Published : 21 May 2019, 06:22 PM
আমাদের পরিবারটা ছিল বড়। বারো ভাই-বোনের সংসার, আমি অষ্টম। বাবা ছিলেন কৃষি অফিসার। চাচাতো ও জেঠাতো ভাইদের লেখাপড়ার খরচও তাকে দিতে হতো। ফলে বাবার টাকায় পরিবার চলতো না। সংসারে ছিল দারুণ টানাপোড়েন। দাদার দেওয়া ক্ষেত-খামার আর পুকুরের আয়ই ছিল ভরসা। খরচে টান পড়লেই মা নারকেল আর সুপারি বিক্রি করতেন। ঘরে ছোট্ট একটা টেবিল ছিল। সেখানে একটা হারিকেন জ্বালিয়েই সবাই পড়তাম। পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াও করতাম। মেট্রিক পর্যন্ত কখনও নতুন বই পাইনি। বড় ভাই পাশ করলে তার বই পড়তে হতো আমাকে। আমি পাশ করলে সেই বই রাখা হতো ছোট ভাইয়ের জন্য। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আফসোস ছিল না। বাবা-মা শুধু শাসন করবেন, কিন্তু ভালবাসবেন–এই ধারণাটা তখন ছিল না। কোন জিনিসটা করা উচিত আর কোনটি উচিত নয়–এ বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। আমাদের কাছে ওটাই ছিল মায়ের ভালবাসা।
সাইজে আমরা সবাই খাটো। মা তাই মাঝেমধ্যে রাগ হয়ে বলতেন–'পড়াশোনা যদি না করো তাহলে কামলাও দিতে পারবা না। কারণ খাটোদের কেউ কামলা নেয় না!' শুনে তো খুব মন খারাপ হতো। তখনই বুঝে গিয়েছি–পরিবারে একজন আরেকজনের পাশে থাকতে হবে, আর পড়াশোনা ছাড়া কোনো গতি নেই।
তাইতো আমরা আট ভাই-ই লেখাপড়া করতে পেরেছি দেশের বাইরে। পাঁচ ভাই পিএইচডি ও দুই ভাই করেছে মাস্টার্স। মূলত মায়ের কারণেই মনের ভেতর স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল। তাই এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমরা মায়ের অনুমতি নিই। কষ্টকে জয় করার পদ্ধতি মা-ই শিখিয়েছিলেন।'
জীবন জয়ে মা কীভাবে পাশে ছিলেন নানা স্মৃতি তুলে ধরে সে কথাই বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন। জয়নুল আবেদীন ও জহুরা খাতুনের সন্তান তিনি। বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। প্রোভিসি ছিলেন চার বছর। ভিসির দায়িত্বও পালন করেছেন কিছুদিন। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
আবুল হোসেনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মহাদেবপুর প্রি প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন প্রথমে দালাল বাজার প্রি প্রাইমারি স্কুলে, লক্ষ্মীপুর পিটিআই ইনস্টিটিউট এবং পরে মডেল হাই স্কুলে। ১৯৬৯ সালে দুটি লেটারসহ তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক পাশ করেন। আর্থিক সংকট ছিল। তাই তখন খোঁজ করেন স্কলারশিপের। ভর্তি হন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রি প্রফেশনাল কোর্সে। ওই কোর্সে শতভাগ স্কলারশিপ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল হোসেন ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কোর্সের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের ছাত্র।
ছাত্রজীবনের স্মৃতি আজও জীবন্ত হয়ে আছে আবুল হোসনের হৃদয়ে। তাঁর ভাষায়– 'ওই সময় প্রতি শনিবার স্কুলে ডিবেট করতাম। ওটা কাজে দেয় ইউনিভার্সিটিতে। ফাস্ট ইয়ারে প্রতিভা অনুসন্ধান উৎসব নামে একটা উৎসব হতো। ওটা পরিচালনা করতেন শামসুজ্জামান খান (বাংলা একাডেমির সাবেক ডিজি)। তখন পাঁচটা ইভেন্টেই অংশ নিয়েছিলাম। চারটাতে ফার্স্ট আর একটাতে সেকেন্ড হয়ে ফার্স্ট ইয়ারে চ্যাম্পিয়ন হই। ফলে পরিচিতি যায় বেড়ে। নানা কাজে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাও ডাকতে থাকে তখন। কোন দলে যাব? বড় ভাইরা সবাই ছাত্রলীগ করতেন। তাই আমিও ছাত্রলীগে যুক্ত হই। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদকও ছিলাম। ওই সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আবুল ফয়েজ কুতুবী, নজিবর রহমান ভাই ও আব্দুর রাজ্জাক ভাই (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী) প্রমুখ। ছাত্রদেরকে তখন আদর্শ ও উদ্দেশ্য বুঝিয়ে ছাত্রলীগে আনা হতো। এখন তো ক্লাসের ভাল ছাত্র-ছাত্রীরা সচেতনভাবেই রাজনীতিকে এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ছাত্রদেরকে বেশি করে শেখাতে হবে। মেধাবীদের রাজনীতিতে আনার পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। কেননা মেধাশূন্য নেতা দিয়ে খুব ভালো দেশ গড়া যায় না।'
