পদ্মা থেকে মেট্রোরেলে রামপাল

মামুন আল মাহতাব
Published : 26 August 2017, 07:28 AM
Updated : 26 August 2017, 07:28 AM

বিমানের ফিরতি ফ্লাইট যখন রাজশাহী থেকে আকাশে ডানা মেলছে ড্যাশ-৮এর জানালা দিয়ে নিচে দেখা যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মা। কিছুক্ষণ আগেই হযরত শাহ মাগদুমের দরগা জিয়ারতের পর পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বর্ষায় ভরাযৌবনা নদীটির বিরাট বিস্তার। ভরদুপুরের ঝাঁজালো রোদে হঠাৎ কিছু স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠল। বিমানে উঠে তাই লিখতে বসা।

পদ্মা বরাবরই আলোচনায়– কখনও ভাসানির লংমার্চে, আবার কখনও খাগড়াগড়ে। কখনও-বা বন্যায় তো কখনও পানিবণ্টন চুক্তির টালবাহানায়। তবে অল্পদিন আগেও পদ্মা অনেকদিন ধরে আলোচনায় ছিল অন্য কারণে। সবারই জানা তা। বর্তমান সরকার পদ্মার বুক বিদীর্ণ করে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় তা মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে অনেকের। রব উঠেছিল অগ্রিম দুর্নীতির আর দেশীয়-আর্ন্তাজাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তা হালে পানিও পেয়েছিল। এক সময় বিশ্ব ব্যাংকও পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। তারপর আবার নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটির বাস্তবায়নের দৃঢ়তায় তারা ফিরে আসতে চেয়েছিল। সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।

পদ্মার পানি গড়িয়েছে সুদূর কানাডার আদালত পর্যন্ত। সেখানেও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। নিন্দুকের বুক বিদীর্ণ করে পদ্মার বুকচিরে আগামী বছর বাস্তবতায় আসার অপেক্ষায় বাঙালির স্বপ্নের সেতু।

আমাদের নিন্দুকেরা বোধকরি রর্বাট ব্রুসের বংশধর। পরাজয়ে ডরে না বীর, আর তাদের বেলায় ক্লান্ত হয় না তাদের 'জিহ্বা'। অতএব ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। প্রকৌশলী পিতার সন্তান আমি। পিতা একসময় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। তাঁকে সেই সময় ঢাকায় মেট্রোরেলের স্বপ্ন বুনতে দেখেছি। সেই স্বপ্নের রেল অবশেষে ঢাকার বুকে চালু হতে চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলের চলাচল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটাবে, নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে পড়বে ঢাকায় বিমান বাহিনীর ঘাঁটি আর রসাতলে যাবে লুইকানের বড় সাধের জাতীয় সংসদ ভবন– শুনেছি এমন বহু যুক্তি। সেসব শুনে হেসেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান কদিন আগে বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্টের একটা সেমিনারে বলছিলেন উন্নত বিশ্বের প্রায় চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রতিটিতে রয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন।

নিজেও এক সময় লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে দেখেছি কুইন মেরি কলেজের মাইল অ্যান্ড ক্যাম্পাসের পাশেই মাইল অ্যান্ড টিউব স্টেশন। পর্যটক হিসেবে কেমব্রিজ আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি শিক্ষার্থীদের পান্টিং করতে, মানে সরু খালে নৌকা চালিয়ে পর্যটকদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাতে।

এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি, হার্ভার্ডেও দেখেছি বিশ্বের মেধাবীতম শিক্ষার্থীরা গাইড হিসেবে খুব সুন্দরভাবে পর্যটকদের নিজেদের ক্যাম্পাসে স্বাগত জানাচ্ছেন। সেখানে পর্যটকদের হৈচৈ আর সেলফি তোলায় তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে না– মেট্রোরেলের আনাগোনায় তো নয়ই।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কি তাহলে এতই মেধাহীন?

লুই কানের নকশার কথাই যদি বলেন– মহান এই স্থপতি সংসদ ভবনের নকশার কোথাও কি কবরস্থান এঁকেছিলেন? ভবনটির প্রাঙ্গনে রাজাকারসহ একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তির কবর যদি এই স্থপতির মর্মবেদনার কারণ না হয় তবে ভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে মেট্রোরেলের যাতায়াত তথাকথিত 'কানপ্রেমীদের' এত মর্মপীড়া দেয় কেন বোঝা গেল না!

এরপর হঠাৎ রামপাল। এটি এখন সরকারের সমালোচনায় নিন্দুকদের হটকেক। 'সুন্দরবন গেল গেল' মাতমে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছিল। সেই কম্পন পৌঁছে গিয়েছিল প্যারিসে ইউনেসকোর সদর দপ্তরে। সুন্দরবনের মতো একটি বিশ্বঐতিহ্য রামপালের কালো ধোঁয়ায় কলঙ্কিত হবে এমন আশঙ্কায় ইউনেসকোর কর্তারাও নড়েচড়ে বসেছিলেন– যেমন একদিন সচকিত হয়েছিলেন ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের বড়কর্তারা। রামপালের গলা টিপে ধরার জন্য চাপের পর চাপ এসেছে সরকারের উপর। কিন্তু কথায় আছে না, 'সেরের উপর সোয়া সের'!

সাম্প্রতিক আরেকটি সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বীর বিক্রম শোনালেন তাঁর ইউনেসকো বিজয়ের গাঁথা। পোল্যান্ডে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর এক সভায় উপদেষ্টা বাহিনীর অকাট্য সব যুক্তিতে আর রামপালের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা শুনে পিছু হটেছেন বাঘাবাঘা কর্মকর্তারা। জানিয়েছেন, অনেক সত্য-মিথ্যা তথ্য-উপাত্তে তাদের বিভ্রান্ত করেছিল একটি চক্র। রামপাল প্রকল্পে আপত্তি তুলে নিয়েছে জাতিসংঘের এই অঙ্গসংগঠন– সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তেই। আর তাতে সমর্থন মিলেছে পৃথিবীর সবচাইতে পরিবেশ-সচেতন ফিনিশ সরকারের। চ্যানেল একাত্তর সম্প্রতি ওই সেমিনারে জ্বালানি উপদেষ্টার সেদিনের বক্তব্য নিয়ে 'রামপালের ইউনেসকো বিজয়' শিরোনামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করেছে।

এ তো গেল সুন্দরবনের বিষয়। রামপাল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প এলাকার মানুষজনের রুটি-রুজি খোয়ানোর আশঙ্কায় সুশীলদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. এ কে আবদুল মোমেন একই সেমিনারে শোনালেন তাঁর সাম্প্রতিক রামপাল সফরের অভিজ্ঞতা। রামপালের মানুষ নাকি উল্টে বেজায় খুশি। কারণ তাদের জন্য স্কুল ও হাসপাতাল হচ্ছে– তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

আমার এই যে আবারও লেখালেখির চেষ্টা, সেটা অনেকটাই অকালপ্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে। বেঁচে থাকতে বারবার বলতেন লিখতে। একবার লিখেছিলেন, 'তুমি সুশীল, আমি ছাত্রলীগ'। উপসংহারে এসে তাঁর সেই লেখাটার কথা মনে পড়ছে। তাঁরা সুশীল– তাঁরা সুরের মাঝে অসুরের সন্ধান পান। আমরা ছাত্রলীগ– তাই 'বেয়াদবের' মতো যা-খুশি-তাই লিখে যাই। মরার আগেও লিখতে বলে যাই!