আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

আগুন আর লোভ বাড়তে দিলে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে দুটোই। কাজেই আগুন যেন না লাগে, তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে এখনই।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 1 March 2024, 03:02 PM
Updated : 1 March 2024, 03:02 PM

মহাভারতের কাহিনি মতে, অগ্নিদেবের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডব চতুর্দিকে বেষ্টন করে খাণ্ডব নামের অরণ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এই অরণ্য দগ্ধ করে তার সমুদয় প্রাণকে উপহার দেওয়া হয়েছিল অগ্নিকে, তার বুভুক্ষা মেটাবার জন্য।

আমাদের দেশে এখনো সেই খাণ্ডবদাহন চলছে। কিছু মানুষের অপরিসীম লোভ ও দুর্নীতির কারণে অসংখ্য নিরীহ প্রাণ দগ্ধ হয়ে চলছে। সর্বশেষ রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে মারা গেছে প্রায় অর্ধশত মানুষ। 

এতগুলো মানুষের এমন করুণ মৃত্যু দেশবাসীকে শোকাকুল করেছে। এমন কখনো মেনে নেওয়া যায় না। স্রেফ উদাসীনতা আর গাফিলতির কারণে এতগুলো মানুষকে অকালে মরতে হলো। যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, সেখানে এতগুলো খাবারের দোকান অনুমতি পেল কীভাবে? অনেকগুলো খাবারের দোকান, বিপুল মানুষের সমাগম ঘটলেও সেখানে সিঁড়ি ছিল মাত্র একটা। এর বাইরে কোনো জরুরি বের হওয়ার পথ ছিল না। ছিল না কোনো ধরনের ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। ধোঁয়ার কারণে মানুষ যেখানে অচেতন হয়ে পড়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর মতে, ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি ছিল। কিন্তু অফিস না করে এখানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টেসহ দোকান করা হয়েছে। যেখানে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি উপক্ষিত হয়েছে। এই ভবনের সকলকে ইতিপূর্বে ফায়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সতর্কবাণী কেউ মানেনি। তাদের মানতে বাধ্য করানোরও কেউ ছিল না। 

ফলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছে এতগুলো মানুষকে। এতবড় একটা ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সেইফটি প্ল্যান ছিল না। কিছু ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার থাকলেও বিপদের সময় সেগুলো ব্যবহার করার কেউ ছিল না। এই ভবনে প্রতিটি বিপণিবিতানের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে, দোকানের ভেতর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর যান্ত্রিক ব্যবস্থা (স্প্রিংকলার) থাকলে ক্ষতির হার অনেক কম হতো। 

রাজধানীর অভিজাতপাড়া হিসেবে স্বীকৃত বেইলি রোডের মতো একটি জায়গায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়াই একটি ভবনে খাবারের দোকান চলছিল কীভাবে? কেন সেখানে জরুরি প্রয়োজনে নামার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল না? কেন সিঁড়ির গোড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছিল? 

এমনিতে ভবন ব্যবহার সনদ না পেলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন-সংযোগ দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন— প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে রাজউক ব্যবহার সনদ না দেওয়া সত্ত্বেও ভবনমালিকরা বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন-সংযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। এর পেছনে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সীমাহীন লোভ ও দুর্নীতি। আমাদের দেশে যে কোনো অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি খরচ করতে হয়। নিয়ম মানানোর চেয়ে বাড়তি আয়ই এখানে মুখ্য। তাই এখানে দুর্ঘটনাই স্থায়ী। 

আমাদের দেশে অফিস, মার্কেট, কারখানায় আগুন লাগবে, কিছুদিন কোলাহল হবে, কিছু মানুষ সরব হবেন, তারপর নতুন বিষয়ের ছাইয়ে পুরোনো আগুন চাপা পড়ে যাবে— এমনটাই যেন নিয়ম। একেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তারপরই দেশবাসী নিয়ম করে শোনেন সুরক্ষার আশ্বাস। প্রতিবার জানানো হয়, বস্তি, মার্কেট, গুদাম, বাসভবন, বহুতল এবং বড় দপ্তর, বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর নজরদারি হবে; বিধি না মানলে হবে জরিমানা। কিন্তু পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, এসব অঙ্গীকারের কোনোটাই পালিত হয়নি। এ যেন আগুন নিয়ে খেলা!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগুনকে যে ভয় পায়, সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না।’ কথাটা খুবই সত্যি। আমরা আগুনের যথাযথ ব্যবহার শিখিনি। শিখিনি আগুনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। তাই আগুনকে ভয় পাওয়া শুরু করেছি। পুরো ঢাকা শহরেই চলছে আগুন-আতঙ্ক। গত কয়েক বছরে বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও শতাধিক লোকের প্রাণহানির ঘটনার পর এই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বড় বড় বিল্ডিং, ঘরবাড়ি, মার্কেটের এই আগুন মানুষের মনের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছে। 

আগুনের ব্যাপারে আমাদের আসলে আরও সাবধান হওয়া উচিত। আগুন, যার একটাই গুণ— কেবল জ্বালাতেই জানে। এই আগুনের ক্ষুধা এতটাই একপক্ষীয় ঘটনা যে জান-মালসহ কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে না। আগুন আর লোভ বাড়তে দিলে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে দুটোই। কাজেই আগুন যেন না লাগে, তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে এখনই। তা না হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই একদিন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে!

