Published : 05 Feb 2017, 09:27 AM
আজ গণজাগরণ মঞ্চের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২০১৩ সালের এই দিনে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ, দ্রোহের চেতনায় সুস্পষ্ট করেছিল ইতিহাসের দায়মুক্তির প্রত্যয়। গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্বোধনে শাহবাগ হয়ে উঠেছিল গোটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। প্রজন্ম চত্বর থেকে বারবার উচ্চারিত হয়েছিল এই শাশ্বত সত্য যে, একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধই এই আন্দোলনের মূল প্রেরণা।
প্রজন্ম চত্বর শহীদজননীর সন্তানদের বিদ্রোহের আকাশ। সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবি সামনে রেখে চলমান এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন হয়েছে। তবে এখনও নিষিদ্ধ হয়নি জামাত-শিবিরের রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় অপগোষ্ঠী তাদের পাকিস্তানি অপদর্শনের চাষাবাদ করে যাচ্ছে সারাদেশের নানা প্রান্তে। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
গণজাগরণ মঞ্চ শুরু থেকেই তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এই আন্দোলন একটি দর্শনভিত্তিক আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের যে অমিত দর্শন; স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দর্শন, তার ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়েই গণজাগরণ মঞ্চ এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছে।
দুই.
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির এক সম্পূর্ণ সংজ্ঞায়ন। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা ক্ষেত্রে যে হারে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' শব্দদ্বয় উচ্চারিত হয়, সে হারে তার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করা হয় না। বিভিন্ন মানুষের কাছে এর অর্থ বিভিন্ন রকমের হবে; কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় গণজাগরণ মঞ্চ তার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই বোধটুকু অবলম্বন করেছে যে, এই শব্দ-যুগল আসলে বাঙালির সমস্ত কিছুর সংজ্ঞায়ন। আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি; এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোরও একটি পরিপূর্ণ সংজ্ঞায়ন এই 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'।
এটি বলার মূল কারণ হল, মুক্তিযুদ্ধ কেবলই নয় মাসের একটি সশস্ত্র যুদ্ধ নয়; বরং হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসের যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও একই সঙ্গে রক্তস্নাত পথপরিক্রমা, তা-ও মুক্তিযুদ্ধেরই আখ্যান দলিল। বাংলার ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়, কেবল বর্বর পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনামলেই নয়, বরং ব্রিটিশ বা তারও আগে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি তার অধিকারের প্রশ্নে গর্জে উঠেছে, রক্ত দিয়েছে।
এই মহাসংগ্রামের মহাবাদলে ভেসে গেছে বহু অত্যাচারী নিপীড়ক শাসক আর তাদের তাঁবেদাররা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের অধিকার; হয়তো আবার তা বেহাতও হয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের পরিক্রমায় বাংলার মানুষ ক্লান্ত হননি কখনও; বরং সহযোদ্ধার লাশ কাঁধে নিয়ে সে মিছিলে নেমেছে, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্লোগান দিয়েছে।
সেই দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি অণু-পরমাণু আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের নির্মাণ করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রক্ত দিয়েছে বাংলার মানুষ, ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়েছে, দিয়েছে তৎপরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে। এই মাটি থেকেই জন্ম নিয়েছেন ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারসহ সারাদেশের ভাষা শহীদগণ। আবার এই মাটিরই সন্তান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা– একাত্তরে যাঁদের অবিনাশী কণ্ঠে গান গেয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল।
সুতরাং দীর্ঘ ইতিহাসে বাংলার লড়াই সংগ্রাম থামেনি, বরং চেতনার প্রবহমানতা ছিল মানুষ থেকে মানুষে– কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে– মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণআদালতে, গণজাগরণে।
বাঙালির আন্দোলন ও যূথবদ্ধতা বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত ছিল সেই শুরু থেকেই। সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের আফিম খাইয়ে বাংলা ভাগ করা হল। পাকিস্তান তৈরির পরই তারা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ন্যাক্কারজনক আগ্রাসন শুরু করে। বুকের রক্তে বাঙালি মাতৃভাষার অধিকার আদায় করে। তেইশ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি প্রতি মুহূর্তে মেলে দিয়েছে নিজের আত্মজ সংস্কৃতির ডানা। তাতেই বিশ্বাস রেখেছে সে এবং স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ কেবলই একটি 'যুদ্ধ' নয়; এর একটি দার্ঢ্য দার্শনিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে।