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি আজও আন্দোলিত করে আবুল হোসেনকে। তিনি সেই স্মৃতি তুলে ধরেন ঠিক এভাবে– '১৯৬৬ সালের ঘটনা। খবর পাই শেখ মুজিব চৌমুহনী হয়ে সামনের রাস্তা দিয়েই যাবেন রায়পুরে। আমরা ভাইরা মিলে তখন কাগজ আর বাঁশ দিয়ে নৌকা বানাই। ওইসময় সেটা টাঙাচ্ছি বাড়ির সামনের রাস্তায়। হঠাৎ গাড়ির শব্দ। দেখলাম কচ্ছপের মতো একটা গাড়ি আসছে। ওই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা একটা মানুষ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা, কালো একটা কোটও জড়ানো। ভাবছি এতো লম্বা একটা লোক এই কচ্ছপের মতো ছোট্ট গাড়িতে কীভাবে ছিলেন। উনি এসে বানানো নৌকাটি দেখলেন। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কথা বললেন একান্তভাবে। সেই দৃশ্যটা মনে গেঁথে গেছে। গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনা হলো। কিন্তু সেটা দেওয়ার জন্য গ্লাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেখ মুজিব ডাবটি মুখে নিয়েই পানি খেতে থাকলেন। ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। এখনও সে স্মৃতি দারুণভাবে মন হয়।'
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করলেও ক্ষমতা দেয় না পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসের ঘটনা। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুল হোসেনদের পরীক্ষা বাতিল হয়। ছাত্রলীগ থেকে তখন তাদের সকাল-বিকাল শারীরিক ট্রেনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর নেতৃত্ব দেন নজিবুর ও আব্দুর রাজ্জাক। ওই সময় মিছিল শেষে তারা কেরোসিনে আগুন দিয়ে পাকিস্তানি পতাকাও পোড়াতেন।
খবর আসে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন ৭ মার্চে। একদিন আগেই আবুল হোসেনরা হল ছাড়েন। ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। তখন সাত কোটি বাঙালিই পথে নেমে আসবে। হল ছেড়ে তিনি চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, মামা বাড়িতে। অতঃপর ৮ মার্চ তারিখে রেডিওতে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি।
কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা?
আবুল হোসেন বলেন– 'পুরো ভাষণটি একটি ছন্দে গাথা। ইট ওয়াজে ভেরি স্লো এন্ড ফ্রুথফুল। বৈষম্যের পুরো ইতিহাস বঙ্গবন্ধু বলে যান ট্র্রেনের গতিতে। বললেন– 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না…….এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!'
এরপর কী করলেন?
'চলে যাই কুমিল্লায়, বুড়িচংয়ে। সেখানে চাকরি করতেন মেজো ভাই। ইমিডিয়েট বড় ভাইও চলে আসেন। ভাইয়ের কাছে ছিল একটা রেডিও। ২৬ মার্চ সকালে রেডিওতে হঠাৎ কে একজন ঘোষণা দিয়ে বলেন–'হামারা নওজোয়ান মাশরেকি পাকিস্তানকো কবজা কারলিয়া।' শুনে আমরা তো অবাক। পরে আকাশবানি থেকে বলা হলো– 'পূর্বপাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, অন্যদিকে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ আর জনতা। দুই পক্ষে হতাহত প্রচুর।' এরপরই আমাদের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।' ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাটিও শুনি এম এ হান্নান নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার কন্ঠে। ২৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমানও। বুড়িচং থানা পরিষদে একটা বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। ২৮ মার্চে সেটা নামালে আমরা প্রতিবাদ জানাই সিইও-র কাছে গিয়ে। এভাবে ওখানে আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপের সঙ্গে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। ওদের নিয়েই পরে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।'
কীভাবে?
