Published : 03 Apr 2019, 04:02 PM
বাঙালী জাতির জীবনের একটি ওতপ্রোত অংশ হতাশা। দেশ নিয়ে হতাশা, প্রেম নিয়ে হতাশা, সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। চারপাশে যে দিকে তাকাই নেগেটিভ চিন্তার মানুষের ভীড়। সবাই যেন- আরো বেশি চাই, এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এই যে আপনি জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে মেলাতে হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন, আপনি কী জানেন সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ১২.৯% মানুষ অতিদরিদ্র। তারা তাদের সারাদিনের আয়ের পুরোটা খরচ করেও পরিবারের সদস্যদের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে পারেন না। আমি একবার প্রবল বৃষ্টির সময় প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট্ট টিনের ঘরে একটা পরিবারের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। এক কক্ষের সেই কুঁড়ে ঘরের ভেতর অবিরাম বৃষ্টির পানি ঢুকছিল। আমরা প্রত্যেকে কাকভেজা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন যদি সেই বাড়িতে থাকতেন তাহলে উপলব্ধি করতেন আপনি সেই পরিবারটির চেয়ে কত গুণ বেশি সৌভাগ্যবান।
অসংখ্য দিন আপনি হয়ত শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আপনার জীবনের নানা ভোগান্তির কথা স্মরণ করে দেশ ও জাতির পিণ্ডি চটকেছেন। আপনি কী জানেন আমাদের উপকূলে অসংখ্য মানুষ লবণ পানি পান করে বেঁচে আছেন? সেখানে ভূগর্ভস্থ এবং ভূউপরিস্থ সকল পানির উৎস লবণাক্ত হয়ে গেছে। ফলে মানুষ নানা রকম রোগে ভুগছে। একটা ঘটনা বলি। একটি বেসরকারি সংস্থা সোলার ব্যবহার করে সুপেয় পানি উৎপন্ন করার একটি প্রযুক্তি লবণাক্ততায় আক্রান্ত একটি এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল। দামের দিক দিয়ে প্রযুক্তিটি ছিল খুব সস্তা। কিন্তু সেই এলাকার মানুষ তা গ্রহণ করেনি। কেন জানেন? সুপেয় পানির স্বাদ তাদের ভালো লাগেনি। তারা লবণাক্ত পানি খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন! অথচ আপনার-আমার গোসলখানায় অবিরাম ধারায় পানির অপচয় হচ্ছে। আচ্ছা বলুন তো আপনি বছরে কয়টা মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে দু-এক চুমুক পানি পান করে সে বোতল অবহেলায় ফেলে দেন? ইংরেজীতে Tragety of Commons বলে একটি টার্ম চালু আছে। কিছু মানুষ তাদের নিজেদের আরাম-আয়েশ বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য যখন প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে যার ফলে অন্যরা বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাকেই Tragety of Commons বলে। পানির অপচয় করে, রান্নাঘরের চুলা অপ্রয়োজনে জ্বালিয়ে রেখে, খাবার নষ্ট করে আপনি ঠিক সেই কাজটিই করছেন। আপনি কেন দেশের কাছ থেকে শুধু পেতেই চান? দেশের সম্পদ রক্ষায়, অন্যদের জন্য সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় আপনার বুঝি কোন দায় নেই?
যে ছেলেটি সকালে স্কুলে যায় আর বিকেলে দোকানে কাজ করে একবার তার জায়গায় নিজেকে চিন্তা করে দেখুন। তখন বুঝবেন আপনি কত ভালো আছেন। বস্তিবাসী যে মা তার শিশু সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ইট ভাঙ্গতে যায় সেই শিশুটির কথা ভাবুন। দেখবেন সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে আপনি যে দুশ্চিন্তার পাহাড় গড়েছেন তার বোঝা অনেকটা কমে যাবে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আপনি হতাশার গহীন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন? কত প্রেমের বিয়ে অশান্তিতে শেষ হচ্ছে। প্রেম করতে অস্বীকার করা কত মেয়ে এসিডদগ্ধ হচ্ছে। আপনি কী তাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান নন? আপনি জীবনে একটা সেকেন্ড চান্স রয়েছে। সবার জীবনে তাও থাকে না।
ময়মনসিংহের দারিদ্রপীড়িত প্রত্যন্ত এলাকার কলসুন্দর স্কুলের কিশোরী ফুটবল দলের যে মেয়েগুলো দেশের প্রথম বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা ফুটবল টুর্নামেন্ট জিতেছিল সেই মেয়েদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে একদল মানুষ তাদের বলেছিল তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু চাইতে। প্রত্যন্ত গ্রামের সেই দরিদ্র কিশোরীরা কী বলেছিল জানেন? বলেছিল তারা একবেলা তাদের পরিবারসহ পেটপুরে ভাত খেতে চায়! সেই অনাহারে থাকা, খেলাধুলা চর্চা করার পর্যাপ্ত সুযোগবঞ্চিত মেয়েগুলোই বিদেশের মাটিতে ফুটবল খেলে বাংলাদেশের জন্য একের পর এক জয় এনে দিয়েছে। অথচ আপনার মেয়েটিকে আপনি সাহসী হতে না শিখিয়ে তাকে নিরাপত্তার নামে ঘরের ভেতর আটকে রাখতে চান। তাকে কাপড়ে মোড়ানো পুতুল বানাতে চান।
হ্যাঁ, আপনাকেই তাই বলছি। নিজের চার দেয়ালের গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসে একটু অন্য মানুষের কাতারে দাঁড়ান। তাদের সুখ-দুঃখগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। দেখবেন আপনি হাজার-হাজার মানুষের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। অন্যের জীবন সংগ্রামকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে যারা এগিয়ে চলেছেন তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিন। আমরা এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় হাহাকার তুলি। কিন্তু এসিড সারভাইভার যে মেয়েটি সব বাধাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন তার গল্প কয়জন জানি? যে দলিত শিশুটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যে প্রতিবন্ধী ছেলেটি আজ চাকরি করছে তাদের গল্পগুলো পড়ুন। দেখবেন কোন সমস্যাকে আর সমস্যা বলে মনে হচ্ছে না। মনে রাখবেন Life is really about the journey, not the destination।