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাসটি বিভিন্ন সময় আলোচিত হলেও, এর দার্শনিক ইতিহাস আলোচিত হয়েছে খুব কমই; সত্যি বলতে, ওই অর্থে হয়ওনি। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত গণমানুষের চোখ দিয়ে না দেখে অধিকাংশ সময়ই দেখা হয়েছে রাজনৈতিক দলের চোখ দিয়ে। সে কারণেই, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও আমরা দেখছি, বাঙালির আলোকোজ্জ্বল আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস গণমানুষ বিচ্যুত হয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই আটকে আছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও দৃশ্যপট একই। তিনি যে কোনো বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের নেতাই কেবল নন; বরং গণমানুষের প্রাণের নেতা এবং অন্য সব কিছুর চেয়ে এটাই শাশ্বত সত্য, তা আমাদের ইতিহাসে উচ্চারিত হয়েছে খুব কমই। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিটি মানুষের এক মিলিত মহীরূহ রূপই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের এক অপূর্ব সমার্থক হয়ে উঠেছেন তাঁর ত্যাগ আর চিন্তার অনন্যতায়। 'জয় বাংলা' মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্লোগান; সে কারণেই বাংলার সর্বকালের সর্বজনের প্রাণের স্লোগান এটি।
মুক্তিযুদ্ধের এই অচর্চিত দার্শনিক ভিত্তির পাটাতনেই দাঁড়িয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। তৈরি করেছে তার আন্দোলনের রূপরেখা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে দার্শনিক ভিত্তি, স্বাধীন বাংলাদেশে তার অনেকাংশই প্রতিফলিত হয় বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্য দিয়ে। স্বীকার্য, পুরোটা তখনও হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন কতটা মূর্ত হয়েছিল, সে প্রশ্ন আজও থেকে যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি গড়ে তোলার কাজে যারা নিয়োজিত হয়েছিলেন, তাদের মাঝে তখনও পাকিস্তানি ভূত-দর্শন ছিল প্রকট। বস্তুত সে কারণেই স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট একই সঙ্গে বাঙলাদেশের ইতিহাসের এক ট্র্যাজিডি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পথ-হারানোর এক বেদনাবিধুর এলিজি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে পদস্খলনের শুরু। ইতিহাসের এ পর্যায়েই আমরা বুঝতে পারি, স্বাধীন দেশে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোর মগজে ক্যান্সারের জীবাণুর মতো তখনও ছিল পাকিস্তানি অপদর্শন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে আমরা বুঝতে পারি, কীভাবে তা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র এবং সে সুযোগেই যুদ্ধাপরাধীরা তাদের হিংস্র থাবা বসাতে থাকে শ্যামল বাংলার মাটিতে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস 'পাকিস্তানি দর্শন' প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা মানুষ হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে; মূলত ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে।
যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তাদের বিরোধিতাটি আদর্শিক বিরোধিতা হিসেবে প্রকাশ করেছে এবং এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টা করেই চলছে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর এর মূল প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা।
কিন্তু মানুষ তার প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তৎকালীন বিএনপি সরকার নানাভাবে সেই আন্দোলন নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইতিহাস তো সাক্ষী– গণমানুষের ন্যায্য দাবির আন্দোলন কোনো শাসকগোষ্ঠী কখনও দমন করতে পারে না।
ইতিহাসের এই সত্য গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিটি মুহূর্তে মনে রেখেই সকল সঙ্কট-শঙ্কার কালগুলো অতিক্রম করেছে; এখনও করছে।
তিন.
বাংলাদেশের তেতাল্লিশ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন গুরুত্ব পায়নি কখনও। এর মূল কারণ সম্ভবত এই যে, পঁচাত্তর-উত্তর রাজনীতির একটি সময় জনগণের চেয়ে বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; আর বাকি সময়টাতে আদর্শের রাজনীতির চেয়ে ভোটের রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আর সে কারণেই তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ একটি সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বাহাত্তরের সংবিধান ফিরে আসেনি, রাষ্ট্রধর্ম বাতিল হয়নি এবং এখনও জামাত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে। সুনিশ্চিতভাবেই আদর্শের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ভোটের রাজনীতি।
আদর্শহীন রাজনীতির কোনো চরিত্র থাকে না। আর রাজনৈতিক এই চরিত্রহীনতার সুযোগেই জামাত-শিবির তাদের ধর্মীয় রাজনীতির মোড়কে পাকিস্তানি অপদর্শনের বিষবৃক্ষ বপন করে চলছে।
একটি গণআন্দোলনের বিষয়ে সার্বিক মন্তব্যের ক্ষেত্রে চার বছর উল্লেখযোগ্য সময় নয়। তারপরও সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এবং একাত্তর থেকে চলমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবর্ণনায় গণজাগরণ মঞ্চের একজন কর্মী হিসেবে এই আন্দোলনের অবস্থানটি পুনর্ব্যক্ত করা প্রয়োজন। 'মুক্তিযুদ্ধের দর্শন'ই গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন পরিচালনার দার্শনিক ভিত্তি। একাত্তরে পাকিস্তানি অপদর্শন মোকাবেলার জন্যেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে মানবিক মর্যাদা ও সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে, তা কেবল মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের রাজনৈতিক বাস্তবায়নেই সম্ভব।
এই রাজনৈতিক লড়াইয়ের উৎসবিন্দু মুক্তিযুদ্ধের দর্শন এবং তার হাতিয়ার গণমানুষের সাংস্কৃতিক উদ্বোধন। আর এ কারণেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে যারাই রাজনীতি করুন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের কিছু মৌল প্রশ্নে তাদের একমত হতে হবে। সরকারি কিংবা বিরোধী দল যা-ই হোক না কেন, তাকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
এটি বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের প্রশ্নে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। আমরা যেন কখনও ভুলে না যাই যে, রাজনীতি ঠিক ততটা পথই চলে, দর্শন যতটা পথ নির্মাণ করে দেয়। চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই শপথই পুনরুচ্চারিত হোক।