সে ইতিহাস শুনি আবুল হোসেনের জবানিতে। তাঁর ভাষায়– '২০ এপ্রিল ১৯৭১। বন্ধুদের বলি তোরা রাতে এসে দরজায় টোকা দিবি। থাকতাম ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাকে কি বলে সরাই? বিকেলের দিকে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধালাম। রাগ করে কথাও বন্ধ। ওই রাতেই ভাইয়ের পকেট থেকে ২১৭ টাকা নিই। এরপর দরজায় খিল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ভাই এসে কয়েকবার দরজায় আওয়াজ দেয়। রাগ করেছি ভেবে পরে মেজো ভাইয়ের রুমে চলে যান। ঘর ছাড়ার আগেই ভাইকে একটা চিঠি লিখে যাই– 'তোমার টাকাগুলো নিলাম। বর্ডার ক্রস করে ভারতে যাব। আমাকে খুঁজো না।'
তাহের, বাশার, নান্নুসহ ১১জন ছিলাম। কুমিল্লার রেলওয়ে পার হয়ে হাতিমারা বিওপিতে আসি। এরপর সোনামুরার পাশে গোমতি নদী পার হয়ে চলে যাই ভারতের কাঠালিয়ায়। সেখানে ট্রেনিং হয় সাতদিন। এরপর আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয় প্রথম সোনামুরায় এবং পরে আসামের ওমপি নগরে। ওমপিতেই ট্রেনিং হয় একুশ দিন। আমরা ছিলাম ফার্স্ট ব্যাচ। সহযোদ্ধা হিসেবে সেখানেই পরিচয় হয় বাসদ নেতা খালেকুজ্জামানের সঙ্গে।'
ট্রেনিংকালীন স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন– 'ওই সময় দেখেছি খালেদ মোশাররফকে। তিনি এক ঘন্টা বক্তৃতা করেছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডোগরা আমাদের পলিটিক্যাল ক্লাস নিতেন। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেলাঘরে। ওখানে দেখা হয় ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের সঙ্গে। এরপর আমাদের নিয়ে আসা হয় নির্ভয়পুরে। ওটা ছিল দুই নম্বর সেক্টরের চার নম্বর সাব সেক্টর। দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান।
ফলিং করিয়ে উনি জানতে চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কে পড়েছে?
ইন্টারমিডিয়েট লেভেল হলেও পড়তাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমি, খালেকুজ্জামান ও ফকরুজ্জামান–এই তিনজন সামনে এগিয়ে আসি। এফএফদের (ফ্রিডম ফাইটার) পরিচালনা জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাদের। লেখালেখি, সেলারী, অস্ত্র ইস্যু, অস্ত্র ও গুলির হিসাব, অপারেশনের খবরাখবর রাখা প্রভৃতির দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। পুরো শৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলেন খালেকুজ্জামান। পরে তিনিই থানাওয়াইজ গ্রুপ তৈরি করে তাদের কমান্ডও ঠিক করে দেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। নির্দেশক্রমে আমি এগারটি থানার প্রত্যেক কমান্ডারকে একটা করে এসএমজি, বাকীদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর একটা করে গ্রেনেড দিয়ে ভেতরে পাঠাই। প্রতি গ্রুপ থেকে এক বা দুইজন মাঝেমধ্যে এসে রিপোর্ট করতেন। ওয়্যারলেসে ওই তথ্য পাঠিয়ে দিতাম মেলাঘরে। এভাবে অস্ত্র দিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সতের'শ মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়েছি।'
তাদের কী কাজ ছিল?
মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের উত্তর– 'ওরা ছিল গেরিলা। গেরিলারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সাধারণের মাঝে মিশে যেত। এক জায়গায় সবাই একসঙ্গে থাকা নিষেধ ছিল। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প যেখানে ছিল দূর থেকে সেখানে রাত্রিবেলা গুলি চালিয়েই সরে পড়তো। তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করাই ছিল মূল কাজ। এটাই গেরিলা ট্যাকটিস। এছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের চলার পথের ব্রিজ ও কালভার্টের ম্যাপ ও তথ্য তারা নিয়ে আসতো। সেগুলো বিশেষ গ্রুপ পাঠিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হতো। নির্ভয়পুর ক্যাম্পে যত এফএফ আসছে তাদেরকে আমরা ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবেই পরিচালনা করেছি।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও শান্তিকমিটির লোকদের কার্যক্রম নিয়ে এই বীর বলেন–'একাত্তরের জুনের শেষ দিকে আমাদের গ্রুপগুলোর চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তখন অস্ত্র হাতে পথে পথে থাকত শান্তিকমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। ওরা পাকিস্তানি সেনাদের রসদ সরবরাহ করতো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা কাজ করতো তাদের ইনফরমেশনগুলো তারাই পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে আসত। শান্তিকমিটির নেতারা নিজের ছেলেমেয়েদের কিন্তু রাজাকার বানায় নাই! তারা তাদের এলাকার গরীব ছেলেদের বেশি রিক্রুট করতো। ট্রেনিং দিয়ে লোভ দেখিয়ে তাদের বলত– 'লুটের মাল জায়েজ। সেটা তোমরা পাবা।' ওরা ব্রিজ পাহারা দিত। ফলে গেরিলাদের সাথে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়েছে বেশি। যদি শান্তিকমিটি, রাজাকার, আলবদর আর আলশামস না থাকতো তবে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা এতো মানুষকে হত্যা করতে পারত না!'
