্কুলমিলনীতি২০১৯'নীতিঅনুমোদন করা হয়। প্রাক-প্রাথমিক ওপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেএমনশিশুদের জন্যএইনীতিমালা। সেঅনুযায়ী, শিশুশিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তিচাহিদার ক্যালরির ন্যূনতম ৩০শতাংশস্কুলমিলথেকেআসানিশ্চিত করা হবে। খাদ্যতালিকার বৈচিত্র্য ঠিকরাখতেমোট১০পদেরখাবারের আয়োজনের কথাবলাহয়েছেনীতিমালায়। সপ্তাহঘুরেদশপদেরমধ্যেঅন্ততচারটিপদরাখলেপ্রত্যাশিত পুষ্টিচাহিদাপূরণহবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রান্না করা খাবার দিলে উপস্থিতির হার ১১ শতাংশ বাড়ে। আর শুধু বিস্কুট দিলে উপস্থিতি বাড়ে ৬ শতাংশ। এই উদ্যোগের সম্ভাব্য ব্যয়ের ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে, কেবল বিস্কুট দিলে প্রতিদিন শিক্ষার্থীপ্রতি ৯ টাকা হারে বছরে দুই হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা লাগবে। পাঁচ দিন রান্না করা খাবার ও এক দিন বিস্কুট দিলে খরচ হবে পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিস্কুট এবং ডিম, কলা ও রুটি দিলে ২৫ টাকা হারে খরচ হবে সাত হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। 

ভবিষ্যতে সারা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন রান্না করা খাবার এবং এক দিন উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে। দেশে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালের মধ্যে এই কর্মসূচি পূর্ণাঙ্গতা পাবে। এর আগে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চলবে এবং ২০২১ সাল থেকে নীতিমালা অনুযায়ী অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে টিফিন দেওয়া শুরু হবে।

শতভাগ শিশুকে প্রাথমিকশিক্ষার আওতায় আনার এই উদ্যোগ নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। তবে অভিজ্ঞরা বলছেন,স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থার চেয়েও তাদের জন্য আধুনিক, যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করা বেশি জরুরি। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থার আগে তাদের পাঠ্যক্রম আধুনিক করার দিকে মনোযোগ দিলে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থী এবং রাষ্ট্রের উপকার করা হবে।

বিষয়টিনিয়ে আসলে আরও চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। কিছু শিক্ষার্থীর জন্য খাবারটা হয়তো উপকার বয়ে আনবে, কিন্তু শিক্ষার মান কি তাতে বাড়বে? আর শিক্ষারমানের বিষয়টিকে অবহেলা করে কেবল যেন-তেন প্রকারে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার বাড়ালেকাজের কাজ কিছু হবে? 'একশ ভাগ শিক্ষিত' কেবল এমন সংখ্যাতাত্ত্বিক আপ্তবাক্য নিয়ে সন্তুষ্টথাকলেই কি চলবে?

আমাদের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ খাবার বিতরণ ও বণ্টন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকানো যাবে কী উপায়ে? নাকি শিশুদের 'ভোজের আয়োজনের' নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে সমস্যার মুখে ঠেলে দেওয়া হবে? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার আয়োজনের অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব একটা ভালো নয়। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার্থীদের রান্না করে ভাত, তরকারি বা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। কিন্তু সেখানে রয়েছে নানা ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও শুভঙ্করের ফাঁকি। আমাদের দেশে স্কুলগুলোতে রান্না খাবারের আয়োজন করা হলে ততোধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

আমাদের দেশে প্রতিদিন দুই-তিন শ বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো কম স্কুলেই আছে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, শিক্ষক নেই। বিদ্যালয়ে যদি দুপুরে খাবারের আয়োজন করতে হয়, তাহলে কমপক্ষে দুইজন শিক্ষককে প্রতিদিনের খাবারের কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। রান্না ও বাসনপত্র পরিষ্কার করার লোকও লাগবে। আর এ কাজে ঠিকাদার নিয়োগ দিলে খাবারের মান জেলখানার মানকেও হার মানাতে পারে।

শুধুতাই নয়, ভিক্ষুকের জন্য বরাদ্দ, দুঃস্থ, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দের টাকা যেমনবারোভূতে খায়, শিক্ষার্থীদের খাবার-বাবদ বরাদ্দের টাকা নিয়েও শুরু হবে লুটপাট। প্রভাবশালীস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার, জনপ্রতিনিধিদের ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়ে পরিণতহওয়ার আশঙ্কা আছে। আর অমুক স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়ে শতাধিক শিশু হাসপাতালে- এমন খবর বাড়বে। আর এই হুজ্জতিতে শিক্ষকদের প্যাঁদানি খাওয়ার আশংকাও থাকবে। প্রয়োজনীয় রান্নাঘর, ডাইনিং তৈরি ও লোকবল নিয়োগ না করলে অরাজকতা হবেই।

আর বাইরে থেকে শুকনো খাবার দিলে সেখানেও ভেজাল আর অনিয়মের আশঙ্কা প্রকট। এ অবস্থায় প্রতিটি স্কুলে দুপুরের খাবার সরবরাহের এই প্রকল্প শুরুর আগে স্কুলগুলোর অবকাঠামো ঠিকঠাক করা উচিত। এখনও বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে শিক্ষার উন্নত পরিবেশ নেই। খেলার মাঠ নেই। এমনকি পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট, চেয়ার-বেঞ্চ, ঘর, জানালা, দরজা, ছাদ, খাবার পানি, ফ্যান প্রভৃতির সমস্যা আছে মফস্বলের বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