শুধু অন্যের সমালোচনা নয়, আমাদের আত্মসমালোচনাও করা দরকার। আগুনের এই দৈত্য তো আমরা সবাই মিলেই তৈরি করেছি। বেইলি রোডে যারা পুড়ে মরেছেন, তারা তো আমাদেরই স্বজন। আমিও তো থাকতে পারতাম মরদেহের সারিতে। এক সময় আমরা ভাবতাম, লোভের আগুনে শুধু তাজরিনের পোশাককর্মী, নিমতলীর শ্রমিক ও বস্তির মানুষেরাই পুড়বে। কিন্তু দৈত্য এখন আমাদের মধ্যবিত্ত ও বড়লোকদের দরজায়ও কড়া নাড়ছে। আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন, বাবা, চাচা, মামা, স্বামী কিংবা আমার নিজের লোভ আজ এই নাজুক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে শহরকে। যেখান থেকে আমার নিজেরই বাঁচার উপায় নেই। তাই লোভের আগুন দেখে বিধ্বস্ত আমরা। 

আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সততা ও আবেগ বিতরণ করছি, তারা কি নিজেদের বসতবাড়ি, ব্যবসা ও কাজের জায়গাটির সুরক্ষা নিশ্চিত করেছি? অগ্নিকাণ্ড কিংবা ভূমিকম্পের সময় দ্রুত নেমে আসার সিঁড়ি আছে কয়টি বাড়ি ও অফিসে? দমকলের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স সহজে আসতে পারবে এমন কয়টি গলিপথ আছে এই শহরে? পাঁচতলার ভিত দিয়ে তৈরি করে ফেলছি নয়তলা। একই ভবনে দশ রকমের বাণিজ্যিক কার্যালয় ও খাবারের দোকানকে ভাড়া দিয়ে টাকা গুনছি। কখনও টাকা, কখনও ক্ষমতার দাপট ও লোভে অনিয়মের ফাইলে চোখ বুজে স্বাক্ষর দিয়েছি। অথবা স্বাক্ষর করিয়ে এনেছি। এখন সেই দফতরের সমালোচনায় মুখর আমরা। আবার এমনটাও দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের পর কর্তাব্যক্তিরা যত তপ্ত কথা ও নির্দেশই দেন না কেন, সেগুলোও মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। যখন কর্তারা ওই ভবন বা স্থাপনার ক্ষমতাধর মালিকের নামটি জানতে পারেন। কোনো কোনো ভবন মালিকের নাম উচ্চারণ করার সাহসও রাজউক, ফায়ার ব্রিগেড, এমনকি গণমাধ্যমের ক্ষমতায় কুলোয় না। মন্ত্রীরা পর্যন্ত তাদের সমীহ করে চলেন। এভাবেই আমরা একটা অনিয়মের রাজ্য গড়ে তুলেছি। যেখানে কেবল তুষ্ট করা হচ্ছে লোভের দেবতাকে। তাকে তুষ্ট করতেই খাণ্ডবদাহন চালু রাখা হয়েছে! 

প্রতিটি দালানকোঠা, কলকারখানায়, অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আগুন লাগার পর উঁচু ভবন থেকে বের হওয়ার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পথ বা সুড়ঙ্গের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রান্নাঘরের গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রান্নাঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

হাউসকিপিং, আগুনের উৎস এবং মানুষের প্রতি সার্বক্ষণিক তদারকির ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। 

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জমাদি ব্যবহার করা উচিত। 

কোথাও কোথাও রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা থাকে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে সঠিক নিয়মে। চুলা জ্বালানোর আগে দরজা-জানালা খুলে দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে অবশ্যই। 

ম্যাচের কাঠি, সিগারেট প্রভৃতি ফেলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে।

হোটেল-রেস্টুরেন্ট বাসাবাড়ি যেখানেই গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলা থাকবে সেখানেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হোক।

বহুতল ভবনে আগুন লাগলে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। তাই ফায়ার এক্সিট এবং নিরাপত্তা লবি থাকতে হবে এসব ভবনে। 

আগুন লেগে গেলে কী করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের সবাইকে নিয়ে সেটির মহড়া দিতে হবে নিয়মিত। 

রাজউককে শক্তিশালী করতে হবে। রাজউকের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। রাজউকের দায়িত্ব হচ্ছে:

ভুমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ভবনের নকশা অনুমোদন, নির্মাণকালীন মনিটরিং এবং নির্মাণ শেষে ‘ব্যবহার উপযোগী সনদপত্র’ (Occupancy Certificate) প্রদান ।

এই ‘ব্যবহার উপযোগী সনদপত্র’ ৫ বছর মেয়াদী এবং মেয়াদ পূর্তির আগেই নবায়ন করতে হয়।

রাজউক নিজেরাই স্বীকার করে ঢাকা শহরে মাত্র কয়েকশ ভবনের ‘ব্যবহার উপযোগী সনদপত্র’ আছে, অধিকাংশেরই নেই । 

এটার প্রয়োজন আছে বলেও অনেক ভবন মালিক বা ভবন উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান অবগত নন।

এই সনদ বাধ্যতামূলক করা গেলে, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। রাজউককে এটা বাস্তবায়নে কঠোর আন্তরিক হতে হবে, সেইসঙ্গে  নীতি নির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের শক্ত সমর্থন দরকার হবে।