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই সোনামুরার গোমতি নদীর ওপর কাঠের নৌকা রেখে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। চার ডিসেম্বরে ওই পথে ভারতীয় আর্মির কনভয় আসতে থাকে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। আবুল হোসেনরা তখন তাদের সঙ্গেই মার্চ করেন। এফএফ থাকত সবার সামনে। ভেতরে থাকা গেরিলা গ্রুপগুলোও তখন একত্র হয়ে সামনে এগোতে থাকে। যেখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল সেখানেই চলত তুমুল গোলাগুলি। ১৪ ডিসেম্বর তারা চাঁদপুরে এসে পৌঁছে। একদিন পরেই শুনতে পায় দেশ স্বাধীনের খবর।
স্বাধীনের পরেও অস্ত্র ছিল সবার হাতে। এসএমজি নিয়েই বাড়ি চলে যান আবুল হোসেনও। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর খালেকুজ্জামানসহ দুই নম্বর সেক্টরের একটি গ্রুপ অস্ত্র জমা দেয় চাঁদপুরে। আরেকটি গ্রুপ কুমিল্লায়। যত অস্ত্র বিতরণ করা হয়েছিল জমা পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কিন্তু তারপরও রাজাকারসহ পাকিস্তানিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়ে যায়। যা মিস ইউজ হয়। পরে জাসদের হাতেও চলে যায় অনেক অস্ত্র। এমনটাই জানান আবুল হোসেন।
স্বাধীনতা লাভের পরের দেশ নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন– 'একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। সব মানুষই নিঃস্ব। সে দেশ গড়ার দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু। তার চেষ্টারও ক্রুটি ছিল না। কিন্তু সে সময় বঙ্গবন্ধুর দল পুরোপুরি অর্গানাইজড ছিল না। অনেকেই তেমন সহযোগিতাও করেননি। ফলে মানুষকে কনভিন্স করায় গ্যাপ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর সব কথাও তখন তৃণমূলে সঠিকভাবে পৌঁছায়নি। জিনিসপত্রের দামও ছিল বেশি। কিন্তু সার্বিকভাবে এর জন্য তো শুধুু একটি মানুষই দায়ী হতে পারে না। স্বাধীনের পর মোস্তাকের মত লোক বঙ্গবন্ধুর কাছে চলে গেলেন আর তাজউদ্দিন আহমদরা সরে গেলেন দূরে। কার কী স্বার্থ ছিল? এটা নিয়ে আরোও গবেষণার প্রয়োজন আছে।'
এরপর তো জাসদ হলো। খালেকুজ্জামানসহ ছাত্রলীগের বড় একটা অংশ চলে যায় সেখানে। অস্ত্র হাতে গঠিত হয় গণবাহিনী। শত্রুর শত্রু মানে আমার মিত্র। এভাবে রাজাকাররাও তাদের বন্ধু হয়। এন্টি মুজিব প্লাটফর্ম তৈরি করেছিল জাসদ। ফলে তখন স্বাধীনতা বিরোধীদেরও সার্পোট পায় তারা।'
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন– 'মুক্তিযুদ্ধ সারা পৃথিবীব্যাপি আমাদের যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমরা নিজেদেরই নিচে নামিয়ে এনেছিলাম। একবার জাপানে গিয়েছি। ওরা বলেছিল-'কেমন জাতি তোমরা? যাকে আকাশে তুলেছ, জাতির পিতা করেছ, সেই পিতাকেই তোমরা মেরে ফেললে।' এই হত্যাকাণ্ড শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধের অংশও ছিল এটি। যেখানে অংশ নিয়েছিল সেনাবাহিনীর কিছু কুলাঙ্গার। বঙ্গবন্ধু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিন প্রজন্ম নিয়ে নিজের বাড়িতেই ছিলেন। সাধারণ মানুষের আসার কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও নেননি। সবাইকে উনি নিজের লোক মনে করতেন। বাঙালিদের কেউ তাকে মারবে– এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। ফলে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটানো সহজ হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই। বঙ্গবন্ধু অনেক বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু এডমিনেশটেটর হিসেবে বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা এখন অনেক বেশি ফিট।'
জিয়াউর রহমানের শাসনামল কেমন দেখেছেন?