স্বাধীনতার৪৮ বছর পরও আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলছে। গত এক দশকে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এসব পরিবর্তনের অনেকগুলোই আবার অপ্রয়োজনীয় প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী হয়নি। শিক্ষার একমুখীকরণওহয়নি। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অংক-ইংরেজি-বিজ্ঞান তো বটেই,এমনকি মাতৃভাষা বাংলাও অনেক শিক্ষক শুদ্ধভাবে লিখতে-বলতে পারেন না। এই শিক্ষকরা যখনশিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন, তখন তা কেবলই দায়সারা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অক্ষরজ্ঞান,ভাষাজ্ঞান, অংক, ইংরেজি, সৃজনশীল কাজ ও ভাবনা, মানবিক গুণাবলির বিকাশ ইত্যাদি বিষয়গুলোরচর্চা না হয়ে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিণত হয়েছে স্রেফ চর্বিত চর্বণ, নিয়ম রক্ষাও গতানুগতিকতায় আচ্ছন্ন একটি অভ্যাস মাত্র। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা একশভাগ শিশুওযদি যাওয়া-আসা করে, তাতে কি লাভ? হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা কি শিশুদের কেবলবিদ্যালয়ের খাতায় নাম উঠিয়ে 'আসা-যাওয়া' শেখাতে চাই? নাকি তারা কিছু জানুক-বুঝুক-শিখুক-সেটাচাই? দ্বিতীয়টি চাইলে অবশ্যই শিক্ষকের দক্ষতা ও মান বাড়ানোর ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বদিতে হবে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব একটা পড়ে না। বিশেষ করে শহর বা শহরতলীতে। এমনকি অনেক গ্রামেও এখন কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে শিশুদের আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগবিহীন অনেকগুলো 'ছবিওয়ালা ইংরেজি বই' পড়ানোর চেষ্টা করা হয়। প্রচুর হোম-টাস্ক দেওয়া হয়। ইংরেজি বই আর হোম-টাস্কের বাহার দেখে অভিভাবকরা রীতিমতো বর্তে যান। তারা শিশুদের কোচিংয়ে পাঠান। টিউটর দেন। কিন্তু কিন্ডার গার্টেনে শিশুদের কী পড়ানো হলো, শিক্ষকদের পড়ানোর যোগ্যতা আছে কি-না-এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। এসব কিন্ডার গার্টেনের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ শিক্ষকের পড়ানোর ওপর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ডিকশনারি দেখে দেখে আর গুগলের সাহায্য নিয়ে তারা কোনো মতে শিক্ষার্থীদের বুঝ দেন। এই অরাজকতার অবসান ঘটাতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ানোর ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। যোগ্য না হলে কাউকে শিক্ষক বানানো যাবে না। শিশুদের পাঠদানে সক্ষম করতে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণের পর তারা যথাযথভাবে সেই প্রশিক্ষণ শ্রেণিকক্ষে কাজে লাগাতে পারছে কি-না-সেটা 'মূল্যায়ন' করে দেখতে হবে। প্রশিক্ষণ পাবার পরও কেউ যদি শ্রেণিকক্ষে তা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয় তবে তাকে প্রয়োজনে পাঠদান থেকে সরিয়ে আনতে হবে। আবারও প্রশিক্ষণে পাঠাতে হবে।

আরযে কোনো মূল্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি,রাজনৈতিক বিবেচনা ইত্যাদি বিষয়কে 'কবর' দিয়ে কেবল মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগনিশ্চিত করতে হবে। কোনো ভাবেই যেন অযোগ্য কেউ শিক্ষক হতে না পারে।

কোটাপূরণের নামে নাম-কাওয়াস্তে কেউ যেন নিয়োগ না পান। আর নারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোযোগীহওয়ার জন্য অনুকূল সামাজিক সংস্কৃতি নির্মাণের ব্যাপারেও উদ্যোগী হতে হবে। সকালে নিজের স্বামী-শশুর-শ্বাশুড়ির সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করার পরবিদ্যালয়ে আসতে হয়। কেউ কেউ আবার নিজের সন্তানকে কোলে করেই বিদ্যালয়ে আসেনশিক্ষা দিতে। সম্ভব হলে দুপুরে এসে স্বামী-শশুর-শ্বাশুড়ির রান্না করতে হয়। নিজের সন্তানকেওদেখতে হয়! নিজের সংসার-সন্তান নিয়ে টেনশন করবেন, নাকি অন্যের সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবেন? না প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকরবেন? পরিবারে ও সমাজে জেন্ডার-সংবেদনশীলতা না বাড়াতে পারলে নারীরাপেশাগত জীবনে খুব একটা সফল হতে পারবেন না। এ ব্যাপারে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সচেতনতাও সংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে। নারীর উপর ডাবল-ট্রিপল বোঝা না চাপিয়ে পুরুষদেরও দায়িত্বনিতে হবে। নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করতে হবে। যেসব নারী শিক্ষকতাপেশায় যুক্ত থাকবেন সেসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জেন্ডার-সংবেদনশীল প্রশিক্ষণের আয়োজনকরলে এ ব্যাপারে সুফল পাওয়া যাবে।

মূলকথা হলো, যে কোনো মূল্যে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, শিক্ষার্থীদের পাঠদানে তাদেরযোগ্য করে তুলতে হবে। তা না হলে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, আসন সংখ্যাবাড়িয়ে, দুপুরের খাবার খাইয়ে, বৃত্তির টাকা দিয়ে শিশুদের বিদ্যালয়গামী করা যাবে ঠিকই,কিন্তু তারা তেমন কিছু শিখবে না। শিক্ষার্থীরা যদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর লিখতে,পড়তে, অংক করতে, সৃজনশীল হতে, ভাবতে, মানবিকগুণাবলি নিয়ে চলতে-ফিরতেই না শেখে, তাহলেআর লেখাপড়া শিখে কী লাভ? সেই নিশ্চয়তাটুকু সবার আগে দরকার।