তিনি বলেন–'উনার সাইনবোর্ড হলো মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তিনি যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছিলেন। তার দল এখনও সে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। একটা মিনি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা ছিল তার। কিছু মুক্তিযোদ্ধাও তখন তার সঙ্গে ছিল। তখন যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকাররাও শেল্টার পেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের। বঙ্গবন্ধুর নামও তখন মুখে আনা যেত না!'
মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মনে করেন কয়েক প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
কীভাবে?
তিনি বলেন–'জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই একটা বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনেছে ভুলভাবে। বলা হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়াতে সামরিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এটা তো অবশ্যই ঠিক ইতিহাস না। তখন মিডিয়াও শক্তিশালী ছিল না। দশবার একটা মিথ্যা বললে সেটা আস্তে আস্তে সত্যে রূপ নেয়। আর সত্য ও মিথ্যের মিশেল–সেটা আরও ভয়ঙ্কর। এই কাজটা চলেছে বহুদিন। তাই তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ইতিহাস ছড়িয়েও দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বই একশজনের মধ্যে দশজন পড়বে। দশজনের মধ্যে তিনজনও যদি সেটা ধারণ করে তবে দেখবেন সেটা ট্রান্সমিট হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।'
যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের উত্তর–'বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে বলেছিলেন– 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' স্বাধীনতা কিন্তু আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলমান। অর্থনৈতিক মুক্তিই এনে দেবে প্রকৃত মুক্তি। এটা করবে পরবর্তী প্রজন্ম। তাই মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। কি উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেটিও মাথায় রাখতে হবে। আপনি শুধু গাছের ফুল দেখবেন, ফল দেখবেন, পাতা দেখবেন কিন্তু শিকড়ের কথা ভুলে গেলে তো চলবে না। মুক্তিযুদ্ধটা যদি না হতো আমরা তো বাঙালি হিসেবে টিকে থাকতাম না। তাই এই বাঙালিত্ব ধারণ করেই দেশটাকে এগিয়ে নিতে হবে।'
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগার অনুভূতি প্রকাশ করেন এই সূর্যসন্তান। তাঁর ভাষায়–'বাঁকা পথে ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এটা খারাপ লাগে। বাংলা ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। কিন্তু এখন সমাজের একটা বড় অংশ ইংরেজির প্রতি আসক্ত। ইংরেজির প্রয়োজন আছে। তবে তা হতে হবে বাংলার পাশাপাশি। আগে ছাত্রনেতারা ত্যাগী ছিলেন, এখন তা দেখি না। অতি উৎসাহী লোকেরা সব আমলের জন্য ক্ষতিকর। অতি উৎসাহীর সংখ্যাটাও এখন অনেক বেড়েছে।'
পরবর্তী প্রজন্মই একদিন দেশকে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করবে–এমনটাই বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন–'আমরা শুরু করেছিলাম শুণ্য হাতে। বঙ্গবন্ধু বললেন–'তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে….।' পিটি-প্যারেড আর বাঁশের লাঠি দিয়েই যুদ্ধ শুরু করে এ জাতি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে তো এলএমজির সামনে দাঁড়ানো যায় না! কিন্তু তবুও বুকভরা সাহস আর মনোবলটা ঠিক রেখে বাঙালি দাঁড়িয়েছিল। তাই তো স্বাধীনতা পেয়েছি। সাহস ও মনোবল নিয়ে তোমরাও দেশটাকে এগিয়ে নিও।'
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন।
ট্রেনিং: ভারতের কাঠালিয়ায় স্বল্পকালীন ট্রেনিংয়ের পর একুশ দিনের হায়ার ট্রেনিং করেন আসামের ওমপি নগরে।
যুদ্ধ করেছেন: সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ দুই নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে এফএফদের (ফ্রিডম ফাইটার) পরিচালনায় বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন